ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে দেশটি বিশ্বকে খাওয়াতে পারে

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

যে দেশটি বিশ্বকে খাওয়াতে পারে

নেদারল্যান্ডস ইউরোপের ছোট্ট একটা দেশ। আয়তন ১৬ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশি। লোকসংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি। প্রতি বর্গমাইলে ১৩শ’রও বেশি লোকের বাস। এই ছোট্ট দেশটাই দুনিয়াকে খাদ্য যোগাচ্ছে বলা যেতে পারে। কারণ অর্থমূল্যের দিক দিয়ে নেদারল্যান্ডস হলো যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য রফতানিকারক দেশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের স্থলভাগ নেদারল্যান্ডসের চেয়ে ২৭০ গুণ বেশি। কিভাবে এটা সম্ভব হলো? ডাচরা কিভাবে পারল? সেটা সম্ভব হলো চাষাবাদের ধরন বদলে দিয়ে এবং সবচেয়ে দক্ষ কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বৃহদায়তন কৃষির জন্য যে সব সম্পদ প্রয়োজন তার প্রায় প্রতিটিরই অভাব রয়েছে হল্যান্ডের। তারপরও ডাচরা কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বুভুক্ষা মোকাবেলায় নতুন নতুন পথের পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দশক আগে ডাচরা অঙ্গীকার করেছিল সম্পদ যা আছে তার অর্ধেক কাজে লাগিয়ে দ্বিগুণ খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। দেশের জমির অর্ধেকেরও বেশি তারা কৃষি ও হর্টিকালচারে ব্যবহার করছে। তারা প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতিতে না গিয়ে অসাধারণ সব গ্রীন হাউস কমপ্লেক্স বানিয়েছে। কোন কোনটি ১৭৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা। জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত এই গ্রীন হাউস খামারগুলোর বদৌলতে সুমেরু বৃত্ত থেকে মাত্র হাজার মাইল দূরে অবস্থিত হল্যান্ড আজ সকল আবহাওয়ায় টমেটো উৎপাদন করে বিশ্বের শীর্ষ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তারা অর্থমূল্যের দিক দিয়ে বিশ্বের এক নম্বরের আলু ও পেঁয়াজ রফতানিকারক দেশ এবং শাক-সবজির দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক। বিশ্বে সবজি বীজ বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি উৎপত্তি হল্যান্ডে। ডাচরা এখন খাদ্যের ক্ষেত্রে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। তারা মনে করে গত ৮ হাজার বছরের ইতিহাসে সারা বিশ্বের চাষীরা মিলে যত খাদ্য ফলিয়েছে আগামী চার দশক তার চেয়েও বেশি খাদ্য ফলাতেই হবে। কারণ ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর লোকসংখ্যা হবে এক হাজার কোটি, যা আজকে হচ্ছে ৭৫০ কোটি। কৃষির ফলন যদি ব্যাপকভাবে বাড়ানো না যায় এবং তার পাশাপাশি পানি ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমানো না যায় তা হলে এক শ’ কোটি কি আরও বেশি লোক বুভুক্ষার সম্মুখীন হবে। ক্ষুধাই হতে পারে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে জরুরী সমস্যা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ডাচরা ব্যাপক খাদ্য উৎপাদনে ঝুঁকছে। ২০০০ সাল থেকে আধুনিক গ্রীন হাউসে খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত হল্যান্ডের অনেক কৃষক প্রধান প্রধান ফসল উৎপাদনে পানির ওপর নির্ভরশীলতা ৯০ শতাংশ কমিয়ে নিয়েছে। গ্রীন হাউস রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার তারা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে সেখানে হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু উৎপাদকরা এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ৬০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। কৃষিতে নেদারল্যান্ডসের এই বিস্ময়কর বিপ্লবের পেছনে মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করছে আমস্টারডামের ৫০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ওয়াজেনিনজেন ইউনিভার্সিটি এ্যান্ড রিসার্চ বা সংক্ষেপে ডব্লিউইউআর। এটি বিশ্বের শীর্ষ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই উদ্ভাবিত হচ্ছে কৃষির নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল। এখানকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন আফ্রিকায় খরা আছে। পানির সঙ্কট আছে। এটা কোন সমস্যা নয়। পানি সঙ্কট মৌলিক সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে নিম্নমানের বা অনুর্বর মাটি, যেটা মাটির পুষ্টিকর উপাদানের অভাবে হয়। এই সমস্যাও কাটিয়ে ওঠা কোন ব্যাপার নয়। এমন উদ্ভিদ চাষ করুন যেগুলো কিছু ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করে মাটির নিজস্ব সার তৈরি করে দেবে। গবাদিপশুর খাবার দানাদার শস্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কোন সমস্যা নেই। ওদের ঘাসফড়িং কি গঙ্গাফড়িং খাওয়ান। এক হেক্টর জমিতে এক মেট্রিক টন সম প্রোটিন মেলে। একই পরিমাণ জমি থেকে ১৫০ টন ইনসেক্ট প্রোটিন পাওয়া যেতে পারে। এই হলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে আছে ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি কি রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে তারই চেহারা। হাজার হাজার সাধারণ পারিবারিক খামার গড়ে উঠেছে সেখানে, আছে স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্যের ব্যবস্থা। মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও প্রকৃতির সম্ভাবনাময় শক্তির মধ্যে প্রায় নিখুঁত ভারসাম্য বিরাজ করে সেখানে। ডাচরা যে গ্রীন হাউস টমেটো বাগান গড়ে তুলেছে সেগুলো বড়ই বিচিত্র ও বিস্ময়কর। কোন কোনটি একরের পর একর জুড়ে বিস্তৃত। গাড় সবুজ এই বাগানগুলো ২০ ফুট উঁচু। টমেটো গাছগুলোর শিকড় মাটিতে নেই, বরং ব্যাসাল্ট ও চকের আঁশের মধ্যে। গাছগুলো টমেটোর ভারে নুয়ে আছে। নানা জাতের টমেটো একটা বাগানে। ১৫ রকম পর্যন্ত আছে। যার যেমন পছন্দ সেদিকে দৃষ্টি রেখে এগুলোর চাষ হচ্ছে। খামারগুলো সর্বক্ষেত্রে সম্পদের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজস্ব এনার্জি ও সারের প্রায় পুরোটাই, এমনকি ফসলের বিক্রি ও বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্যাকেজিং সামগ্রীরও কিছু কিছু তারা নিজেরাই তৈরি করে। গোটা খামারটা উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় সারা বছর রাখা থাকে। তাপটা আসে নেদারল্যান্ডসের অন্তত অর্ধেক ভূখ-ের নিচে ফুটন্ত জিওথার্মাল এ্যাকুইজার থেকে। সেচের একমাত্র উৎস হলো বৃষ্টির পানি। ব্যাসাল্ট ও চকের আঁশের মধ্যে শিকড় চিহ্নিত উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত প্রতি কিলোগ্রাম টমেটোর জন্য যেখানে চার গ্যালনেরও কম পানি প্রয়োজন সেখানে উন্মুক্ত ক্ষেতের উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজন ১৬ গ্যালন। বছরে একবার বীজ থেকেই সমস্ত ফসল পুনরুৎপাদন করা হয় এবং পুরনো বাগান প্রক্রিয়াজাত করে প্যাকেজিংয়ের ক্রেট তৈরি করা হয়। কিছু কীটপতঙ্গ কোনভাবে এসব গ্রীন হাউসে ঢুকতে পারল আর রক্ষা নেই তাদের। ফাইটো সেই-উলাস পার্সিমিলিস নামে এক ধরনের হিংস্র শিকারি মাকড় আছে। টমেটোর প্রতি এদের কোন আকর্ষণ নেই। এরা তখন বাইরে থেকে আগত টমেটো বিধ্বংসী কীটগুলোকে নিয়ে ভোজোৎসবে মেতে ওঠে। এই কৌশলগুলো ডাচরা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে। নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে উদ্ভাবনীমূলক কোম্পানিগুলোর একটি হলো কপার্ট বায়োলজিক্যাল সিস্টেম। জৈবিক পোকামাড়ক ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে এটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। এর ১৩৩০ জন কর্মচারী ও ২৬টি আন্তর্জাতিক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ৯৬টি দেশে কোম্পানির তৈরি পণ্যগুলো বিপণন করছে। সেই পণ্যগুলো কি? আর কিছুই নয়, ব্যাগভর্তি গয়াল নামে এক ধরনের কীটের লার্ভা বা শূককীট। এরা পরিণত অবস্থায় এলে এফিড নামক এক ধরনের কীট গোগ্রাসে খেয়ে থাকে। অথবা সেই ফাইটো সেই উলাস পার্সিমিলিস নামক শিকারি মাকড়শার কথাই ধরা যাক। এ জাতীয় ২ হাজার শিকারি মাকড়শার এক একটি বোতল এরা বিক্রি করে থাক। অথবা ৫০ কোটি নেমাটোডের একটি বাক্সের কথাইবা বাদ যায় কেন? বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যারা মাশরুম চাষ করে থাকে তাদের এক মস্ত মাথাব্যথা এক জাতীয় মাছি নিয়ে, যা মাশরুমের সর্বনাশ করে। নেমাটোডগুলো এই মাছির লার্ভার ভয়ঙ্কর শিকারি প্রাণী। শুধু কি শিকারি কীট উৎপাদনই কোপার্ট বায়োলজিক্যাল সিস্টেমসের কাজ? না। এরা বাম্বলবী নামক এক জাতের মৌমাছিও চাষ করে। ফুল থেকে ফুলে গিয়ে মধু আহরণের সময় এক ফুল থেকে আরেক ফুলে পরাগ ছড়াতে এবং এভাবে উদ্ভিদের ডিম্বাশয়কে নিষিক্ত করতে এদের জুড়ি নেই। কোন কৃত্রিম পরাগায়নে এদের দক্ষতার ধারে-কাছেও আসতে পারে না। বাম্বলবীর ব্যবহারে ফলন ও ফলের ওজন ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। বীজের ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের কৃষি প্রযুক্তির মতো বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জন করেছে অন্য কোথাও তত করেনি। বীজের ব্যবসায় ডাচ ফার্মগুলো বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। ২০১৬ সালে তারা ১৭০ কোটি ডলারের শুধু বীজই রফতানি করেছে। তবে তারা কোন জিএমও বীজ অর্থাৎ জিন রূপান্তরিত বীজ বিক্রি করে না। তারা যেটা করে তা হলো মলিকুলার ব্রিডিং। এতে বাইরের কোন জিন ঢুকানো হয় না। তবে ফলন অনেক ভাল হয়। পশ্চিম ইউরোপের শেষ যে দেশটি দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পড়েছিল সেটি নেদারল্যান্ডস। সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে জার্মান দখলদারির সময়। সেই দুর্ভিক্ষে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার লোক মারা গিয়েছিল। তারপর থেকে ডাচরা দুর্ভিক্ষকে বিদায় দিয়েছে। তারা বরং এখন বিশ্ববাসীকে খাওয়াচ্ছে। গত তিন দশক ধরে ডাচ টমেটো শিল্প উৎপাদনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে আছে। অন্য যে কোন দেশের তুলনায় সেখানে প্রতি বর্গমাইলে অধিক টমেটো উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ফলন ৫০৫৬২ মেট্রিক টন। অথচ টমেটো চাষের এলাকার দিক দিয়ে বিশ্বে দেশটির স্থান ৯৫ নম্বরে। মাত্র ১৭.৮ বর্গকিলোমিটার জায়গায় টমেটোর আবাদ হয়। নেদাল্যান্ডসের হর্টিকালচার গ্রীন হাউসের ওপর দারুণভাবে নির্ভর করে। এতে কৃষকরা চাষের অবস্থা নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পানি ও সারের মতো সম্পদ কম পরিমাণে ব্যবহার করতে পারে। দেশটিতে সবসুদ্ধ ৯৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গ্রীন হাউস আছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ম্যানহাটানের এলাকা হলো ৫৯ বর্গকিলোমিটার। হাইড্রোপনিক ফার্মিংয়ের মতো উদ্ভাবনী কৌশলকে কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ডস কৃষির ধারা পাল্টে দিয়েছে। এক্ষেত্রে মাটি ছাড়াই পুষ্টিসমৃদ্ধ সল্যুশনে ফসল ফলানো যায়। এতে পানি ও অর্থের সাশ্রয় হয়, সার্বিক খরচ কমে। ২০১০ সালে প্রতি কিলোগ্রাম টমেটো উৎপাদনে পানি লেগেছিল নেদাল্যান্ডসে সাড়ে ৯ লিটার, যুক্তরাষ্ট্রে ১২৭ লিটার, চীনে ২৮৪ লিটার। অন্যদিকে বৈশ্বিক গড় ছিল ২১৪ লিটার। ২০১৪ সালে টমেটোর ফলনের দিক দিয়ে শীর্ষ ২৫ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে আবাদি এলাকার হিসাবে নেদারল্যান্ডস ৯৫ নম্বরে থাকলেও ফলনের হিসাবে ছিল ২২ নম্বরে। সে বছর ওখানে ৯ লাখ টন টমেটো হয়েছিল। আর একর প্রতি ফলনে এক নম্বরে। উৎপাদন ও ফলন দুই দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ছিল তৃতীয়। চীনে সে বছর ১০০১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় টমেটো চাষ হয় এবং ফলন হয় ৫ কোটি ২৭ লাখ টনেরও বেশি। টমেটো চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ও উৎপাদিত টমেটোর পরিমাণের দিক দিয়ে চীন এক নম্বরে হলেও এর বর্গকিলোমিটার প্রতি ফলনের হার গড়পড়তা। অন্যান্য ফসলেও প্রতি বর্গকিলোমটিার ফলনের দিক দিয়ে নেদাল্যান্ডসের স্থান ১ নম্বরে আছে মরিচে ও শসায়, ২ নম্বরে আছে, নাশপাতিতে, ৫ নম্বরে গাজরে, ৬ নম্বরে আলুতে এবং ৮ নম্বরে আছে পেঁয়াজে। নেদারল্যান্ডসের গ্রীন হাউসগুলোর আরেক বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে কোন কিছুরই অপচয় হয় না, পরিত্যজ্যও হয় না। যেমন জেনারেটর দিয়ে সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসকে আলোককায়নের জন্য বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হয়। এর উপজাত হিসেবে যে তাপ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেরিয়ে আসে তা ধারণ করে গ্রীন হাউসকে উষ্ণ রাখা ও উদ্ভিদের বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করা হয়। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×