ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসেনজিৎ হালদার

বিসিএস এবং অতঃপর

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

বিসিএস এবং অতঃপর

বিসিএস ভাবনায় আজ দেশে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতী। উচ্চকাক্সক্ষাও নিদারুণ তাদের পেছনে ছোটে। পদের সংখ্যা অতীব সামান্য, মানে নগণ্য। এত বিপুল পরিমাণ অভিলাষী চিন্তা শুধু বিসিএসকে ঘিরেই। দিন যায় অভিজ্ঞতা বাড়ে, বাড়ে মেধা। ছেলেমেয়েগুলো এদিক-সেদিক বাদ দিয়ে দিন-রাত লেখাপড়ায় ডুব দেয়। তাদের ভবিষ্যত আটকে থাকে যেন বিসিএসকে ঘিরে। নিজের জীবন, সন্তানের জীবন, পাশাপাশি তাদের সন্তানের জীবনও তাকিয়ে থাকে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে। তাই তো অনেকের কাছেই বিসিএস মানে সোনার হরিণ। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এরা প্রতিনিয়ত স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী দিয়ে চলেছে। এর মাধ্যমে প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করছে। কিন্তু এরপর তারা তাদের আশানুরূপ কর্মসংস্থানটি খুঁজে পাচ্ছে না। যেমন মনে করুন, একজন সাহিত্যের শিক্ষার্থী কাজ করছে ব্যাংকের হয়ে। অন্যদিকে, ব্যবসায়-বাণিজ্যের কোন ছাত্র-ছাত্রী হয়ত হিসাব-নিকাশের বাইরেই তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে নিচ্ছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়ত নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করছে। যাদের এ সুযোগ নেই তারা যে কোন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজের অথবা চাকরির সন্ধানে আছে। পর্যায়ক্রমে খুব অল্প পরিমাণ শিক্ষার্থীই স্বস্তি লাভ করে ব্যবসা অথবা চাকরি ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গটা যেহেতু বিসিএসকে ঘিরে তাই এ বিষয়েই বলা যেতে পারে দিন দিন বেড়েই চলেছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) চাকরির প্রতিযোগিতা। মূলত সরকারী অফিস-আদালতের বিভিন্ন চাকরিই শিক্ষিত সমাজ কামনা করে। কারণ সেখান থেকেই ভবিষ্যত কিছুটা হলেও দেখা সম্ভব হয়। দেশে যত দুর্যোগ-দুর্ভোগ, হাহাকার লেগে থাকুক না কেন, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই যেহেতু দেশ পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে তাদের দুর্যোগ-দুর্ভোগে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ব্যতিক্রম যে হয় না তাও নয়। অনেকেই অনেক উচ্চ বা ভাল মানের সরকারী অথবা বেসরকারী চাকরি করেও মনে করে আরও ভাল কিছু করা দরকার। এমনও অনেককেই পাওয়া যায় যিনি মূলত আরও ভাল কর্মসংস্থান প্রাপ্তির যোগ্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যোগ্য সঠিক মেধাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রী কিংবা ব্যক্তি তার যোগ্য কাজের জায়গাতে পৌঁছাতে পারে না। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও অনেকেই সে ধাপ পার হয়ে উচ্চ পদে আসীন হয়। কিন্তু সে সংখ্যা খুবই সামান্য, যা গণনার বাইরে। বিভিন্ন দুর্নীতির বেড়াজাল ছিঁড়ে অনেকে উপরে উঠে গেলেও যারা পিছনে পড়ে থাকে তাদের বিমর্ষ হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। সময়-সুযোগ অনেকে ঠিকমতো কাজেও লাগাতে পারে না। যার কারণে চাকরি বা কর্মসংস্থান না পেয়ে হতাশায় ডুবে যায় অনেকেই। অসীম অভাব, সীমিত সম্পদ। এর ব্যতিক্রম হওয়াও অসম্ভব। প্রথম শ্রেণীর একটি চাকরি করে আপনি প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হতে পারবেন অনায়াসে। অনেকটা ক্ষমতা হাতে নিয়ে চলতে পারবেন। কিন্তু আপনার জন্য যা বরাদ্দ আছে তা অতি অল্পই বটে। আপনার অভাব তবুও পূর্ণ হচ্ছে না। অর্থ-সম্পত্তির ওপর ঝোঁক নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কারণ খেয়ে-পরে বাঁচতে গেলেও অর্থের প্রয়োজন। মৌলিক চাহিদাগুলো ঠিকমতো পূরণ করতে গেলেও দেখবেন সেখানেও থেকে যায় অনেক ঘাটতি। শিক্ষাই যে আলোকিত মানুষ গঠনের অপরিহার্য উপাদান একথা সর্বজনবিদিত। সমগ্র জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে গিয়ে। তারপর যদি শিক্ষার সঙ্গে পেশার বা কর্মসংস্থানের যোগসূত্র না থাকে তবে অনেকেই তার জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের যে শিক্ষাগুলো রয়েছে তা একজন মানুষকে শিক্ষা দিয়ে বিদ্বান করতে কতখানি সহায়ক তা ভাবনার বিষয় বটে। শিক্ষা-বিদ্যা মানে যেখানে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সেখানে শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই বিদ্বান ব্যক্তির সংখ্যাও সামান্যই হয়। দেশের প্রথম সারির আমলা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগসহ সকল ওপর শ্রেণীর কর্মীদের উচ্চশিক্ষার আলোকেই তাদের যোগ্য আসনে বসানো হয়। যদি সে বিষয়ে তাদের শিক্ষার ঘাটতি থেকে যায় তবে তারাও অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে থেকে যায় অজ্ঞ। এমন বহু কর্মকর্তা বা কর্মচারীই পাওয়া যাবে যারা অনেক ছোট সমস্যা বা বিপদেও দুর্বল হয়ে পড়ে। আজ সমাজে হয়ত উচ্চশিক্ষিতের অভাব নেই। তবুও বলতে ইচ্ছে করে, লোক দেখানো শিক্ষা যেখানে মুখ চাড়া দিয়ে ওঠে, সেখানে শিক্ষার প্রকৃত মূল্য বা মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। সকল প্রকার সরকারী নিয়োগের ক্ষেত্রেই এদেশে কোটার প্রাধান্য বিদ্যমান। সেখানেও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যায় শুধু ৪৫ শতাংশ মেধাবীকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যেখানে বাকি সব শূন্যপদই দেয়া হয় কোটার ভিত্তিতে। এখানেই শেষ নয়। যে নিয়োগ কার্যক্রম মাত্র দুই মাসে করা সম্ভব, তা দীর্ঘায়িত হতে হতে সময় লেগে যায় ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত। পরীক্ষা পদ্ধতি অর্থাৎ নিয়োগের জন্য যে ধারা অনুসরণ করে সরকারী কর্মকমিশন তাও সময় সাপেক্ষ। নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা সমাপ্ত করার পর ফল প্রকাশ থেকে শুরু করে নিয়োগ পর্যন্ত যে দীর্ঘ সময় পার করতে হয় তা ভেবেই চিন্তিত হয়ে পড়ে বিসিএসের যোগ্য মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা। অনেকেই চিন্তা করে পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে। আর এভাবে গত হতে থাকে অনেক মেধাবীর শিক্ষাজীবন এবং যৌবনের মহান দিনগুলো। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরী। না হলে এদের স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হতে বাধ্য। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×