ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আ. ফ. ম. মোদাচ্ছের আলী

জাতির পিতার স্বপ্নের দার্শনিক

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

জাতির পিতার স্বপ্নের দার্শনিক

আঠারো অক্টোবর ১৯৬৪। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন। তাঁর জন্ম শেষ রাতে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও নৃশংসতম হত্যাকান্ডটিও ঘটেছিল শেষ রাতে। যে হত্যাকান্ডের নির্মম বলি পরিবারের শেষ বংশধর শেখ রাসেল। ছোটবেলায় রাসেল তার বন্ধুদের নিয়ে সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলা ইত্যাদিতে মেতে থাকত। এই নির্মম হত্যাকান্ডের কয়েকদিন আগে হাসু আপুর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সঙ্গে রাসেলের জার্মানি যাওয়ার কথা ছিল। জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ায় তার যাওয়া হয়নি। যদি সেটি হতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশ তাকে হারাত না। ঘাতকের নির্মম বুলেট বক্ষ বিদীর্ণ করত না। বাবা তাঁর প্রিয় মানুষ দার্শনিক ব্রার্টান্ড রাসেলের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল। কিন্তু ঘাতকের পৈশাচিকতায় শিশু রাসেল বড় হয়ে দার্শনিক না হোক অন্য আরও বড় কিছু হওয়ার সুযোগ পায়নি। ধানম-ির ৩২নং সড়কের বাড়িতে রাসেল ম্যাচ বক্স দিয়ে গাড়ি বানিয়ে খেলত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আগস্টের শোকাহত দিনটি ছিল শুক্রবার। ঢাকা শহরে ছিল কারফিউ। জুম্মার নামাজের জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে রাসেলের ছোট্ট বন্ধুরা জুম্মার পর ৩২নং সড়কে আগের রাতের নির্মমতার খবর বাবা-মার কাছে শুনে অভিভাবকের সঙ্গে ধানমন্ডির ৩২নং সড়কের কাছে যায়। বাড়ির গেট পর্যন্ত যাওয়ার কোন সুযোগ হয়নি তাদের। কচি মুখগুলোর চোখ ছিল ভয়ার্ত, উদ্বিগ্ন। রাসেলের বাবা আমাদের জাতির পিতা। যাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে পাকিস্তানের কারাগারে। কারণ, তিনি দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। পাকিস্তানীরা সেটি সহ্য করতে না পেরে নানাভাবে নির্যাতন করত। তাই বাবাকে খুব কাছে পায়নি ছেলেটি। বড় ভাইয়েরা-আপারা সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। রাসেল শুধু মাকে কাছে পেত। বাবাকে কাছে পেলে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেত। এক মুহূর্ত বাবার কাছ ছাড়া হতে চাইত না। কারণ রাসেলকে বার বার বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। রাসেলের বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর বাবা জেলে যান। জেল থেকে বের হয়ে ৬ দফা তিনি জাতির সামনে উপস্থাপন করেন। যা ছিল বাঙালীর মুক্তির সনদ। জেলখানায় বাবার সঙ্গে রাসেল দেখা করতে যেত। বাবাকে সে ফেলে আসতে চাইত না। বাবা তাকে বোঝাতেন তুমি মার সঙ্গে তোমার বাসায় যাও। অবুঝ শিশুর কচিমনও অনেক কথা বোঝে। বলতে পারে না। সে কান্না করে। যেতে চায় না। বাসায় ফিরে মাকে বার বার প্রশ্ন করে বাবা ওখানে থাকে কেন? কখন আসবেন বাবা? মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। মা নিজেও কেঁদে ফেলেন। রাসেলের চেহারাটি ছিল মিষ্টি ও মায়াময়। সাইকেল চালাতে ভীষণ পছন্দ করত সে। ক্রিকেটও ভালবাসত। বড় বোন হিসেবে ওর যত আবদার ছিল হাসু আপার কাছে। হাসু আপা তাকে প্রাণ উজাড় করে ভালবাসত। সে চেষ্টা করত বাবার অবর্তমানে ওর বায়না মেটাতে। বাসার সব বড় ভাই আপুরা এই ছোট্ট শিশুটিকে আদর করে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবাকে রাসেল খুব বেশি কাছে পেত না। যতটুকু পেত বাবার কাছে কাছেই থাকত। কারণ, বাবা তখন দেশ গঠনে নিয়োজিত। বঙ্গবন্ধু তখন একদিকে দেশ গড়া অন্যদিকে দেশী-বিদেশী শত্রুদের ষড়যন্ত্র সামাল দিচ্ছেন। এলো সেই ভয়ঙ্কর কালরাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাসার সবার মতো রাসেলও মায়ের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধ্যরাতে কিছু দানব, পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনীর এদেশীয় কিছু সহচর ঢাকার ধানম-ির ৩২নং সড়কের বাড়িটি ঘিরে ফেলল। গুলির বিভৎস শব্দ ও বারুদের আগুনে রাতের নিংশব্দ আকাশ লাল হয়ে গেল। ঘাতকরা একে একে হত্যা করল বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সবাইকে। এই বিভৎসতায় ভয়ে কচিশিশুটি দানবদের কাছে করুণ আর্তিতে বলে উঠল ‘আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো।’ তখন এক দানব বলে উঠল ‘তোকে তোর মায়ের কাছেই পাঠাব’ বলেই বুলেট দিয়ে কচি বুকটা ঝাঁঝরা করে দিল। আমাদের রাসেল, জাতির পিতার স্বপ্নের দার্শনিক রাসেল, পৃথিবীর আলো ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো। পৃথিবীর ইতিহাসের বিভৎসতম পৈশাচিক হত্যার শিকার হলো একটি শিশু। কিন্তু তারা পারেনি, রাসেল বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে। অনন্তকাল। এই তো আমরা লিখছি। আমাদের মাঝেই আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখব। রাসেল মরেনি। তাই ১৮ অক্টোবর জন্মদিনের শুভক্ষণে বলি- ‘যে ফুল ধরণীতে/ঝরে গেছে অজানিতে/সে রাসেল স্মরণে/বেঁচে আছে মরণে।’
×