ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বিষাক্ত ব্যাঙ কেন নিজের বিষে মরে না

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

বিষাক্ত ব্যাঙ কেন নিজের বিষে মরে না

বিষাক্ত ব্যাঙের শরীরে অতি শক্তিশালী কিছু নিউরোটক্সিন থাকে। কিন্তু কিভাবে এই ব্যাঙগুলো সেই বিষক্রিয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছেন। তারা এই প্রশ্নের উত্তরের আরও এক ধাপ কাছাকাছি চলে এসেছেন। এর চূড়ান্ত জবাব পেলে ব্যথা-বেদনা ও নেশাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা এক সম্ভাবনাময় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াতে পারে। অদ্ভুতুড়ে বিষাক্ত ব্যাঙ এপিপোডোবেটস এন্থনি এপিবাটিডাইন নামক বিষের মৌলিক উৎস। এই বিষ ইকুয়েডর দেশটির বাইরে অন্য আর কোন প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের আগস্টে দক্ষিণ ইকুয়েডরের একটি কলাবাগানে ব্যাঙটি ধরা পড়ে। ছোটখাটো আকার, চিত্রবিচিত্র ডোরাকাটা দাগ শরীর। কেন এই ব্যাঙটি বিষাক্ত হলেও তার শরীরে এই বিষের কোন ক্ষতি হয় না এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালান। তারা লক্ষ্য করেন যে শিকারি প্রাণীদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এই ব্যাঙ নিজের এই বিষ কাজে লাগায়। তারা এপিবাটিডাইন বিষ শিকারি প্রাণীর গায়ে লাগায়। সেই বিষ প্রাণীটির স্নায়ুতন্ত্রের রিসেপটরের সঙ্গে আটকে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপ, সিজার এমনকি মৃত্যুও ঘটায়। অথচ ব্যাঙটি নিজে কেন সেই বিষক্রিয়ার শিকার হয় না? গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, বিবর্তনের ধারায় এই ব্যাঙগুলোর শরীরে ছোটখাটো জিনেটিক রূপান্তর ঘটেছে। যে আড়াই হাজার এ্যামইনো এ্যাসিড দিয়ে রিসেপটর গঠিত তার মধ্যে মাত্র তিনটি এ্যামাইনো এ্যাসিডের এই রূপান্তরের কারণেই সেই বিষ ব্যাঙের নিজস্ব রিসেপটরের ওপর কাজ করতে পারে না। যার ফলে ব্যাঙ সেই বিষের প্রাণঘাতী প্রভাব রোধ করতে পারে। নিজের শরীরে বিষ থাকা আপন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ভাল। এতে শিকারি প্রাণীকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। কিস্তু অন্য আরও অনেক প্রাণীর শরীরে বিষ থাকে না কেন? এক্ষেত্রে এক মস্ত বাধা হচ্ছে নিজের শরীরের বিষ আপন দেহে ক্রিয়া করতে না দেয়ার ক্ষমতা গড়ে উঠতে না পারা। শত শত প্রজাতির বিষাক্ত গ্যাস আছে। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন কয়েক ডজন নিউরোটক্সিন ব্যবহার করে। তবে এপিপেডোয়েটস এন্থনির বিষক্রিয়া অনেক শক্তিশালী। এই ব্যাঙের বিষ এপিবাটিডাইন অনেশাকর শক্তিশালী ব্যথানাশক হিসেবেও কাজ করতে পারে। নতুন গবেষণায় আরও দেখা গেছে কিভাবে কিছু কিছু বিষাক্ত ব্যাঙ বিবর্তনের ধারায় নিজের শরীরে বিষক্রিয়া রোধের ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে অথচ সে সব রিসেপটর মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবহার অক্ষুণœ থেকেছে। এ থেকে বিজ্ঞানীরা এপিবাটিডাইন সম্পর্কে এমন তথ্য পেলেন যা শেষ পর্যন্ত নতুন বেদনানাশক বা নিকোটিন আসক্তিরোধের ওষুধ উদ্ভাবনে সহায়ক হবে। রিসেপটর হলো দেহকোষের বহির্ভাগের এক ধরনের প্রোটিন যা বহির্ভাগ ও অত্যন্তর ভাগের মধ্যে সঙ্কেত পাঠাতে পারে। রিসেপটর হলো এক ধরনের তালা যা সঠিক চাবিটি না পাওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সঠিক আকারের কোন মলিকুলের সংস্পর্শে এলে রিসেপটরটি ক্রিয়াশীল হয় এবং সঙ্কেত পাঠায়। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রেবেকা টারভিন ও তার দল যে রিসেপটরটি নিয়ে গবেষণা করেছেন সেটি শেখা ও স্মৃতির মতো প্রক্রিয়াগুলোর ক্ষেত্রে সঙ্কেত পাঠায়। তবে সাধারণত তখনই কেবল কাজ করে যখন সূক্ষ্ম কোন চাবি এর সংস্পর্শে আসে। দুর্ভাগ্যবশত ব্যাঙের শিকারিদের ক্ষেত্রে এপিবাটিডাইন বিষয়টি রিসেপটরের ওপর শক্তিশালী চাবির মতো কাজ করে কোষগুলোকে হাইজ্যাক করে ফেলে এবং এর বিপজ্জনক ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যায়। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে বিষাক্ত যেসব ব্যাঙ এপিবাটিডাইন বিষ ব্যবহার করে তাদের একটা ছোটখাটো জিনেটিক রূপান্তর ঘটে গেছে যার ফলে এই বিষ তাদের রিসেপটরগুলোর গায়ে গিয়ে আটকায় না। এক অর্থে তারা রিসেপটরের চাবিকে বাধা দিতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় দফা জিনেটিক রূপান্তরের বদৌলতে তারা প্রকৃত চাবিকে কাজ চালিয়ে যেতে দেয়ার একটা উপায় অক্ষুণœ রেখেছে। ব্যাঙের ক্ষেত্রে সেই চাবিটা অধিকতর বেছে বেছে কাজ করে। চাবিটি যেভাবে পরিবর্তিত হয় তা থেকে মানুষের রোগ নিরাময়ের ওষুধ উদ্ভাবনের নতুন উপায়ের সন্ধান মিলতে পারে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে সে সব পরিবর্তনের কারণে ব্যঙেরা বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে পারে অথচ তাদের শরীরের সূক্ষ্ম কাজকর্মের কোন পরিবর্তন ঘটে না সেগুলো সেই রিসেপটরের অংশবিশেষের মধ্যে ঘটে যেগুলো এপিবাটিডাইন বিষের কাছাকাছি থাকে অথচ সেই বিষ স্পর্শ পর্যন্ত করে না, সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হলো এই যে ওষুধের সংস্পর্শে না থাকলেও কিভাবে এই এ্যামাইনো এ্যাসিডগুলো এমন নিখুঁত উপায়ে রিসেপটরের কাজকে বদলে দিতে পারে। রিসেপটরের সূক্ষ্ম যৌগগুলো স্বাভাবিকভাবেই কাজ করে চলে, কোন সমস্যা হয় না। অথচ রিসেপটরটা এপিবাটিডাইন প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। এটাই হলো মুগ্ধ হওয়ার মতো ব্যাপার। এসব ছোটখাটো পরিবর্তন কিভাবে রিসেপটরের আচরণকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে ধারণা হওয়ার ফলে বিজ্ঞানীরা এখন সেই রিসেপটরের ওপর কাজ করবে এমন ওষুধ উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে পারেন। এভাবে তারা বের করতে পারেন ব্যথা দূর করার বা নিকোটিনের আসক্তি কাটিয়ে ওঠার নতুন ওষুধ। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×