ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বায়োগ্যাস ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

বায়োগ্যাস ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ বায়োগ্যাসে চুলা জ্বলে। রান্না হয়, কিন্তু ধোঁয়া হয় না। অত্যন্ত সাশ্রয়ী। অথচ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মত। বায়োগ্যাসের স্যালারিতে হয় মাছের খাবার ও জৈব সার। আর বায়োগ্যাস বেশি হলে ভাড়াও দেয়া যায়। এতসব গুণের কারণে বায়োগ্যাসে ব্যবহার বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে ক্রমশ বাড়ছে। আগ্রহী হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরুর খামারিরা। ‘বায়োগ্যাসের সুবিধা কত, গ্রামে থেকে শহরের মতো।’ এ শুধু এখন সেøাগান নয়, বাস্তবে বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করে নানামুখী সুফল ভোগ করছেন গরুর খামারি, কৃষক পরিবার। বাগেরহাট জেলার নয় উপজেলায় ৩শ’ ২৭টি বায়োগ্যাস প্লান্ট রয়েছে। প্রত্যেকটি প্লান্ট থেকে উপকৃত হচ্ছে কৃষকেরা। জেলার সদর উপজেলায় ৬০টি, কচুয়ায় ২৬টি, মোড়েলগঞ্জে ৩৮টি, শরণখোলায় ১২টি, মোংলায় ৪২টি, রামপালে ১৬টি, ফকিরহাটে ৬০টি, চিতলমারীতে ২৮টি এবং মোল্লাহাটে ৪৫টি বায়োগ্যাস প্লান্ট বর্তমানে চালু রয়েছে বলে বলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ সাইফুজ্জামান জানান। তার ভাষায়, অত্যন্ত সাশ্রয়ী ও বহুমুখী সুবিধার কারণে দিন দিন খামারি কৃষকের মধ্যে বায়োগ্যাস প্লান্টের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলায় তিন শতাধিক বায়োগ্যাস প্লান্ট হওয়ার কারণে পশুর খামার থেকে দূষণের হার কমেছে। জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি ফসল। বায়োগ্যাসে রান্নার কারণে কমছে মা ও শিশু রোগ। বাগেরহাট সদরের বিষ্ণুপুরের জালাল উদ্দিন ও বারইপাড়া ইউনিয়নের সফল খামারি মোঃ মোস্তফা জানান, ব্যায়োগ্যাস প্লান্টের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে পচনশীল বর্জ্য। এ অঞ্চলের প্লান্ট গুলোতে পশুর বর্জ্য (গোবর/বিষ্ঠা) ব্যবহৃত হয়। এটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। যথেষ্ট তাপমাত্রায় ভালভাবে রান্নাবান্না করা যায়। আবার প্লান্টের স্যালারি (বর্জ) কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। এ কারণে বায়োগ্যাসের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।’ জেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা হৃষিকেশ দাশ প্রায় অনুরূপ কথা বলেন। যেভাবে তৈরি হয় প্লান্ট খামারের পাশে বা সুবিধামত স্থানে মাটির নিচে একটি ট্যাঙ্কি করা হয়। ট্যাঙ্কির পাশে উপরিভাগে থাকে একটি গোলাকার পাত্র। যে পাত্রে গোবর বা কাঁচামাল ফেলা হয়। ঐ পাত্রের সঙ্গে পাইপ দিয়ে ট্যাঙ্কিতে সংযোগ দেয়া থাকে। তার পাশে থাকে আরেকটি হাউস। এ হাউসের সঙ্গেও ট্যাঙ্কির সংযোগ থাকে। ট্যাঙ্কিতে জমে গ্যাস। অন্য হাউসে বায়োগ্যাসের স্যালারি জমে। এখানে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বায়োগ্যাস প্লান্টগুলো গরুর খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। খামারের মালিকদের পরিবারের প্রয়োজনীয় রান্না হয় এ বায়োগ্যাসেই। ঘেরের মাছের খাবার ও গরুর খাবার রান্নাও হয় এ গ্যাসে। যেসব খামারির গরু বেশি তারা পাশের বাড়িতে ভাড়ায় গ্যাসের সংযোগও দিয়েছে। সদর উপজেলার কোন্ডলা আদর্শ খামারের মালিক শেখ মুশফিকুর রহমান বলেন, আমি গরুর খামার করার পরে বর্জ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমার মাথায় আসে বায়োগ্যাস প্লান্টের চিন্তা। তখন আমি এ প্লান্ট তৈরি করি। আমার কর্মচারীদের খাবার রান্নার জ্বালানি হয় এ গ্যাস দিয়ে। তারপরও গ্যাস অবশিষ্ট থেকে যায়। তখন পাশের বাড়ির লোকদের একটি গ্যাস সংযোগ দিয়েছি। আর বায়োগ্যাসের স্যালারি (অবশিষ্ট বর্জ্য) শুকিয়ে আমার মৎস্য ঘের ও কৃষি ক্ষেতে ব্যবহার করি।’ ভাড়া গ্রহিতা মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি গ্যাস সংযোগ দিয়ে একটি চুলা ব্যবহার করি। মাসে পাঁচশত টাকা ভাড়া প্রদান করি। কাঠের জ্বালানির থেকে অনেক কম খরচে আমার রান্নার কাজ হয়ে যায়। বাগেরহাট শহরের দর্জি ডেইরি ফার্মের মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, আমার খামারে ও তার আশপাশে কোন গন্ধ নাই। খামারের গোবর আমি বায়োগ্যাস প্লান্টে ব্যবহার করি। আমাদের রান্নার সকল কাজ এ গ্যাসে হয়ে যায়। আমার পরিবারের রান্নার জন্য কোন কাঠ ব্যবহৃত হয় না। বায়োগ্যাসে প্লান্ট স্থাপনে কারিগরি সহযোগিতা প্রদানকারী বেসরকারী সংস্থা গ্রামীণ শক্তি’ বাগেরহাটের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, পরিবেশ রক্ষা ও দূষণমুক্ত জ্বালানি ব্যবস্থা নিশ্চত করতে আমরা বিনামূল্যে খামারিদের বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরিতে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করছি। এক্ষেত্রে সরকারী সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) থেকে আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকি। বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ লুৎফর রহমান বলেন, পশু খামারের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে গন্ধ ও পরিবেশ দূষণ। খামারের বর্জ্য বায়োগ্যাস প্লান্টে ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে না। প্লান্টের গ্যাস ও স্যালারি ব্যবহারে খামারি উপকৃত হচ্ছে। কৃষিসম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোঃ আফতাব উদ্দিন বলেন, বাগেরহাটে বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। এটা কৃষি জমি ও ফসলের জন্য উপকারী। কৃষি জমিতে বায়োগ্যাসের স্যালারি সার হিসেবে ব্যবহারে রাসয়নিক সারের ব্যবহার কমেছে। যারা এ সার ব্যবহার করেছে তাদের ফলনও বৃদ্ধি পেয়েছে। সিভিল সার্জন ডাঃ অরুন চন্দ্র মন্ডল বলেন, রান্নার জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস ব্যবহারের ফলে মা ও শিশু অনেক রোগ থেকে রক্ষা পায়। বায়োগ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে মা ও শিশু মৃত্যুহার কমবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ রেজাউল করিম বলেন, বায়োগ্যাস ব্যবহারের ফলে জ্বালানি হিসেবে বৃক্ষের নিধন কমবে। পরিবেশ নিরাপদ থাকে। পশুর বর্জ্যরে সঠিক ব্যবহার হয়। সরকারী উদ্যোগে ব্যাপকভাবে এবং বায়োগ্যাস প্লান্ট করতে পারলে আর্থিক ও পরিবেশগত দুই দিক থেকেই মানুষ লাভবান হবে। এছাড়াও কমিউনিটি বেজড বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করে পারিবারিক অবশিষ্ট বর্জ্য ব্যবহার করা যায়।
×