ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তা ও অধিকার;###;আদায়ের নামে গড়ে ওঠা ৪শ’ শ্রমিক ইউনিয়নের ৫৫শীর্ষনেতা শ্রমিক নন ॥ হুমকির মুখে গার্মেন্টস খাত

পোশাক শিল্পের গলারকাঁটা শত শতট্রেড ইউনিয়ন!

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১৪ অক্টোবর ২০১৭

পোশাক শিল্পের গলারকাঁটা শত শতট্রেড ইউনিয়ন!

রহিম শেখ ॥ পোশাক শিল্পে গলার কাঁটায় পরিণত হচ্ছে নামে-বেনামে শত শত ‘ট্রেড ইউনিয়ন’। নিরাপত্তা ও অধিকার আদায়ের নামে শ্রমিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা হলেও এখন সুবিধা আদায়ে বেশি ব্যস্ত ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা। হঠাৎ করেই যেন দ্রুতগতিতে বাড়ছে এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা। এ পর্যন্ত ৪শ’ ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। আরও অন্তত শতাধিক নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এসব শ্রমিক সংগঠনের অনেক নেতা রয়েছেন যারা কখনও কোনদিন কারখানায় কাজ করেননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পোশাক শিল্পশ্রমিক সংগঠনের ৫৬ শীর্ষ নেতার কেউ-ই শ্রমিক নন। এ খাতের সঙ্গে জড়িত শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, নিরাপত্তা ও অধিকারের নামে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হলেও এসব সংগঠনের অপতৎপরতা ও নেতাদের অজ্ঞতায় বন্ধ হয়ে গেছে বহু গার্মেন্টস কারখানা। বড় অঙ্কের লোকসান গুনেছে মালিকপক্ষ। বেকার হয়েছেন শ্রমিক। জানা গেছে, বিশ্বের দ্বিতীয় পোশাক পণ্য রফতানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ এখন এক নম্বর স্থান দখলের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এমন সাহসী উদ্যোগ নিয়ে যখন এগোচ্ছে বাংলাদেশ, তখন শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বিদেশী ক্রেতাদের পরিদর্শনের নামে বন্ধ করা হচ্ছে গার্মেন্টস কারখানা। এ পর্যন্ত এ্যালায়েন্স, এ্যাকর্ড ও আইএলওর সুপারিশে ২০০ কারখানা চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ্যাকর্ডের সুপারিশে ৫৫, এ্যালায়েন্সের সুপারিশে ১৪২টি ও আইএলওর পরামর্শে ৩টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্টস মালিক জানান, কিছু শ্রমিক সংগঠনের নেতারা এই কাজে সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছেন। এতে মালিকদের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকার আদায়ের জন্য দেশব্যাপী ২৩টি জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন গড়ে উঠেছে। প্রতিটি ফেডারেশনের অধীনে সর্বোচ্চ শতাধিক এবং সর্বনি¤œ ২৪টির বেশি শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। বেশির ভাগ শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অশ্রমিকরা। যারা কোনদিন কোন কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেননি। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ, টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, গ্রীনবাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন। এসব সংগঠনের বাইরে এ ধরনের অনেক আরও সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে। জানা গেছে, শ্রমিক সংগঠনগুলো পরিচালন ব্যয়ের একটি অংশ আসে চাঁদার মাধ্যমে। শ্রমিকরা প্রতি মাসে ১০ টাকা হারে চাঁদা দেয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা চাঁদা দেন না। সাধারণ শ্রমিকরা মনে করছেন এসব সংগঠন তাদের অধিকার আদায়ের নামে ভিন্ন কাজ করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। এটি সাধারণ শ্রমিকদের কোন কাজে আসছে না। এ আর্থিক দৈন্য থেকেও নেতারা অনেক সময় রাজনৈতিক দলের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। এসব সংগঠনের নেতাদের আবার কেউ করছেন ওকালতি, কেউ নিয়োজিত ডাক্তারি পেশায়। আবার কেউ করছেন কনসাল্ট্যান্সি। পোশাক শিল্পশ্রমিক হিসেবে জীবনে একটি দিনের জন্যও কখনও কাজ করেননি তারা। তবে এখন তারা তাদের নিজস্ব পেশাগত পরিচয়ের গ-ি পেরিয়ে একজন পোশাক শিল্পশ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। আর এসব অশ্রমিকই নিয়ন্ত্রণ করছেন পোশাক শিল্পশ্রমিক আন্দোলন। পোশাক শিল্পশ্রমিক সংগঠনের ৫৬ শীর্ষ নেতার কেউ-ই শ্রমিক নন। এদের মধ্যে ৪১ শ্রমিক নেতা জীবনে কোনদিনই পোশাক শিল্পশ্রমিক ছিলেন না। অপরদিকে ১৫ নেতা এক সময়ে পোশাক শিল্পশ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এখন তাঁরা কেউ-ই শ্রমিক নন। অথচ এসব নেতা শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্ট ওয়ার্কারের সভাপতি রায় রমেশ চন্দ্র, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ ওয়াজেদুল ইসলাম, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি এ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন, গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির প্রধান সমন্বয়কারী তাসলিমা আক্তার, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু, সংযুক্ত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাবুল- এরা কেউ শ্রমিক ছিলেন না। শ্রমিক না হয়েই এরা শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা বনে গেছেন। এদের মধ্যে মোশারেফা মিশু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। শ্রমিক হিসেবে অভিজ্ঞতা না থাকলেও দীর্ঘদিন তিনি গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছেন। এর আগে তিনি কৃষক আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে রয়েছেন আমিরুল হক আমিন। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ছাত্র। ছাত্রত্ব শেষে তিনি চাকরিতেও ঢুকেছিলেন। শেষ পর্যন্ত চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি এখন পুরোদস্তুর শ্রমিক নেতা। গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করাই তার এখন মূল কাজ। এছাড়া সংযুক্ত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাবুল একজন শ্রমিক নেতা হলেও বাস্তবে তিনি কোন দিন শ্রমিক ছিলেন না। কথা হয় গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদারের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিক না হয়েও শ্রমিক নেতৃত্ব শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বজুড়ে শ্রম আন্দোলনের ইতিহাসে এটাই বাস্তবতা। কারণ মালিকরা তো শ্রমিকদের নেতৃত্বে আসতেই দিতে চান না। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকদের মধ্য থেকেই নেতৃত্বে আসা উচিত। বাইরে কেউ নেতৃত্ব দিলে শ্রমিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুধাবন করতে পারে না। ফলে তাদের নেতৃত্বও সঠিক হয় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জনকণ্ঠকে বলেন, এত ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে কি হবে আমি বুঝি না। আমরা কম্বোডিয়ায় দেখেছি বেশি বেশি ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দেয়ায় সেখানকার গার্মেন্ট সেক্টরে বিপর্যয় নেমে এসেছে। যেভাবে শ্রমিক সংগঠন বাড়ছে তাতে বাংলাদেশেও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিনি বলেন, আমি প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর দেখেছি যেসব গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে চায়। কিন্তু তাদের অনেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন আইন সম্পর্কে জানা নেই। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, শ্রমিক না হলে শ্রমিকের দুঃখ বোঝা যায় না। বরং শ্রমিক স্বার্থের নামে যে আন্দোলন কিংবা কর্মসূচীর ডাক দেন, পরোক্ষভাবে শ্রমিকের দুঃখেরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতাদের টাকার ভাগ-বাটোয়ারার অভিযোগও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়ে। এমন সব অভিযোগে গত জানুয়ারি মাসে ছয় শ্রমিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরা হচ্ছেন- শ্রমিক নেতা ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কারের সভাপতি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায় রমেশ চন্দ্র ও তার স্ত্রী কৃষ্ণা রায়, সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ও তার স্বামী আমিনুল হক, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশারেফা মিশু, জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আমিরুল হক আমিন ও তার স্ত্রী মাজেদা বেগম, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শামীমা নাসরিন এবং বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান।
×