ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

গণমানুষের নেতা ইলা মিত্র

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

গণমানুষের নেতা ইলা মিত্র

বিপ্লবী চেতনা ও মমত্ববোধ যেন একসূত্রে গাঁথা।ইলা মিত্র ছিলেন তার যথাযথ উদাহরন। ব্রিটিশ শাসনপূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজে ভূমির মালিক ছিলেন চাষীরা। মুঘল আমলে চাষীরা তাদের উৎপাদিত ফসলের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা তারও কম পরিমাণ ফসল খাজনা হিসেবে দিত। একটি সমৃদ্ধ কৃষিনির্ভর সময় পার করছিল এই বাংলা বা বঙ্গদেশ সিরাজ উদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সমস্তই যেন ওলটপালট হয়ে গেল। এর ভয়ঙ্কর থাবা পড়ল কৃষকদের ওপর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের মধ্য দিয়ে চাষীদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা ভূমির পরিমাণ ও উর্বরতার ওপর ভিত্তি করে ব্রিটিশদের খাজনা দিত। কিন্তু তাদের সঙ্গে ফসল উৎপাদনের কোন সম্পর্ক ছিল না। কৃষক ও জমিদারদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগকারী একটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটল যারা জমিদারদের নিকট হতে জমি পত্তন বা ইজারা নিয়ে কৃষকদের দিত। কৃষকরা তা চাষবাস করত নিজ খরচে কিন্তু জমির মালিক না বিধায় তাদের অর্ধেক ফসল ওই জোতদারদের দিয়ে দিতে হতো। এ ব্যবস্থার নামকরণ হয় ‘আধিয়ারী’। সুবিধাভোগীদের দিব্যচক্ষু মেলিয়া গেল, কাজ না করে পয়সা রুজি। এবার ধীরে ধীরে খাজনা আদায়ের নামে শোষণের মাত্রা বাড়তে লাগল এবং কৃষকদের দাসের মতো ব্যবহার করতে শুরু করল। খাজনায় নতুন মাত্রা যোগ হলো। ফসলের পরিবর্তে কৃষকদের বাধ্য করা হলো অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোাধ করতে। এর ফলে কৃষকদের গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হতো। কখনও কখনও সে ঋণ আর শোধ করতে পারত না। প্রাকৃতিক খড়া বা অতিবৃষ্টিতে ফসলহানি হলেও খাজনা আদায়ে কোন ছাড় দেয়া হতো না। ক্রমে বাংলার কৃষক পরিণত হয় আধিয়ার আর ক্ষেতমজুরে। কৃষকের পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেয়ালে। বাঁচার তাগিদে সৃষ্টি হলো বিক্ষোভ। সবাই সংঘবদ্ধ হতে লাগল এবং ১৯৩৬ সালে গঠন করা হয় ‘সর্বভারতীয় কৃষক সমিতি’। ১৯৪০ সালে এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব পেশ করে ফাউন্ড কমিশন। এই কমিশনের প্রস্তাব ছিল কৃষকদের সরাসরি জমির মালিকানা প্রদান করা এবং উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ কৃষকদের দিতে হবে। প্রস্তাব দফতরেই পড়ে রইল। এদিকে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৪২ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সালে দেখা দেয় চরম দুর্ভিক্ষ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে অভিহিত হয়। কৃষকের ওপর শোষণের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে। শোষিত কৃষকরা মরিয়া হয়ে ওঠে মুক্তির আশায়। দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের দাবি নিয়ে আন্দোলন জোরদার হয় যার নাম দেয়া হয় ‘তেভাগা’ আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের নেতৃত্বে এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হয় রমেন্দ্র মিত্রকে এবং তাকে কলকাতা থেকে নিজ গ্রাম রামচন্দ্রপুরে পাঠালে তার সঙ্গে যুক্ত হন তার স্ত্রী কমরেড ইলা মিত্র। কৃষকের এই দুঃখ দুর্দশা দারুণভাবে নাড়া দেয় ইলা মিত্রকে। ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীন বাংলার এ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। তার আদিনিবাস ছিল ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতাতেই তার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় পার হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়ন। তিনিই প্রথম বাঙালী মেয়ে যে ১৯৪০ সালে জাপানের অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের জন্য সেটি বাতিল হয়েছিল। খেলাধুলা ও নাচগানে তার বেশ সুখ্যাতি ছিল এবং সারা বাংলায় তার নাম ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইলা মিত্র বেথুন কলেজে পড়ার সময় নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হন এবং হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে মহিলা সমিতির আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ওই সময় তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরও সদস্য হন। ১৯৪৫ সালে বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ইলা সেনের টাইটেল পরিবর্তন করে দেয়া হয় ইলা মিত্র। বিয়ের পর তিন কলকাতা ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীর রামচন্দ্রপুরে চলে আসেন। রক্ষণশীল জমিদার বাড়ির পুত্রবধূ হিসেবে তিনি অন্দর মহলেই থাকতেন। ওই সময় রমেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়া কৃষ্ণগোবিন্দুপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যার দায়িত্ব পরে ইলা মিত্রের ওপর। মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া স্কুলে মাস তিনেকের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ জনে। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে ইলা মিত্র তার স্বভাবসুলভ নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত গ্রাম হাসনাবাদে পুনর্বাসনের কাজে চলে যান। তখন মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করলে ইলা মিত্র সেখানে প্রচ- সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ইলা মিত্র মনেপ্রাণে ছিলেন একজন মমতাময়ী মানুষ। মানুষের বিপদে তিনি কখনও নিশ্চুপ থাকেনি। সংগঠিত করেন শোষিত সমাজকে এবং নেতৃত্ব দেন আন্দোলনে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করলে পার্টির শীর্ষ নেতারা আত্ম গোপন করে কাজ করতে থাকে। ইলা মিত্র তার স্বামীসহ নাচোলের চন্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করে গড়ে তোলে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন। ইলা মিত্র অন্তঃসত্ত্বা হলে তিনি গোপনে কলকাতা চলে যান এবং এক মাস বয়সের পুত্র সন্তানকে রামচন্দ্রপুর হাটে তার শাশুড়ির কাছে রেখে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন নাচোলে। এই ত্যাগ সত্যিই তাকে মহীয়ষী নারীতে পরিণত করেছে। মানুষের বেদনা তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে সারাক্ষণ। ১৯৪৯ সালে তার নেতৃত্বে হাজার হাজার ভূমিহীন কৃষককে সংগঠিত করে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মহাজন জমিদার ও জোতদাররা। সে বছর কৃষকের ধান জোতদারদের না দিয়ে ধান কৃষক সমিতির উঠানে তোলা হয়। নাচোলে সাঁওতাল ও ভূমিহীনদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় শক্তিশালী তীরন্দাজ ও লাঠিয়াল বাহিনী। মাতলামাঝি ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান। ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনের সফল রূপদান হয়েছিল এভাবেই। ১৯৫০ সালে নাচোল অঞ্চলে ও তার আশপাশে তেভাগা কার্যকর করতে বাধ্য হয়। ওই বছরই ৫ জানুয়ারি পুলিশ বাহিনী চ-িপুর গ্রামে এলে গ্রামবাসী পুলিশ কর্মকর্তা ও ৫ জন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা করে। ঘটনার দুই দিন পর ৭ জানুয়ারি ২ হাজার সেনা রেল স্টেশনের কাছে উপস্থিত হয়ে অভিযান শুরু করে। ১২টি গ্রাম ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি চালায়। হত্যা করে অসংখ্য মানুষকে, ঘরবাড়ি তছনছ করে, অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। ইলা মিত্রসহ আরও কয়েকশত মানুষ সাঁওতাল বেশে ভারত যাওয়ার জন্য রোহনপুর স্টেশনে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ধরে নিয়ে আসা হয় নাচোল স্টেশনে এবং অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় তাদের ওপর। সে নির্যাতনে প্রায় ৮০-৯০ জন মারা যয়। ইলা মিত্রের ওপর শুরু হলো পাশবিক নির্যাতন। রাজশাহী আদালতে তিনি তার জবানবন্দিতে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। এরপর ইলা মিত্র, রমেন্দ্র মিত্র ও মাতলা মাঝিকে প্রধান আসামি করে এবং শতাধিক সাঁওতাল কৃষকের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করা হয় যা কুখ্যাত নাচোল হত্যা মামল নামে পরিচিত। সে মামলায় সাক্ষী ছিল না বলে তৎকালীন দায়রা জজ প্রধান তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে তাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কমরেড ইলা মিত্রসহ সব রাজবন্দী ছিলেন তৎকালীন ছাত্র-জনতার চোখে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তাদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। ১৯৫৪ সালে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে আনা হয়। ওই বছর যুক্তফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের নির্দেশে তাকে চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয় এবং তিনি কলকাতায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। যুক্ত হন কলকাতা সিটি কলেজে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইলা মিত্র পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক সংগঠনের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তিনি চারবার মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বিভিন্ন অন্দোলনের জন্য ১৯৬২. ৭০.৭১ ও ৭২ এ তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। তিনি ভারতের মহিলা ফেডারেশনের জাতীয় পরিষদ সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অবশেষে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর উপমহাদেশের কিংবদন্তি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার এই গৌরবময় জীবন সমগ্র নারী জাতির জন্য যুগান্তকারী উদাহরণ এবং নারী সমাজের অহঙ্কার। মানুষের পথচলা হোক তারই আদর্শে।
×