ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ছায়ানটে প্রতিবন্ধী শিশুদের নাট্যাভিনয়

সীমাবদ্ধতাকে জয় করার সংগ্রাম, নাটকের ভাষায় নিজের কথা

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

সীমাবদ্ধতাকে জয় করার সংগ্রাম, নাটকের ভাষায় নিজের কথা

মোরসালিন মিজান জীবন বটে। ছন্দহীন। বিবর্ণ। হাসি-রাশি-আনন্দ নেই কোন। লাঞ্ছনা- গঞ্জনায় ভরা। সমাজ নিতে চায় না। পরিবারও অতিষ্ঠ হয়ে যায় এক পর্যায়ে। প্রতিবন্ধী শিশুদের এই গল্প অনেক পুরনো। বার বার শোনা। তবে শনিবার যে ছেলেমেয়েদের দেখা হলো, তারা সত্যি অন্যরকম। নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে জয় করেনি শুধু, অধিকারের কথা বলছে এবং তা নাটকের ভাষায়। ছায়ানট মিলনায়তনে প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিনীত নাটক দেখে দর্শক তাই মুগ্ধ। করতালি দিয়ে তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন সবাই। বাবা-মায়েদের চোখে তখন জল। আনন্দে চোখ ভিজে উঠেছিল তাদের। নাটকের নাম ‘জীবন আমার সিদ্ধান্তও আমার।’ ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নাটক করবে, সেই নাটকের এত কঠিন নাম? অবাকই হতে হয়েছিল প্রথমে। পরে দেখা গেল স্ক্রিপ্ট আরও কঠিন। সহজ করে বলা হয়নি কিছুই। বিভিন্ন আইন, আইনের ধারা-উপধারা বর্ণনা করছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে এদিন অভিনয় করেন সানিজন হোসেন, শিলামনি, জালাল উদ্দিন আকবর, তারেক আজিজ, ইতি, শিলা, রাবেয়া আক্তার মিতু, সাদিয়া, উর্মি আক্তার জ্যোতি, রিমা ও সজিব। শিল্পীদের কেউ এখনও নিজেকে বুঝে উঠতে পারেনি। অথচ অন্য একটি চরিত্রকে ঠিক ঠিক ধারণ করেছিল। নাটকের ভাষায় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের কথা বলে তারা। তাদের সুরক্ষার জন্য যেসব আইন করা হয়েছে, সেগুলো উল্লেখ করে। সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের দাবিগুলো উত্থাপন করে তারা। নির্ভুল ডায়ালগ। সুন্দর ডেলিভারি। চরিত্রগুলোকে মূর্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা। ১৫ মিনিটের এই চেষ্টা দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। বিপুল করতালির মাধ্যমে দর্শক তাদের অভিনন্দিত করেন। নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানতে পরে কথা হয় শিলামনির সঙ্গে। বাচ্চা মেয়ে বেশ গুছিয়ে কথা বলে। এত কঠিন কঠিন ডায়ালগ কী করে দিলে তুমি? জানতে চাইলে মিষ্টি হেসে সে বলে, আমরা গত দু’-তিন মাস ধরে তো রিহার্সেল করেছি। তাই কোন সমস্যা হয়নি। নাটকের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয় সানজিদ। বলে, অনেকেই আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না। এড়িয়ে চলে। স্কুলে যাব, সেখানেও নিতে চায় না। নাটকে কী সে কথাগুলোই বললেন? এমন প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’সূচক মাথা নাড়ে সে। মঞ্চের সামনে বসে নাটক উপভোগ করেন সন্তানদের বাবা মায়েরাও। এ সময় অনেকের চোখে জলে ভিজে ওঠে। মিতুর মা মমতাজ বেগম বলেন, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। অনেক। আজকে তাকে যে রূপে দেখলাম তাতে সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে। খলিল নামের আরেক অভিভাবক বলেন, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় এত আইন আছে আমার নিজেরই জানা ছিল না। নাটকটি দেখে জানা হলো। এমন সুযোগ করে দেয়ার জন্য আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যতিক্রমী এই আয়োজন করে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিড। চমৎকার উদ্যোগের সঙ্গে আরও ছিল স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট, ডিডিআরসি এবং ডিসএবিলিটি রাইটস এ্যাডভোকেসি ফান্ড। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাটকে অভিনয় করা সকল ছেলেমেয়েই এসেছে সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে। একেবারে হতদরিদ্র বাবা মায়ের সন্তান তারা। তবে এখন তারা বেশ আছে। ভেঙ্গে পড়ার বদলে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কবিগুরু লিখেছিলেনÑ নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ/সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে। পূর্ণতা পাক ওদের জীবন।
×