ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নদীকেন্দ্রিক সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

নদীকেন্দ্রিক সম্পর্ক

নদীকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে নদী হচ্ছে বেঁচে থাকার অন্যতম উৎস। কোন একটি দেশ বা অঞ্চলের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা শুধু সেই অঞ্চলকেই নয়, বিশ্ব পরিবেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদসহ প্রায় সবই নদীনির্ভর। সুতরাং নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচতে পারবে না। জনজীবন হয়ে পড়বে বিপর্যস্ত। শুষ্ক ও খরা মৌসুমে নদীর জল শুকিয়ে যায়। আর জলের জন্য হাহাকার তুঙ্গে ওঠে। নদীরও আছে মরণ। এ দেশের বহু নদী মরে গেছে। আরও নদী মৃত্যুর পথে। কত বিশাল বিশাল নদী বেহাল হয়ে এখন খালে পরিণত হয়েছে। নদীকেন্দ্রিক জীবন ও জীবিকা মাঝে-মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তথাপি মানবজীবন মুষড়ে পড়ে না। সব প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত তথা এই উপমহাদেশ নদী দিয়ে সম্পর্কিত। নানা কারণে নদীগুলো এই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে যথেষ্ট পরিমাণে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। জনগণের কল্যাণে নদীকে কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার নদীপথে যোগাযোগ, অর্থনৈতিক কর্মকা- ও সামাজিক সম্পর্ক বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর তার জন্য প্রয়োজন উভয় দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ ও জনগণের মধ্যে নদীকেন্দ্রিক সম্পর্ক নিবিড়তর করা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে চুয়ান্নটি অভিন্ন নদী। নদীগুলো ভারত থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। উজানে ভারতের অংশে নদীগুলোর পানি প্রবাহে গতিরোধ করা হলে কিংবা পানি প্রত্যাহার করে নিলে নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমে যায়। নদী শুকিয়ে যায়, বেশি করে জমে পলি ও জাগে চর। তাতে ব্যাহত হয় চাষাবাদ, বন্ধ হয়ে যায় নৌপরিবহন আর ভূগর্বের পানির স্তর ক্রমেই নেমে যায় নিচে এবং শুরু হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাওয়া যায় সেই মরুকরণ প্রক্রিয়ার পূর্বাভাস। আবার বর্ষাকালে যখন নদীতে থাকা সব বাঁধ খুলে দেয়া হয় তখন বাংলাদেশে শুরু হয় বন্যা। কারণ বর্ষায় যত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে তার পঁচানব্বই শতাংশই আসে উজানে থাকা ভারতীয় অঞ্চল থেকে ঢলের আকারে। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় তখন বন্যা ও জলাবদ্ধতা অবধারিত হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল। তাই অভিন্ন নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উভয় দেশ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে সুফল। এখনও হয়নি তিস্তা চুক্তি। এই অবস্থায় দুটি দেশ এই অঞ্চলের নদী ব্যবস্থাপনা ও নদী সংশ্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে দ্বিতীয় নদী সংলাপের আয়োজন করে ঢাকায়। যে সংলাপে দু’দেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ও বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। পূর্ব হিমালয় পর্বতমালা থেকে সৃষ্টি হওয়া নদী ও বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদীকেন্দ্রিক সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে গত বছর ভারতের শিলংয়ে প্রথম যে নদী সংলাপ হয় তাতে বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার অংশ নেয়। এই সংলাপে নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিধারা অব্যাহত রাখার সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি যৌথভাবে নদী ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের প্রসারসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা- এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। এই বিষয়গুলো যদিও বহুল চর্চিত, কিন্তু অগ্রগতি কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। বরং বলা যায়, কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে এবার দুটি দেশ নদীর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এতদিন নদীপথ বাদ দিয়ে সড়কপথে বিনিয়োগ হয়েছে বেশি। নদীভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা ও বাণিজ্য বাড়ানো দু’দেশের জন্যই সহায়ক। যৌথভাবে নদী উন্নয়নে কাজ করা না হলে এই অঞ্চলের জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবেই। পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা বন্ধ হওয়া জরুরী। নদীর গতিকে রোধ করলে নদীই মরে যায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য দু’দেশকেই নজর দিতে হবে নদী ব্যবস্থাপনায়। এই অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে জনগণের সংযোগ স্থাপন এবং বাণিজ্য ও পর্যটন খাতের সম্ভাবনাকে কার্যকর করা জরুরী। দু’দেশের সরকার যদি যৌথভাবে কাজ করে তবে অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ যথাযথ রূপ পাবে। কোন দেশই হবে না ক্ষতির সম্মুখীন। বাংলাদেশ চায় নদীভিত্তিক যে জট রয়েছে ভারতের সঙ্গে তা দূরীকরণ করা দু’দেশেরই স্বার্থে।
×