ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

* কারণ ;###;বৈধ ব্যাংকিংয়ে আমানতের নিম্নতম সুদ হার ;###; অতি মুনাফার প্রলোভন;###;*ফল;###;টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থারবাইরে চলে যেতে পারে

বাড়ছে অবৈধ ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

বাড়ছে অবৈধ ব্যাংকিং

রহিম শেখ ॥ কোনভাবেই থামছে না অবৈধ ব্যাংকিং। মূলত ব্যাংকে আমানতের সুদহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসায় উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে এ ধরনের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এমন অভিযোগে সম্প্রতি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক ও ফারইস্ট ইসলামী মাল্টি কো-অপারেটিভ সোসাইটির কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। এর আগে ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক ও আজিজ কো-অপারেটিভ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংকে আমানতের সুদহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাংকে টাকা রেখে এখন গড়ে ৫ শতাংশের কম সুদ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে উচ্চ মুনাফার লোভে এক শ্রেণীর মানুষ এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে ভাল মুনাফার আশায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে টাকা চলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবৈধ ব্যাংকিং প্রতিরোধে তৎপরতা বাড়িয়েছে। ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দ যুক্ত করে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে দ্য ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রফিকুল আলম, এমডি লুৎফর রহমান, জামালপুর শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ওবায়দুল্লাহ ইবনে হকের ব্যাংক এ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় ও জামালপুর শাখার নামে কোন এ্যাকাউন্ট থাকলে সে তথ্যও দিতে বলা হয়েছে। নতুন সমবায় আইন হওয়ার পর গ্রাহকদের না জানিয়ে ২০১৩ সালে হঠাৎ করে অনেক শাখা বন্ধ করে দেয় এ প্রতিষ্ঠান। এরপর ২০১৫ সালের নবেম্বরে গ্রাহকদের ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে ৪০ মামলা করে দুদক। যাদের এ্যাকাউন্ট তলব করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকে এসব মামলার আসামি। এছাড়া ফারইস্ট ইসলামী মাল্টি কো-অপারেটিভ সোসাইটির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীম কবিরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে মামলা করে দুদক। এরপর তার স্ত্রী হাসিনা সুলতানাকে কো-অপারেটিভের সভাপতি করে এর কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। সম্প্রতি হাসিনা সুলতানাসহ এই প্রতিষ্ঠানের ১৩ জনের ব্যাংক এ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। অন্যদের মধ্যে আছেন হাসিনা সুলতানার ভাই ও সমিতির সহসভাপতি আবু ইউসুফ, শামীমের বোন ও সমিতির সদস্য সাদিয়া শারমিন, সহসভাপতি দুলাল আহমেদ, সম্পাদক এমদাদুল হক, সদস্য ইমরানুল ইসলাম, শাহীনা আক্তার, শরীফ মজুমদার, সেলিনা বেগম, পারভেজ আহাম্মদ, এবিএম হুমায়ুন ও শিরিনা আক্তার। কুমিল্লা অঞ্চলের ২৪ হাজার ৮০০ আমানতকারীর কাছ থেকে ১৩৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ব্যাংক কোম্পানি আইনানুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া কারও নামের সঙ্গে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। সমবায় সমিতি (সংশোধিত) আইনেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ব্যাংক বা সমজাতীয় কোন শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমবায় সমিতির নামে কোন শাখা থাকাও বেআইনী। আর এ ধরনের প্রতিষ্ঠান শুধু সমিতির সদস্য ছাড়া অন্য কারও মাঝে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এসব আইন অমান্য করে গ্রাহক ছাড়াও অন্যদের কাছ থেকে আমানত নিচ্ছে ও ঋণ বিতরণ করছে। আবার নামের সঙ্গে ব্যাংক যুক্ত করে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও সমবায় অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ায় সরাসরি কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, আইনানুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ব্যবসা করতে পারে না। কোন প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করাও বেআইনী। যদিও সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত ঢাকা মার্কেন্টাইল, আজিজ কো-অপারেটিভসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এমনটি করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি কোন ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয় সভা থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমবায় অধিদফতরকে বলা হয়েছে। তারা বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, সমবায় অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নিয়ে কাজ করায় এসব সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। আবার সমবায় অধিদফতরও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এ কারণে মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের এ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ অর্থ গেছে, সে অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যয় হয়েছে, মানিলন্ডারিং হয়েছে কি-না তা দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দেয়া হয়েছে। এর আগে ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ওঠার পর বিশদ পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়মের তথ্য উঠে আসায় তা বন্ধের সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে দুই লাখের বেশি আমানতকারীর কাছ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব আমানতের অধিকাংশই নেয়া হয়েছে সদস্যদের বাইরে বিভিন্ন গ্রাহক থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশে ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ বন্ধের উদ্যোগ নেয় সমবায় অধিদফতর। তবে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এখনও কার্যকলাপ চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা মার্কেন্টাইল উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিপুল আমানত সংগ্রহ করে তার একটি অংশ পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিকে দিয়েছে। এছাড়া আজিজ কো-অপারেটিভের বিরুদ্ধে আকর্ষণীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে সারাদেশের ৯৭ শাখার মাধ্যমে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে আমানত সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড বা এসিসি ব্যাংক নামের এ প্রতিষ্ঠান আমানতের পাশাপাশি ঋণও দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সঞ্চয়ের সুরক্ষা না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জনসাধারণকে সতর্ক করে গত মার্চে একটি গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। এ বিষয়ে সমবায় অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারাও অস্বস্তিতে আছেন। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে রিট করে সমবায় অধিদফতরের সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা স্থগিত করছে। অনেক ক্ষেত্রে লোকবল সঙ্কটের কারণে তারা ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
×