ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনিন্দ্য সুন্দর নাম শুনলে জিভে জল আসে, দেহে জাগে শিহরণ...

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

অনিন্দ্য সুন্দর নাম শুনলে জিভে জল আসে, দেহে জাগে শিহরণ...

সমুদ্র হক কামরাঙ্গা। নামটি শুনলেই রিপুর এক ধরনের শিহরণ জাগে। ‘এইটটিন প্লাস’ মনে হয়। বাংলা শব্দ কামরাঙ্গার ইংরেজী অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘কালার অব সেক্স’। কোন এককালে আন্দামান নিকবর দ্বীপে এক গাছে সুস্বাদের এক টক ফল ধরেছিল। পরে সেই ফল দক্ষিণ এশিয়ায় রাজত্ব করে যাচ্ছে তিন ভাবে। কখনও ফল, কখনও সবজি হয়ে। এর ফুল দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর হওয়ায় বর্তমানে ফুল হয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। কেউ নিজের বাড়িকে সৌন্দর্যবর্ধক করতে কামরাঙ্গার বৃক্ষরোপণ করছে। শরত শেষে হেমন্ত শুরুর এই সময়টায় কামরাঙ্গার বৃক্ষ হালকা গোলাপী রঙের থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে গেছে। সুন্দর মজার এই বাংলা নাম কে যে দিয়েছিল! এমন প্রশ্নে উত্তর আপনা আপনি চলে আসে। যৌবন তারুণ্যের কোন একজন রাঙা মনের মাধুরী মিশিয়েই এই নাম বানিয়েছেন, কামরাঙ্গা। গ্রামে অনেকেই এই নামে বিপর্যয় ঘটিয়ে অপভ্রমাংশ করে বলে কারেঙ্গা। তাই বলে ভিনদেশী ভাষার প্রবাদের ‘হাম কারেঙ্গা তেন করেঙ্গা’র মতো কিছু নয়। কোন ভাবে কামরাঙ্গার ‘ম’ উধাও হয়ে নামের এ অবস্থা। এই কামরাঙ্গার ফুল এখন পুষ্পপ্রেমিক ও সৌন্দর্যপিপাসুদের হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছে। কারও হৃদয় হরণও করেছে। প্রজন্মের কাছে এই সুন্দর ফুল আকর্ষণ করেছে। অচেনা এই ফুল তাদের চেনা হয়েছে। কেউ প্রেমিকার খোঁপায় গোলাপ ও গাঁদা ফুলের বদলে কামরাঙ্গার ফুল গুঁজিয়ে দিচ্ছে। ফলের নামেই ফুলের নাম। অনেক নগরী ও শহরের ফুলের দোকানগুলোতে হালে কামরাঙ্গার ফুল দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভয় একটাই- এত ফুল ছেঁড়া হলে না জানি ফলের কোন বিপর্যয় ঘটে। যে বাড়িতে কামরাঙ্গার গাছ আছে তারা অবশ্য সহজে গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ে না। ঝাউবনের গাছ থেকেই ফুল ছেঁড়া হচ্ছে বেশি। কামরাঙ্গার বৃক্ষ সাধারণত ৫ থেকে ৭ মিটার উচ্চতার। বৃক্ষের প্রতিটি শাখায় হালকা গোলাপী রঙের ছোট থোকা থোকা ফুল ধরে। চমৎকার ফুলগুলো রোদে চকচক করে ওঠে। বৃক্ষকে বলা হয় এভারগ্রিন ট্রি। পাতাগুলো সবুজ। তবে ফল ধরার পর্যায়ে কফির রঙের হয়ে থাকে। এই পাতা দেখতেও আকর্ষণীয়। সুন্দর পাতাগুলোর মধ্যেই শাখা প্রশাখায় ফুল ফোটে। দেখে মনে হবে এটি শুধু ফুলেরই গাছ। দিনে দিনে ফুল থেকে কলি বের হয়ে ছোট থেকে বড় কামরাঙ্গায় পরিণত হয়। আর কিছুদিন পরই গাছে কামরাঙ্গা ধরবে। কামরাঙ্গা কাঁচা থাকলে অনেকটা সবুজ। পেকে গেলে হলদেটে বরণ। এই ফলের ইংরেজী নাম ‘স্টার ফ্রুট’ বা তারকা ফল। কামরাঙ্গা ফল ত্রিকোনা খাঁজকাটা। অনেকটা তারকার মতো। ৫ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। কাঁচা পাকা যেভাবেই কামরাঙ্গাকে দেখা হোক জিভে (জিহ্বা) জল আসবেই। পুষ্টি ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই কামরাঙ্গা নানাভাবে খাওয়া যায়। কখনও কামড় দিয়ে, কখনও আমের মতো চুষে কখনও ঝাল লবণ দিয়ে মেখে। তরকারি হিসাবেও কামরাঙ্গা অনন্য স্বাদের। সাধারণ চর্চরি হোক আর ছোট মাছ দিয়ে রান্নাই হোক কামরাঙ্গার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেউ পারে না। এর ইংরেজী নাম ‘ক্যারামবোলা’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘এ্যাভেরহোয়া’। কামরাঙ্গা আন্দামান নিকবর থেকে এসেছে তবে এর আদি উৎপত্তি মালাক্কায়। ভারত জাপানসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কামরাঙ্গা অনেক জনপ্রিয়। ভারতের তামিলনাড়– ও কর্নাটক রাজ্যে সামাজিক আচার আচরণে কামরাঙ্গা বড় ভূমিকা পালন করে। কথিত আছে, ওই রাজ্যের বিয়ের অনুষ্ঠানে অগ্নি সাক্ষী করে সাত পাঁকে বাঁধার পর বর কনে এক কামরাঙ্গা ভাগাভাগি করে খায়। অতিথিদের খাদ্য তালিকায় যে প্রকারেই হোক কামরাঙ্গা থাকবেই। জাপানে কামরাঙ্গার ফুল ও ফলের কদর আকাশ ছোঁয়া। এমনও দেখা গেছে এই দেশে জাপানী পর্যটকরা এসে করলাকে কামরাঙ্গা ভেবে কাঁচা খেয়েছে। খাওয়ার পর কামরাঙ্গার টক মিষ্টি স্বাদের বদলে কি স্বাদ পেয়েছে তা বুঝে নিন। দেশে কামরাঙ্গার উৎপাদন এলাকা উত্তরাঞ্চলসহ গাজীপুর ময়মনসিংহ ঢাকা নরসিংদী টাঙ্গাইল সিলেট পার্বত্য চট্টগ্রাম। বেশ কিছুদিন হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) দুই জাতের এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তিন জাতের কামরাঙ্গা উদ্ভাবন করায় দেশের সব জায়গাতেই উদ্ভাবিত পাঁচ জাতের কামরাঙ্গা ফলছে। যত জাতেরই কামরাঙ্গা হোক ফুল একই রকমের। কামরাঙ্গার গাছ যত বাড়ছে ফুলও ততই বাড়ছে। গাছের শাখা প্রশাখা এমন কি কা-ের কাছেও থোকায় থোকায় যেমন ফুল ফোটে, তেমনই কামরাঙ্গা ফলে। অনেক গাছের ছোট অবস্থাতেই কামরাঙ্গার ফুল ফোটে। আগে কামরাঙ্গার বাণিজ্যিক চাষ হতো না। গৃহস্থ বাড়িতে আম জাম কাঁঠাল বড়ইয়ের পাশাপাশি শখে কামরাঙ্গার গাছ লাগাতেন কেউ কেউ। বড়ই পাকলে যেমন দামাল ও দুষ্টু ছেলেরা ঢিল ছুড়ে, কামারাঙার গাছও রেহাই পায় না। কিশোররা ঢিল ছুড়ে ফল হিসেবে খাওয়ার জন্য। এখন কিশোর তরুণরা শাখা মৃগের মতো গাছে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে ফুল ছিঁড়ছে গাছে উঠে। কিষান ও গৃহস্থ বাড়ির বৌ গাছ থেকে কামরাঙ্গা তোলে সবজি হিসেবে রান্নার জন্য।
×