ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি ও প্রত্যাখ্যান

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি ও প্রত্যাখ্যান

সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিতর্ক আর চমক যেন থামছেই না। অপরদিকে নির্বাচকরাও যেন ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছেন চমক জাগিয়ে বিতর্ক উস্কে দেয়ার। ২০১৫-১৬তে পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণার পর ঝড় বয়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে সাহিত্যামোদী মহলে। বিশেষ করে ২০১৬তে ‘সঙ্গীতে কাব্যিক ধারা’ সৃষ্টির জন্য যখন মার্কিন গায়ক-কবি বব ডিলনের নাম ঘোষণা করা হলো। সাহিত্য বিশ্বের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছিল আকাশ নয় দুনিয়া ভেঙ্গে পড়েছেÑ আকাশের মাথায়। সেই জের অব্যাহত ছিল এবারের পুরস্কার ঘোষণার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। দুর্মুখেরা এমনও বলছিলেন এবারও না গানে জীবনের কথা বলার জন্য কোন র‌্যাপ সঙ্গীত রচয়িতাকে সাহিত্যে নোবেল প্রদান করা হয়। না, অতটা সাহসী নির্বাচকরা হতে পারেননি বা হতে চাননি। তবে ২০১৭তে কাজুও ইশিগুরোর নোবেল প্রাপ্তিতে চমক আছে নিশ্চিতভাবেই। বিতর্কও চলবে। সম্ভাব্য পদকজয়ীদের তালিকায় তিনি কোথাও ছিলেন না। বব ডিলনের নোবেল প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি চমকে গিয়েছিলেন বোধকরি ডিলন নিজেই। অতটা না হলেও ইশিগুরোর প্রতিক্রিয়া তাই বলে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে হারুকি মুরাকামি তো এক পা দিয়েই রেখেছেন নোবেল মঞ্চে। এবারও তার সঙ্গে নাম আসছিল ওয়া থিয়োঙ্গো, কাদারে, রুশদীসহ আরও কিছু হেভীওয়েট প্রার্থীর। মুরাকামির ভক্তরা তো ঘোষণার পূর্বে রীতিমতো প্রার্থনা সভার আয়োজন করেছিল যাতে তাদের প্রিয় লেখক এবার পুরস্কারটি পেতে পারেন। তখনই সংবাদ এলো মুরাকামি নন ২০১৭তে সাহিত্যে নোবেল জয়ী জাপানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক কাজুও ইশিগুরো। মুরাকামি ভক্তরা হয়ত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি চমক জাগানিয়া। আর বিতর্ক তো সাহিত্যে নোবেলের নিত্যসঙ্গী। সেটাই স্বাভাবিক। সৃষ্টিশীলতার এই ক্ষেত্রে একেকজন স্রষ্টা নিজ জগতে সম্রাটের মতোই অবস্থান করেন। অসংখ্য ভাষায় প্রতিনিয়ত তাদের সৃষ্টি চমকে দেয় আমাদের। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। আর নির্বাচকদের দশা নিশ্চিতভাবেই ‘কাকে ছেড়ে কাকে রাখি।’ সে অর্থে বলা যায় পৃথিবীতে থ্যাঙ্কলেস জব বল যদি কিছু থাকে তবে তা এই নির্বাচকদের। বিবেচনায় রাখতে হবে এক্ষেত্রে পদক প্রার্থীরা কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতো নিভৃতচারী নন। তারা তারকা, বিশ্বজুড়ে তাদের কোটি ভক্ত। সেকারণে যাকেই নির্বাচন করা হোক না কোন প্রতিদ্বন্দ্বী সমর্থকদের সমালোচনা, তিরস্কার নিশ্চিত। বলাবাহুল্য তারাই সংখ্যায় বেশি। বলছিলাম বিতর্ক সাহিত্যে নোবেলের নিত্যসঙ্গী। কথাটি এভাবেও বলা যায় বিতর্ক তার জন্মসঙ্গী। প্রথম বিজয়ী স্যলি প্রুডহ্যামের নাম ঘোষণার পর থেকেই। কাউন্ট লিয়েভ তলস্তয়ে তখন সৃষ্টির মধ্যগগনে। সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা ছিল প্রথম পুরস্কারটি পেতে যাচ্ছেন তলস্তয়ে। না পাওয়াতে শুরু সমালোচনা। তীব্র প্রতিবাদ ওঠে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। বার্টন ফেল্ডম্যান তো প্রুডহ্যামকে অভিহিত করেন মধ্যমমানের কবি বলে। তিনি আরও বলেন, একাডেমির সদস্যরা ভিক্টোরিয়ান যুগে বাস করছেন। সেই থেকে যারা পেয়েছেন তার চাইতে বেশি আলোচনা হয়েছে যারা পাননি তাদের নিয়ে। তলস্তয়ে বা বার্নাড শ’র মতো দিকপালদের নোবেল বঞ্চনা তো আজও আলোচনার বিষয়। আয়োজকরা কেবল প্রাপ্তির কারণ জানান, অপ্রাপ্তির ব্যাখ্যা নয়। কাজেই না পাওয়ার কারণ জানার পথ রুদ্ধই থেকে যাবে। এবারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক হলেও সান্ত¡নার জায়গা হল; কাজুও ইশিগুরো আপাদমস্তক লেখালেখির জগতে ডুবে থাকা একজন মানুষ। হোক তা গান, চিত্রনাট্য, ছোটগল্প কিংবা উপন্যাস। তার চলার পথ বিশ্লেষণ করলে এটি পরিষ্কার লেখক হওয়া ভিন্ন তার জীবনের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তার ভাবনার জগত লেখালেখিময়, তিনি পেশায় লেখক। লেখালেখিতে তার অর্জনও অবজ্ঞা করার মতো নয়। নোবেল নিশ্চয়ই বড় অর্জন তবে নোবেল না পেলেও ইশিগুরোকে অবহেলা করা যেত না। তার সৃষ্টির সাহিত্যমূল্য কিছুমাত্র কমত না। তারা ধারা ভিন্ন। কিন্তু নিজ জগতে তার অবস্থানও একজন সম্রাটের। তিনি কারও মতো নন, তার মতোও কেউ নন। তিনি কাজুও ইশিগুরো ভিন্ন, স্বতন্ত্র। তাকে বলা যায় নীরব ঘাতক। তার যা বলবার তা তিনি বলেন, কলমের আঁচড়ে নিজের সৃষ্টিকর্মে। অন্যদের তুলনায় তিনি কিছুটা নীরবে বিচরণ করেন। আর তাই সেভাবে আসেননি আলোচনায়। সে প্রয়োজনও পড়েনি তার। নিজের ক্ষমতা তিনি পরিষ্কার জানেন। তিনি জানেন তিনি কি বলতে চান। কিভাবে তা বলবেন তাও নিজের কাছে পরিষ্কার। তার ধারণা অনেকেই বলতে জানেন। কিন্তু এই জানাটাই সব নয়। তার মতে, আসল হলো ‘কতটুকু’ বলা হবে। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে এই ‘কতটুকুর’ মাত্রাজ্ঞান তার মত খুব কম লেখকেরই আছে। সে জন্যই আমরা দেখি চূড়ান্ত নির্মোহ অবস্থানে থেকেও তিনি তার পাঠককে টেনে নিয়ে যান মায়াময় জীবনের অতলে বয়ে চলা অন্তহীন শূন্যতার মাঝে। পাঠককে করে তোলেন বিপন্ন। এখানেও তার শক্তির দিকটি স্পস্ট। যা বলার তা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, ধারণ করেই বলেন। তার উপন্যাস পাঠ শেষে পাঠক জেগে ওঠেন এক বিপন্ন অনুভূতি নিয়ে। অস্তিত্বের মর্মমূলে আঘাত করেন তিনি। পাঠকের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে তোলেন কোন সমাধান না দিয়ে এবং এ সবই তার পরিকল্পিত। নিপুণ কারিগরের মতোই তিনি গল্পের জাল বোনেন। সে জালে আটকে পড়া ভিন্ন পাঠকের থাকে না কোন উপায়। পরিকল্পিত জাল বোনার বিষয়টি তার কথাতেই পরিষ্কার। তিনি বলেন আমি টাপরাইটারে এলোমেলো ভাবনা লিপিবদ্ধ করে ‘কি হয়’ তা দেখায় বিশ্বাসী নই। আমি লিখতে বসার আগেই পরিষ্কার জানি আমি কি করতে যাচ্ছি। তিনি রীতিমতো গবেষণা শেষে লিখতে বসেন। আবার বৈপরীত্যও আছে। তিনি ভেবে পান না গ্রন্থকে সবসময় কেন ব্যাকরণ মেনে চলতে হবে। তাই প্রিয় দস্তয়ভস্কির বিশৃঙ্খলার মাঝে তিনি খুঁজে পান মূল্যবান কিছু। তিনি বিশ্বাস করেণ দস্তয়ভস্কি যা লিখেছেন তা সেভাবে ছাড়া অন্য কোনভাবে লেখা সম্ভব ছিল না। তার দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে’তে যেমন তিনি তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে খুঁজেছেন মর্যাদার সংজ্ঞা । তার চরিত্রেরা প্রতারক। চিন্তায় সুবিধাবাদী। তিনি নিজেও আত্মপ্রতারণার সুরে বলেন, আমি ঠিক জানি না বা নিশ্চিত নই মর্যাদা কি। তবে নিশ্চিতভাবেই তিনি সাহিত্যে সৎ। কাজুও ইশিগুরোর জন্ম ৮ নবেম্বর ১৯৫৪ জাপানের নাগাসাকিতে। ১৯৬০ এ তার পরিবার চলে আসে ব্রিটেনে। ১৯৭৮ এ স্নাতক সম্মান ডিগ্রী অর্জন করেন কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ওপর মাস্টার্স বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট এঙ্গেলিয়া থেকে। গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে ইশিগুরো ঠাঁই করে নেন পঞ্চ পা-বের তালিকয় যারা বদলে দিতে যাচ্ছেন ইংরেজী সাহিত্যের মানচিত্র। চারবার মনোনীত হয়েছিলেন ম্যান বুকার এ্যাওয়ার্ডের জন্য। তার রিমেইন্স অব দ্য ডের জন্য ম্যান বুকার লাভ করেন ১৯৮৯তে। তখন থেকেই ঠাঁই করে নেন ইংরেজী ভাষায় বহুল পঠিত লেখক তালিকায়। ২০০৮এ টাইমস তাকে ঠাঁই দেয় ১৯৪৫ এর পর সেরা পঞ্চাশ ইংরেজ সাহিত্যিকের তালিকায়। অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পয়ার সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ১৯৯৫ এ। তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি এ্যান আর্টিস্ট অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড, দ্য রিমেইন্স অব দ্য ডে, নেভার লেট মি গো। তার সপ্তম ও সবশেষ উপন্যাস দ্য বুড়িড জায়ান্ট প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ এর মার্চে। তার রচনা অনুদিত হয়েছে ৪০ টি ভাষায়। নোবেল প্রাপ্তির পর সঙ্গত কারণেই তার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। সেই প্রত্যাশা পূরণে তার নতুন সৃষ্টি কর্মের অপেক্ষায় থাকবেন সারা বিশ্বের অগণিত পাঠক। নোবেল ॥ বিতর্ক ও প্রত্যাখ্যান প্রসঙ্গ যখন নোবেল তখন বিতর্ক মেনে নিয়েই বলতে হয় পুরস্কারের বিশ্বে এর মর্যাদাই আলাদা। সেই প্রচলনের পর থেকেই। এর অর্থমূল্যও নিঃসন্দেহে অন্যতম আকর্ষণ। আকর্ষণের আরেক কারণ এর প্রচলনের পেছনের গল্পটি। প্রচলিত যে, আলফ্রেড নোবেল বিস্ফোরক আবিষ্কারের ফলাফলে অনুতপ্ত হয়ে এ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। আর এই অনুতাপের উদয় ঘটে তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর একটি ফরাসী পত্রিকার শিরোনাম থেকে। পত্রিকাটি শিরোনাম করে ‘মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন মৃত্যুর কারিগর’। আলফ্রেড নোবেল যেন দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর মৃত্যু পরর্বতী সংবাদ শিরোনাম। অনাগত আগামীতে মৃত্যু ও ধ্বংসের করিগর হিসেবে চিহ্নিত হবার ধারণাটি তাঁর পছন্দ হয়নি সঙ্গত কারণেই। তাই তিনি তাঁর অর্জিত অর্থ থেকে ‘মানবজাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ অবদান রাখা মানুষদের জন্য এই পুরস্কার প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি পাপ মোচনের মতো। কে না জানে সাধারণ মানুষ অনুতাপের গল্প শুনতে ভালবাসে। তা যদি হয় বড় মানুষের অনুতপের গল্প তবে তো কথাই নেই। নোবেল নিয়ে রাজনীতিও কম হয়নি। স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আছে প্রত্যাখ্যানের ঘটনা। নোবেলের আজকের অবস্থানের কারণটি কিন্তু কেবল অর্থমূল্য বা অনুতাপের গল্পে নয়। হাজারো বিতর্কের পরও নোবেল এমন কিছু মানুষের গলায় শোভা পেয়েছে যাদের এক কথায় বলা যায় সভ্যতার দিকপাল। নিজেদের মেধা, সৃষ্টিশীলতা দিয়ে যারা বদলে দিয়েছেন আমাদের পরিচিত পৃথিবী। পাল্টে দিয়েছেন মনোজগত। জীবন হয়েছে সহজ। অন্ধকারে তারা দেখিয়েছেন আলোর দিশা। তাদের বুকে শোভা পেয়ে নোবেল বাড়িয়েছে নিজের মর্যাদা। সে জন্যই নোবেল অনন্য। আজ নোবেল অর্জন মানেই সভ্যতার অমর মেধাবীদের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়া। নশ্বর জীবনে অমরত্ব অর্জন। নোবেল পদক প্রদানের নিয়মকানুন নিয়েও জল কম ঘোলা হয়নি। মৃত্যুর পর নোবেল না দেয়ার সিদ্ধান্তটিও বিতর্কিত। নিয়মটি হল পুরস্কার ঘোষণার সময় প্রাপককে অবশ্যই জীবিত থাকতে হবে। তবে ভুল হয়েছিল একবার। ২০১১তে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জয়ী স্টেইনম্যান ঘোষণার তিন দিন আগে মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টি জানা ছিল না কর্তৃপক্ষের। অতঃপর সরল বিশ্বাসে প্রদান করা হয়েছে এই যুক্তিতে ঘোষণা বহাল রেখে কর্তৃপক্ষ মুখ রক্ষা । আসি প্রত্যাখ্যানের গল্পে। সম্ভবত নোবেল ইতিহাসের এক পরিহাস এই যে, নোবেল গ্রহণকারীদের চেয়ে প্রত্যাখ্যানকারীরা বেশি আলোচিত। বিশেষ করে সাহিত্যে। এ পর্যন্ত ১১০ বার প্রদত্ত সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত ১১৪ জনের মধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন মাত্র দু’জন। একজনের প্রত্যাখ্যান আবার স্বেচ্ছায় না পরিস্থিতির চাপে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আছে বিতর্ক। এই দু’জন হলেন বেরিস পাস্তেরনাক ও জ্যাঁ পল সার্ত্র। জ্যাঁ পল সার্ত্র ও নোবেল জ্যাঁ পল সার্ত্র। তার দর্শন, সাহিত্য, বহুল চর্চিত প্রেম সব ছাপিয়ে নিজ সময়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন মানবতা আর বিবেকের কণ্ঠস্বরে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ শোষকের দুর্গে আঘাত করেছে ঝড়ের মতই। নিজ জাতি তাকে অনুসরণ করেছে যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। সরকার কিংবা আইনের গ-ি তাকে বাঁধতে পারেনি। তাই ফরাসী সরকার বাধ্য হয়ে নীতি গ্রহণ করেছিল ‘যাই করুণ না কেন সার্ত্রকে গ্রেফতার করা চলবে না।’ ছিলেন নিজের বিশ্বাসে অটল। যা বিশ্বাস করতেন তা উচ্চারণে দ্বিধা ছিল না কোন। আর এই বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন ১৯৬৪তে নোবেল পুরস্কার। বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলে তিনি প্রত্যাখ্যানের কারণ জানিয়ে যে চিঠি লিখেন তা ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ১৭, ১৯৬৪তে টাইমসে। জ্যাঁ পল সার্ত্রের চিঠি আমি গভীর অনুতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছি বিষয়টি রীতিমতো কেলেঙ্কারির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। একটি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল এবং আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছি। এটি ঘটতে পেরেছে কারণ বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। আমি অক্টোবর ১৫তে ফিগারে লিটারেরির মাধ্যমে প্রথম জানতে পারি এবারের পদকের জন্য সুইডিশ একাডেমি আমার নাম বিবেচনা করছেন। কিন্তু এখনও কিছু স্থির হয়নি। আমি সেদিনই একপত্রে আমার মনোভাব একাডেমিকে জানিয়ে দেই। আমার ধারণা ছিল বিষয়টির সেখানেই সমাপ্তি ঘটবে। আমার এটি জানা ছিল না যে, প্রাপকের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই পুরস্কারটি প্রদান করা হয়। আমার বিশ্বাস ছিল আমার মতামত একাডেমি বিবেচনায় নিয়ে তালিকা থেকে আমায় বাদ দেবেন। এখন বুঝতে পারছি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সুইডিশ একাডেমি তাদের সিদ্ধান্ত বদলায় না। আমার পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের কারণ সুইডিশ একাডেমি বা এটি নোবেল পুরস্কার বলে নয়। আমি একাডেমিকে তা জানিয়েছি। দুটি কারণে আমি এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করি প্রথমত ব্যক্তিগত দ্বিতীয়টি আদর্শিক। ব্যক্তিগত কারণ: আমার এই প্রত্যাখ্যান কোন আবেগপ্রসুত আচরণ নয়। আমি সব সময়ই প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছি। যুদ্ধের পর ১৯৪৫-এ আমাকে লিজিয়ন অব অনার প্রদান করা হলে আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। যদিও সে সরকারের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল। বন্ধুরা চাইলেও আমি কখনও কলেজ ডি ফ্রান্সে প্রবেশের আগ্রহ অনুভব করিনি। আমার এই আচরণের ভিত্তি লেখালেখির প্রতি আমার দায়বদ্ধতা। একজন লেখক যার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক অবস্থান আছে তিনি কেবল তার নিজের পথে তা প্রকাশ করবেন। আর সেটি হবে শব্দের মাধ্যমে। লেখকের গৃহীত সম্মান তার পাঠকের মনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে,যা আমার কাম্য নয়। জ্যা পল সার্ত্র আর নোবেল বিজয়ী জ্যাঁ পল সার্ত্র আমার কাছে এক নয়। একজন লেখক যখন এ ধরনের সম্মান গ্রহণ করেন স্বাভাবিকভাবেই সম্মানদাতা প্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ভেনিজুয়েলার বিপ্লবের প্রতি আমার সহানুভূতি একান্তই আমার। সেখানে নোবেলকে জড়ানোর কোন সুযোগ নেই। আর তাই একজন লেখকের উচিত নয় প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। হতে পারে সেটি অনেক বেশি গৌরবের যা হয়েছে তা এক্ষেত্রে। আমার এই ধারণা একান্তই আমার। ইতোপূর্বে যারা এ সম্মান পেয়েছেন তাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার বরং এই পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেকের জন্যই আমার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। আদর্শিক কারণ: বর্তমাণ সময়ে স্ংস্কৃতির জগতে যুদ্ধটি হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিমের সহাবস্থানের। আমি এটিও জানি অচিরেই তা দ্বন্দ্বের রূপ নেবে। তবে তা হবে মানুষ এবং সংস্কৃতির মধ্যে এবং তা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকতার হস্তক্ষেপমুক্ত। আমি নিজেও এই দ্বন্দ্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। আমি বেড়ে উঠেছি। এই সংঘাতের মাঝে। এটি অনস্বীকার্য যে আমি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী যা আজ পূর্ব ব্লক বলে পরিচিত। কিন্তু আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বুর্জোয়া পরিবারে এবং তাদের কালচারে। আমি এই দুই মেরুর দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করতে আগ্রহী। আর তাই পূর্ব নয় পশ্চিম ঘেঁষা কোন পুরস্কার আমি গ্রহণ করতে অক্ষম। আবার সমাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও কেউ যদি আমায় লেনিন পদক প্রদান করতে চান আমার জবাব সেই একই হবে। আমি জানি নোবেল পশ্চিমা ব্লকের জন্য নির্ধারিত পদক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি বর্তমানে পশ্চিমা ও পূর্ব ব্লকের বিদ্রোহীদের জন্য সংরক্ষিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নেরুদা এখনও এই পদক পাননি। কিন্তু লুইস এ্যারাগনের পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এটি পরিতাপের যে সোলোকভ নয় এই সম্মান পেয়েছেন পাস্তেরনাক। বিষয়টি এমন যেন সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ আর বাইরে প্রকাশিত গ্রন্থের লেখককে এই পুরস্কার দেয়া হবে। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে পারতেন, আলজিরিয়া যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় আমরা যখন ঘোষণাপত্র ১২১ এ স্বাক্ষর করি তখন যদি এ পুরস্কার দেয়া হত আমি কৃতজ্ঞ চিত্রে তা গ্রহণ করতাম। কারণ এটি তখন আমার একার নয় বরং যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছিলাম তার প্রতি সম্মান দেখানো হতো। কিন্তু তা হয়নি। যুদ্ধ যখন শেষ তখন এ সম্মান দেয়া হলো। সুইডিশ একাডেমি তাদের ঘোষণায় ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। আমার কাছে শব্দটির গুরুত্ব ভিন্ন। দীর্ঘ পত্রের শেষে তিনিও পুরস্কারের অর্থমূল্য নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন এটি কাজে লাগত, তবু তিনি অপারগ এই পুরস্কার গ্রহণে। বোরিস পাস্তেরনাক সার্ত্রের ছয় বছর পূর্বে ১৯৫৮তে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেণ ডক্টর জিভাগোর রচয়িতা বোরিস পাস্তেরনাক। তার এই প্রত্যাখ্যানকে ঘিরে বিতর্ক আছে। বলা হয় প্রথমে গ্রহণ করলেও তৎকালীন কর্তৃপক্ষের চাপে তিনি বাধ্য হন নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে। তার বহুল আলোচিত উপন্যাস ডক্টর জিভাগো স্বদেশে নিষিদ্ধ হলেও বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। বলা হয় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে উপন্যাসটির প্রচারে ভূমিকা রাখে সিআইএ। অভিযোগটির সত্যতা নেই এমনও বলা যায় না। আবার এও সত্য যে পাস্তেরনাকের এই প্রত্যাখ্যান স্বেচ্ছায় নয়। তবু ইতিহাসে এটি প্রত্যাখ্যান বলেই চিহ্নিত হবে। সাহিত্যে নোবেল নিয়ে বিতর্ক ছিল, আছে হয়ত ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই বলে যারা গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাদের মর্যাদার কোন হেরফের হবে না। কারণ চূড়ান্তবিচারে পুরস্কার নয় বরং স্রষ্টা ও সৃষ্টিকর্মই সত্য।
×