ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর কৌশল মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর কৌশল মিয়ানমারের

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ পরিকল্পিতভাবে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। উদ্দেশ্য, যারা এখনও রয়েছে তাদের বিতাড়নের পাশাপাশি পালিয়ে যাওয়াদের প্রত্যাবর্তন ঠেকানো। এখন নির্যাতন বন্ধ হলেও নানা কৌশলে চলছে হুমকি-ধমকি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দিক থেকে রয়েছে রাখাইন ছাড়ার আল্টিমেটামও। আর সেখানে থাকা রোহিঙ্গারাও এখন এতটাই মনোবল হারিয়েছে যে, তারা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশকেই নিরাপদ ভাবছে। এদিকে, সহিংসতার মুখে নাফ নদী পাড় হয়ে এপারে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে কিছু আলাপ হলেও শেষ পর্যন্ত তা কতটা ফলপ্রসূ হয় তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে মিয়ানমার সরকারের তরফ থেকে আসা দ্বিমুখী বক্তব্যের কারণে। আউং সান সুচির বক্তব্যে কিছু আশার আলো দেখা গেলেও পরক্ষণেই তা ভেস্তে যায় সেনা প্রধান মিন অং লাইং-এর বক্তব্যে। সুচির উদ্যোগে বিশাল সম্প্রীতি সমাবেশ এবং আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনার আয়োজনের পর বৃহস্পতিবার সেনা প্রধানের ফেসবুক পেজে দেয়া বক্তব্যে আসে সেই পুরনো অবস্থান। এতে তিনি রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার খবরকে অতিরঞ্জন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নয়, তারা অবৈধ বাংলাদেশী। একদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস এবং অপরদিকে, সেনাবাহিনীর বিপরীতমুখী বক্তব্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও। তবে আচরণে এটাই পরিষ্কার যে, পালিয়ে আসারা যেন ফিরে যেতে সাহস না পায় সে পরিস্থিতি বজায় রাখার কৌশলেই এগোচ্ছে মিয়ানমার সরকার। রাখাইন রাজ্য থেকে এখন যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ধারণা করা যায় যে, নারকীয় নিপীড়ন ও তা-ব থেমেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ¯্রােত থেমে নেই। মাঝে কয়েকদিনের জন্য স্তিমিত হলেও তা আবার বেড়েছে। প্রতিদিনই আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। নানা ধরনের নির্যাতনের কথা তারা বললেও কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা এবং রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তাদের সেই অভিযোগ এখন আর আগের মতো শতভাগ মানছেন না। বরং অনেকের ধারণা, এখন বাকি রোহিঙ্গারা আসছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায়। তবে সেখানে যে, পরিকল্পিতভাবে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে সে ব্যাপারে কারোরই সংশয় নেই। পশ্চিমা অবরোধের প্রভাব কতটা ॥ রোহিঙ্গাদের ওপর অব্যাহত নির্যাতনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো কিছুক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর অবরোধে আরোপের চিন্তা ভাবনা করছে। প্রাথমিকভাবে সে অবরোধ আরোপিত হতে পারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার ওপর। তবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে মিয়ানমার সরকারের। কিন্তু এতে কতটা প্রভাব পড়বে তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অবরোধের কারণে বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন শঙ্কার পাশাপাশি মিয়ানমার সরকার এও ভাবছে যে, বড় ধরনের ক্ষতি হবে না। কেননা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের ব্যবসা বাণিজ্য ততটা নেই, যতটা রয়েছে চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে। চলে যাওয়ার আল্টিমেটাম ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এখন সময় বেঁধে দিয়ে রোহিঙ্গা বিতাড়ন চালানো হচ্ছে। রাখাইনে জ্বালাওপোড়াও এবং হত্যা-ধর্ষণ আপাতত না থাকলেও রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে দেশান্তর হওয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়ে চলছে সেনাবাহিনী। শর্ত অমান্যকারীদের নির্যাতন ও আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং পুঁইমালি গ্রামের কালা মিয়ার কিশোর পুত্র মোহাম্মদ রিয়াজ জানায়, এখন আপাতত আগের মতো নির্যাতন নেই। তবে রোহিঙ্গাদের না খেয়ে মারার পরিকল্পনা এঁটেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বুধবার প্লাস্টিক কন্টেনারে ভর করে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করা এই কিশোরের বাবা সেখানে কৃষিকাজ ও ক্ষেত খামার করে সংসার চালাতেন। পরিবারে চার বোন ও একমাত্র ছেলে রিয়াজ জানায়, কোরবানির ঈদের চারদিন পর বলিপাড়া তাদের বাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বড় বোনের স্বামী নুর মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে যায়। এসময় আরও অন্তত ৩১ জনকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেনাবাহিনী তাদের আল-ইয়াকিনের সদস্য বলে প্রচার করে গুলি করেছে। মিয়ানমারের বুচিদং এলাকার বলিপাড়া, পুঁইমালিসহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের এক মাসের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছিল না। এ কারণে গ্রামে খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়। তখন খাবারের অভাবে ওইসব গ্রামের বাসিন্দাদের মারা যাবার উপক্রম দেখা দিলে সকলে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাড়িঘর খালি করার নির্দেশ ॥ সহিংসতার মুখে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও এখনও যারা রয়ে গেছে তারা রয়েছে আতঙ্ক ও হুমকিতে। সেনা সদস্যরা ঘরে ঘরে গিয়ে বলেছে, গ্রাম খালি করে দিতে। চলে না গেলে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হবে। সে কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখনও নাফ নদ পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয়ে আছে। খাদ্য নেই, জীবিকার অবলম্বনও নেই। ফলে সেখানে খাবারের জন্য হাহাকার অবস্থা। ক্ষুধার জ্বালা এবং জীবনশঙ্কায় সেখানে টিকে থাকা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে এখন শৈথিল্য থাকলেও প্রয়োজনীয়সংখ্যক নৌকা না থাকায় পালাতেও পারছে না। রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন ॥ নির্যাতন সইতে না পেরে যে সকল রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে তাদের বাড়িঘর জ্বালানোর পর ভিটেমাটিতে আর কোন চিহ্নই রাখেনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলেও তাদের বাড়িঘর এবং জায়গা জমি খুব সহজে শনাক্ত করতে পারবে না। রোহিঙ্গা তাড়ানোর পর তাদের ঘর, শস্য ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি আগুনে পোড়ানো হয়েছে রোহিঙ্গারা যেন ফিরে এলেও মাথা গুঁজার ঠাঁইটুকু না পায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, সেখানে এখনও রয়ে যাওয়া অন্তত আরও দুই লাখ রোহিঙ্গাকে তাড়ানো সম্ভব হলেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়বে। গত ২৫ আগস্ট রাখাইন থেকে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা আসা শুরু হলেও তাড়ানোর পরিকল্পনাটি গৃহীত হয় অনেক আগেই। আরও এক রোহিঙ্গার মৃতদেহ ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকাডুবির ঘটনায় ভেসে এলো আরও এক রোহিঙ্গার লাশ। রোহিঙ্গাদের জন্য ইরানের ত্রাণ ॥ রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য তৃতীয় দফায় ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছে ইরান। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বুধবার সন্ধ্যায় অবতরণ করে ত্রাণবাহী ইরানের একটি কার্গো ফ্লাইট। এতে ছিল প্রায় ৩০ মেট্রিক টন ত্রাণ সামগ্রী। ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা নারী আটক ॥ টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫ লক্ষাধিক টাকার ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা নারীকে আটক করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন-র‌্যাব। ধৃত নারী সাজিদা (২৬) টেকনাফ নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের ১০৫২ শেডের মোঃ জাবেদের স্ত্রী।
×