ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা জব্বার

একুশ শতক ॥ মানববোমা বুকে বেঁধে আছি

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

একুশ শতক ॥ মানববোমা বুকে বেঁধে আছি

বহুদিন যাবতই আমি এই কথাগুলো বলে আসছি যে, দেশের শিক্ষিত মানুষদের বেকারত্ব একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা যদি এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সহসা জরুরী পদক্ষেপ না গ্রহণ করি তবে আমাদের বুকে বাধা এই মানববোমা বিস্ফোরিত হয়ে পুরো দেশটাকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। বিষয়টি আমাদের নীতি নির্ধারকদের তেমনভাবে ভাবিত করছে এমনটি মনে হয় না। মিডিয়ায় আমরা লাখ লাখ বেকারের খবর পড়ি। একটি চাকরির জন্য শত শত আবেদন পড়ে সেটিও দেখি। চাকরির জন্য প্রতিদিন শত শত অনুরোধ, সুপারিশ ইত্যাদিও এখন গা সওয়া। তেমন একটি অবস্থাতেই আমার এই ভাবনার বাস্তব প্রকাশ দেখলাম ৫ অক্টোবর ১৭ যশোরে। ৫ অক্টোবর ১৭ যশোরের শংকরপুরে স্থাপিত দেশের প্রথম ও একমাত্র পূর্ণাঙ্গ এসটিপি শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে চাকরি মেলার আয়োজন করা হয়। ঢাকা থেকে ৩০টি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। সেই পার্কেরই একটি প্রতিষ্ঠানও তাতে অংশ নেয়। পার্কের দোতলায় স্টল সাজিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাতকার নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই চাকরি দেবার আয়োজন ছিল সেটি। আয়োজনটি কার্যত ভ-ুল হয়ে যায়। কোন চাকরিদাতা প্রার্থীদের সাক্ষাতকার নিতে পারেনি। কোন চাকরিপ্রার্থী সাক্ষাতকার দিতে পারেনি। চাকরি প্রার্থীরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে, পুলিশকে লাঠিচার্জ করে তাদেরকে সরাতে হয়েছে। পার্কের উন্মুক্ত সকল জায়গা চাকরির আবেদনকারীরা দখল করে ফেলেছিল। যশোর থেকে ফিরে এসে জানা গেল যে ওখানে ৩০ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছিল। যা ঘটেছে তার সকল স্তরের ছবিই আমি তুলেছি বা সংগ্রহ করেছি। তবে সবার ওপরে আছে সেদিন জমা দেয়া চাকরি প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্তের স্তূপ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, হাইটেক পার্কের সভা, সেমিনার সবই আমি ছবিতে উঠে এসেছে ফেসবুক ভরে গেছে এসব ছবিতে। অনেক মিডিয়ায় খবরও হয়েছে। তখনই দেখলাম বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর এই বিষয়ে ছোট অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফাহিমের স্ট্যাটাসটা আমাকে ট্যাগ করা। তাই সেটি সরাসরি কেউ পড়তে পারেন। আমার এই নিবন্ধের পাঠকদের জন্য সেটি আমি এখানে উদ্ধৃত করছি। ফাহিম লিখেছে : ‘ফেসবুকে যশোরে অনুষ্ঠিত চাকরি মেলার ছবি দেখছিলাম দেশে শিক্ষিত বেকার সমস্যা যে কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে, এটির একটি খন্ড চিত্র এটি গত কয়েক বছর ধরে বলে আসছি আমরা আসলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা নেবার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারছি না- আসলে আমরা ধাবিত হচ্ছি ভয়াবহ এক ডেমোগ্রাফিক ডিসাসটার-এর দিকে। হতাশাগ্রস্ত লক্ষ্যহীন কোটি কোটি কর্মহীন তরুণ (লাখ লাখ শিক্ষিত স্কিলহীন বেকার) আমাদের এই সমাজের সবকিছুকে, স্থিতিশীলতাকে, যা কিছু অগ্রযাত্রাকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে যে কোন সময়। এক ভয়ঙ্কর টাইম বোমা হাতে নিয়ে বসে আছি আমরা সবাই। ফাহিমের স্ট্যাটাসে আমি নিচের মন্তব্যটা করেছি। ‘৫ অক্টোবর ১৭ আমি যশোরে ছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী কাগজের খয়েরি খাম হাতে পুলিশের বকা-লাঠি-গুতা খেয়েও দুপুর অবধি কেবল সিভিটা জমা দেবার চেষ্টা করেছে। সেমিনারে মেঝেতে বসে আমাদের বাণী শুনেছে। অনেকেই প্রশ্নও করেছে। এমন অবস্থা এর আগে বাংলাদেশের কোথাও আমি আর কখনও দেখিনি। তখনই মনে প্রশ্ন জেগেছে ওদেরকে দিয়ে আমরা কি করব। যাতে ওদের মন না ভাঙে সেজন্য বলে আসছি দেশের মানচিত্রটা বুকের মাঝে রাখ, সৎ হও, আন্তরিক হও এবং দক্ষতা অর্জন কর। ভেবনা আইটি মানেই কেবল কম্পিউটার বিজ্ঞানের দক্ষতা, কোড লেখা বা প্রোগ্রামিং করা নয়। আইটির সঙ্গে ৪৮০০ রকমের পেশার সম্পর্ক আছে। তার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যাটা অন্যরকম। ওরা তো শিক্ষার্থী নয় যে ওদের পাঠক্রম, পাঠ্য বই, পাঠ্যবিষয়, পাঠদান ইত্যাদি বদলে নতুন দক্ষতা দেয়া যাবে। ওদের একমাত্র ভরসা প্রশিক্ষণ। আমরা তো প্রশিক্ষণ দেবার প্রাণান্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিন্তু তার ফল তো ভাল না। বিশ্বব্যাংকের টাকা, এডিবির ফান্ড বা সরকারের তহবিল কোনটারই তো ফলাফল সন্তোষজনক নয়। বস্তুত ফাহিম যে ডেমোগ্রাফিক ডিজাস্টারের কথা বলেছে সেটি কারও মাথায় ঢুকছে বলে আমি মনে করছি না। আমাদের শিক্ষাবিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সরকারের নীতি নির্ধারক বা রাজনীতিবিদদের কেউ এই ভয়ঙ্কর মানব বোমাটির কথা ভাবছেই না। লাখ লাখ বেকার থেকে ধীরে ধীরে যখন আমরা কোটি কোটি বেকারের সংখ্যায় উঠছি তখন এই বেকাররাই চাকরির জন্য এ তো বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে তারা যা কিছু করে বসতে পারে। এমনও যদি দেখেন যে কোন তরুণী তার নিজের সবই কেবল একটি চাকরি পাবার জন্য দিতে চায় তবে অবাক হবেন না। আবার যদি দেখেন যে কোন বেকার চাকরি না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে তাহলেও অবাক হবেন না। যশোরের ৫ অক্টোবরের চিত্রটি সকলের চোখে আঙুল দিয়ে এক চরম নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেছে। আমি বেসিস এরই পরিচালক এবং মাইক্রোসফট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোনিয়া বশির কবিরের ফেসবুক পাত থেকে এই নবীনদের জন্য কর্মক্ষেত্র কি হতে পারে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরছি। সোনিয়ার মতে তরুণলা যেসব খাতে তাদের পেশা গড়ে তুলতে যেতে পারে সেগুলো হলো ভারচুয়াল রিয়ালিটি, চিত্র শনাক্তকরণ ও মানচিত্রায়ন, ডিজিটাল নিরাপত্তা, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর, ড্রোন, স্মার্ট বাড়িঘর ও কল কারখানা, ইন্টারনেট অব থিংস, ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ভবিষ্যতের চাকরি সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, It is clear from our data that while forecasts vary by industry and region, momentous change is underway and that, ultimately, it is our actions today that will determine whether that change mainly results in massive displacement of workers or the emergence of new opportunities. Without urgent and targeted action today to manage the near-term transition and build a workforce with future proof skills, governments will have to cope with ever-growing unemployment and inequality, and businesses with a shrinking consumer base. Our dataset aims to bring specificity to the debate and to the options for action, by providing the perspective of Chief Human Resources Officers of leading employers who are among those at the frontline of the emerging trends and are key actors in implementing future workforce strategies. (http://reports.weforum.org/future-of-jobs-2016/employment-trends/) খুব সঙ্গত কারণেই আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারি যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সর্বোচ্চ প্রত্যয়ন পত্র নিয়েও ডিজিটাল যুগের দক্ষতা অর্জন করা যায় না। এমনকি কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীরাও ডিজিটাল যুগের জ্ঞান অর্জন করে না। পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সূত্র ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসা দরকার ছিল সেটি না আসার ফলে সার্টিফিকেট হাতে চাকরির আবেদন পত্র নিয়ে ঘোরার মানুষের সংখ্যা শিক্ষার হারের পাশাপাশি বাড়ছে। সেজন্য বেকারের বিদ্যমান স্রোত ঠেকাতে এদের দক্ষতা তৈরির পরিকল্পিত ও সমন্বিত আয়োজন করতে হবে। ভবিষ্যতের বেকারের স্রোত ঠেকাতে বদলাতে হবে শিক্ষার সবকিছু। উচ্চশিক্ষার দিকে জরুরী নজর দিতে হবে এজন্য যে তারা পেশার জন্য তৈরি হবার পথেই থাকে। যদি শিক্ষার শেষ ধাপেও কোন দক্ষতা সে না পায় তবে তার হাতাশার সূচনা হবে। তবে নজরটা বেশ ভালভাবে দিতে হবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরেও। আমাদের এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দিকে। এই বেকার তৈরির কারখানাটি যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অব্যাহত থাকে তবে আগামী দিনগুলোতে বেকারের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বাড়বে। তখন কি কাজে লাগবে আমার মানবসম্পদ? যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলা দরকার সেটি হলো এখন আমরা যদি এটি ভাবি যে ছেলেমেয়েদের কেবল কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেব বা এদেরকে কম্পিউটার শেখাব তবে হিসাবটাতে বড় ভুল হবে। এখন সময়টা প্রচলিত কম্পিউটার যুগের নয়। এটি এমনকি কেবল ইন্টারনেটের যুগও নয়। এখন যাদেরকে আমরা তৈরি করতে চাই তারা হোক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ। সৃজনশীল মানবগোষ্ঠী যারা উদ্ভাবন ও গবেষণায় মনযোগী হবে তেমন প্রজন্ম গড়ে তুলেই ভয়ঙ্কর এই সঙ্কট থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি। আমার নিজের ভয়টা হচ্ছে যে বিষয়টি আমাদের নীতি নির্ধারকদের নজরে পড়বে না। তারা একে তেমন গুরুত্বও দেবেন না। ফলে যশোরে যেমন ৩০ হাজার আবেদন জমা পড়েছে তেমনটা দেশের সব স্থানেই জমা হবে। একটু ভাবুন তো যশোরের হিসাব যদি ৬৪ জেলাতে হয় তবে আমরা বেকারদের কত বড় একটা বোমার ওপর বসে আছি? কেবল ৩০ হাজার কেন ভাবছি আমরা? বস্তুত সেদিন তো যশোর জেলার সকল শিক্ষিত বেকার জমা হয়নি। ৩০ হাজারের বদলে লাখখানেক আবেদন তো যশোরেই থাকতে পারে। আমি অবিলম্বে এই শিক্ষিত বেকারদের জন্য পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ-এর আয়োজন করার অনুরোধ করি এবং তাদেরকে ডিজিটাল যুগের দক্ষতা দেবার দাবি জানাই। আমি নিজে এই অবস্থাটি জানি বলেই সেই ৮৭ সাল থেকেই আমি শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলে আসছি। এটাও বলে আসছি যে শিক্ষার পরিবর্তনটা ওপরে যেভাবেই করুন শিশু শ্রেণী থেকেই শুরু করতে হবে। এজন্য ডিজিটাল শিক্ষার শেকড়টা আমি শিশুশ্রেণী থেকেই শুরু করেছি। এই ভাবনা থেকেই আমি শিশুদেরকে প্রোগ্রামার বানানোর লড়াই শুরু করেছি। আসুন আমরা আমাদের শিশুদের জন্য নিজেদের ভবিষ্যতটাকে উৎসর্গ করি। প্রসঙ্গত যারা যশোরে চাকরি মেলার আয়োজন করেছিলেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই বলে যে তথ্যপ্রযুক্তির আবেদন জমা দেবার জন্য কাগজের দরখাস্ত ও কাগজের খাম নেবার দরকার ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তির চাকরির আবেদন অনলাইনে হতে পারত এবং অনলাইনের জীবনবৃত্তান্ত থেকে বাছাই করে সাক্ষাতকারের জন্য ডাকা যেত। ডিজিটাল যুগে বাস করে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এ্যানালগ পদ্ধতি ব্যবহার করুক সেটি আমরা চাই না।
×