ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজস্ব আয়ে ধস

টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে। টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও স্বল্প পরিসরে চলছে টেকনাফ-আকিয়াব আমদানি পণ্য আনয়নের কাজ। রাখাইনে সন্ত্রাসী হামলা ঘটনার পরদিন থেকে মংডু শহর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যেও কোন পণ্য বোঝাই জাহাজ আসেনি। ব্যবসায়ীদের টেকনাফ বন্দরে মাল আনতে দিচ্ছে না মংডু টাউনশিপের কর্তৃপক্ষ। আমদানি-রফতানিকারকদের মিয়ানমারে যাতায়াতও বন্ধ রয়েছে। তবে আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে যৎসামান্য পণ্য আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রফতানি বাণিজ্যের চিত্র আরও শোচনীয়। মিয়ানমারের মংডু কর্তৃপক্ষ একতরফা ও অঘোষিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রাখায় রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে বলে জানা গেছে। টেকনাফ স্থল বন্দর কাস্টমস সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আগে যেখানে প্রতিমাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পরও কয়েক কোটি টাকা বেশি আয় হতো, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি। টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশিপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে এখনও আটকা পড়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যের এই পয়েন্টটি ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’ নামে পরিচিত এবং পরিচালিত। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ ও মংডু টাউনশিপে পৃথক আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য। সেই থেকে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড।’ তাছাড়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। বাংলাদেশ সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোপরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সংযম, ধর্য, কৌশল, দক্ষতা প্রদর্শনপূর্বক পরিস্থিতি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন। যা পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে সহিংস ঘটনায় বাংলাদেশের পক্ষে কোন প্রকার বিধিনিষেধ আরোপ করা না হলেও মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক শহর মংডু অঘোষিত ও একতরফাভাবে টেকনাফ স্থলবন্দরের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। এতে টেকনাফ স্থলবন্দর ব্যবহারকারী আমদানি-রফতানিকারক, সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট, শত শত শ্রমিক আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রতি দিন মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, টেকনাফ স্থলবন্দরে আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য নেই। কিছু ভুসাপণ্য ও কাঠ আসছে মংডুর বাইরে থেকে। বন্দরের বহির্নোঙ্গরে জাহাজ জট নেই। নেই শ্রমিকদের কোলাহল। রাজস্ব আয়সহ আমদানি-রফতানির কাহিল অবস্থা। কাস্টমস সূত্র জানায়, আগে প্রতি মাসে প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি-রফতানি হতো। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে ১৪১টি বিল অব এ্যান্ট্রির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৪৭ লাখ ২২ হাজার ৬৬২ টাকা মূল্যের পণ্য। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬৭ লাখ ১৬১ টাকা। সেপ্টেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৯ টাকা কম আয় হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যের চিত্র আরও শোচনীয়। আগে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের শতাধিক চালানে বিভিন্ন প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মংডু টাউনশিপে রফতানি হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৬টি চালানে ৩৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকা মূল্যের ৭ প্রকারের বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য রফতানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৪টি চালানে ২৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৩ টাকা মূল্যের ৪৪.৪৮ মেট্রিক টন গেঞ্জি, ৩টি চালানে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০ টাকা মূল্যের ১.৯২ মেট্রিক টন মানুষের চুল, ৩টি চালানে ৯ হাজার ৮১০ টাকা মূল্যের .০৮ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ, ২টি চালানে ৭ লাখ ৩ হাজার ৫০ টাকা মূল্যের ৫.৯ মেট্রিক টন ফাইস্যা মাছ, ১টি চালানে ৩০ হাজার ৬৫৬ টাকা মূল্যের ০.৭৫ মেট্রিক টন চিপস, ২টি চালানে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৫ টাকা মূল্যের ০.৮২৫ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, ১টি চালানে ৬১ হাজার ৫৫৮ টাকা মূল্যের ১.৫ মেট্রিক টন জুট ব্যাগ। এদিকে টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশিপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আটকা পড়েছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে এরা ভয়ে গত এক মাসেরও অধিক কাল ধরে স্বদেশে ফিরতে পারছেন না বলে জানা গেছে। মিয়ানমার নাগরিক ৪৪ জনের মধ্যে ৪৩ জনই রোহিঙ্গা এবং ১ জন অমুসলিম হিন্দু। এরা সকলের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু টাউনশিপের নোয়াপাড়া, উকিলপাড়া, নাপিতের ডেইল, সুধাপাড়া, খাঁরিপাড়া, ফয়েজীপাড়া, মন্নিপাড়া এবং ২ সহোদর বাড়ি বলিবাজার গ্রামে। আটকেপড়া রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লারা জানান, এরা খায়দায়, বন্দর এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, রাতে তাদের কার্গো ট্রলারে ঘুমায়। আটকেপড়া মিয়ানমার নাগরিক মংডু টাউনশিপের নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত আমির হামজার পুত্র জামাল হোছন মাঝি (৬০) বলেন, আমরা ২৪ আগস্ট সীমান্ত বাণিজ্যের আওতায় মিয়ানমারের মংডু থেকে ১৩টি কার্গো ট্রলারে মালামাল বোঝাই করে ৪৪ জন মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আসি। মালামাল খালাস করে ২৫ আগস্ট মংডুতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। বাণিজ্যের মালামালও যথাসময়ে খালাস হয়েছিল। কিন্তু রাতে সহিংস ঘটনার কারণে ভয়ে দেশে ফিরে যাইনি। আমরা ঈদ উদযাপন করেছি এখানে। যাদের কাছে সীমান্ত বাণিজ্যের মালামাল এনেছিলাম, তারা আমাদের রসদপাতি দিচ্ছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস এবং টেকনাফের ব্যবসায়ীরা আমাদের যথেষ্ট দেখাশোনা ও খোঁজখবর রাখছেন। মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কয়েক জনের পরিবার-পরিজন পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে বাংলাদেশে। তিনি আরও বলেন, আমরা সাধারণ মাঝি-মাল্লা। আমরা যাদের মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম তারা মংডু টাউনশিপের বড় বড় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে রোহিঙ্গা এবং রাখাইন উভয়ে রয়েছেন। তারা মংডু এলাকার ধনী লোক। তারা আমাদের মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন বিষয়টি লিখিতভাবে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনও রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট আসলে এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে স্বদেশে ফিরে যাব।
×