ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

নতুন আতঙ্ক ঘাতক গেম ব্লু হোয়েল

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

নতুন আতঙ্ক ঘাতক গেম ব্লু হোয়েল

বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এখন চলছে ব্লু হোয়েল গেম আতঙ্ক। ব্লু-হোয়েল বা নীল তিমি নামক এক অনলাইন গেমের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ দেয়া হচ্ছে আত্মহত্যার। আর এ খেলায় অনেকেই বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়পড়য়া অনেক শিক্ষার্থীই জড়িয়ে পড়ছে। তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, এই গেম খেলায় মত্ত হয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ইতোমধ্যে বেশকিছু শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ভারতে এ বিষয়ে মামলা গড়িয়েছে সর্বোচ্চ কোর্ট তথা সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত। ব্লু-হোয়েল নামক এই মরণ গেমে রয়েছে ৫০টি ধাপ। একেক ধাপে দেয়া হয় একেক রকম চ্যালেঞ্জ-যা কঠিন সব চ্যালেঞ্জের সমাহার এবং ভয়কে জয় করার প্রচেষ্টা। আর সর্বশেষ ধাপে রয়েছে অবধারিত মৃত্যু। এই গেমের নিয়ম হচ্ছে, একবার কেউ চ্যালেঞ্জে ঢুকে পড়লে তাকে শেষ করতেই হবে। আর চ্যালেঞ্জের শেষে রয়েছে প্রতিযোগী মুক্ত হবে সকল জাগতিক ভয় থেকে অর্থাৎ প্রতিযোগীকে আত্মহত্যা করতে হবে। এই গেম আগে পাওয়া যেত গুগল প্লে স্টোরে। তবে তা মরণ গেম হওয়ায় এখন গুগল প্লে স্টোর থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরেও অবাধ এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে থেমে থাকেনি এই গেমের বিস্তার। ইতোমধ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছে একজনের মোবাইলফোন থেকে অপরজনের মোবাইলফোনে। বাংলাদেশেও এখন অনেকের ফেসবুক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে এই গেমের বিষয়ে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়েছে-যা নিঃসন্দেহে একটি ভাল ও ইতিবাচক দিক। এই গেমের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার ন্যায় দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যদি সমাজের বিভিন্ন অন্যায়-অনিয়ম, অবিচার, সহিংসতা, হানাহানি, বিদ্বেষ, দুর্র্নীতি, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক থাকেন এবং সতর্ক বার্তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেন, তাহলে আমাদের সমাজ থেকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- যেমন একদিকে হ্রাস পাবে, তেমনি প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকেও অনেকে রেহাই পাবেন। যা হোক, বাংলাদেশে এই ব্লু-হোয়েল গেম বিষয়ে সতর্ক বার্তা সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম বড় মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই বিশেষ করে অনেক অভিভাবকই আতঙ্কিত হচ্ছেন, বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে এই গেমের বিষয়ে সকলের সচেতন থাকাটা বেশি জরুরী। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়পড়–য়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যেই পড়াশোনা, প্রেম-ভালবাসা, মাদক, ক্যারিয়ার, হতাশা ইত্যাদি বিষয়ক চাপ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ফলে তারা খোলা মাঠে-ময়দানে খেলাধুলা করার ও সুষ্ঠু বিনোদনের সময়-সুযোগ খুব একটা পাচ্ছে না। ফলে টাচ ষ্ক্রীননির্ভর জীবন তথা ভার্চুয়াল জগতকেই (যেমন : ফেসবুক, ইমো, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, টুইটার, স্কাইপ ইত্যাদি) তারা বেছে নিচ্ছে একমাত্র বিনোদন মাধ্যম হিসেবে। ফলে বাস্তবে তারা কোন সমস্যার মুখোমুখি হলেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। মানসিক সমস্যার কথা অনেক সময় তারা কাছের মানুষকেও জানাতে ভয় পায়। কিন্তু দেশ গড়ার কা-ারি তথা নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ে সকলে সজাগ হওয়া খুবই জরুরী। আমাদের দেশে দেখা যায়, কেউ মন খারাপের কথা জানাতে ভয় পায়, আবার কেউ পরীক্ষায় ভাল ফল করতে না পেরে মানসিক অশান্তিতে ভোগে (এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে-যা খুবই দুঃখজনক), আবার অনেকেই ভাল ফল করার চাপ নিতে না পেরে বাড়ি থেকে লাপাত্তা হয়ে যায় ইত্যাদি। মনের এমনই নানা সমস্যায় আক্রান্ত তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ^ব্যাপীই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক অবসাদের বিষয়টি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আর তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত প্রবল আসক্ত হচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে, মত্ত হয়ে উঠছে ব্লু-হোয়েল নামক মরণ খেলায়। তবে এই প্রবণতা রোধকল্পে এবং তরুণ প্রজন্মকে সুস্থ-সুন্দর রাখতে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে সকলের অংশগ্রহণে কর্মশালা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজনপূর্বক করণীয় নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন ঘটানো এখন অতীব জরুরী। এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ গণমাধ্যম যেন প্রচার করতে পারে যে, ব্লু-হোয়েল গেম নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ বিষয়ে অবশ্যই সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে উঠতি বয়সীদের দিকে ভালভাবে খেয়াল রাখা উচিত- যাদের মধ্যে ‘দেখি কী হয়’Ñ এই কৌতূহল রয়েছে বিশেষভাবে। বলা বাহুল্য, ভুল তথ্য প্রচার বা গুজব রটানো উল্টো ব্লু-হোয়েল নামক এই গেমটির প্রচারে বেশি ভূমিকা রাখবে, যার দরকার নেই মোটেও। ফলে, সঠিক তথ্য জেনে রাখাটাই হচ্ছে বেশি দরকার। আর অনলাইনে যেন এই গেম কোনভাবেই পাওয়া না যায় সে বিষয়ে সরকার তথা তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে এই গেম খেলার ওপর সরকারের তরফ থেকে আগাম নিষেধাজ্ঞাও জারি করা যেতে পারে। কারণ এই গেমটি মানুষকে আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করছে। এটি এমন কিছু চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে, যা পরে খেলোয়াড়কে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। বাংলাদেশে যদিও এখন পর্যন্ত এই গেম খেলে কেউ আত্মহত্যা করেনি, তারপরেও এ গেম বন্ধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। ব্লু-হোয়েলের পাশাপাশি এ জাতীয় অন্যান্য গেমের (যেমন : দ্য চোকিং গেম/চ্যালেঞ্জ, ডাক্ট টেপ চ্যালেঞ্জ, ঘোস্ট পেপার চ্যালেঞ্জ, আইস সল্ট চ্যালেঞ্জ, আইবল চ্যালেঞ্জ, দারুচিনি চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি) বিষয়েও সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। এ জাতীয় গেমের নেশায় যেন দেশের কিশোর-কিশোরীরা বা অন্য কেউ জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময়। সর্বোপরি, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থীসহ দেশের তরুণ সমাজের জন্য সুষ্ঠু চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলাসহ এসব বিষয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করণ; অভিভাবক ও সন্তানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক তৈরিকরণ; অভিভাবক কর্র্তৃক সন্তানদের সঠিকভাবে ও নিয়মিত দেখভাল করা, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তরুণ সমাজের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করার বিষয়গুলোও সুনিশ্চিত করা জরুরী- যেন দেশের তরুণ সমাজ হতাশায় না ভোগে, তারা যেন কেবল ভার্চুয়াল জগতকে তাদের একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত না করে এবং সর্বোপরি তারা যেন ব্লু-হোয়েল তথা এ জাতীয় কোন ক্ষতিকর গেমের প্রতি কোনভাবেই আসক্ত হতে না পারে। লেখক : ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ই-মেইল: [email protected]
×