ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

মাছ, মাংস, শাক-সবজি, রিক্সা ভাড়াও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

মাছ, মাংস, শাক-সবজি, রিক্সা ভাড়াও নিয়ন্ত্রণ করা দরকার

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ওপর আর লিখতে ইচ্ছে করে না। কারণ লিখে কোন লাভ হয় না। বৃদ্ধি ঘটতেই থাকে, হঠাৎ হঠাৎ, ধীরে ধীরে, বছরে বছরে। তবে মাঝে মাঝে খুবই সামান্য স্বস্তি পাওয়া যায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি মিডিয়ায় ‘কভারেজ’ পেলে। এই যেমন চালের মূল্য। কথা নেই, বার্তা নেই ভিত্তিহীন অজুহাতে চালকল মালিক, আড়তদার ও পাইকাররা চালের দাম বাড়াতে থাকে। বাড়তে বাড়তে তা একটা অসহনীয় পর্যায়ে ওঠে। সবারই এতে টনক নড়ে। সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। ফলে এবারের মতো চালের মূল্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। মূল্যও কিছুটা কমেছে। তবে তা ১০ টাকা বাড়িয়ে দুই টাকা কমার মতো ঘটনা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসবই ঘটে, এভাবেই ঘটে। আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য ঈদ উপলক্ষে একটা নিয়মিত বৃদ্ধি ঘটে, তারপর ঘটে বাজেটের সময়। আবার ঘটে কোন দ্রব্যের ঘাটতি উপলক্ষে। কিন্তু এই যে বাড়ে, আর কমে না। কমলেও মূল্যস্তর ওপরের দিকেই শেষ পর্যন্ত ‘থিতু’ হয়। চালের বাজারেরও এই মুহূর্তে তা ঘটেছে। আমদানি এবং ‘ওপেন মার্কেট সেল’ (ওএমএস)-এর ফলে চালের বাজার কিছুটা নিচের দিকে ‘থিতু’ হয়েছে। মন্দের ভাল! কিন্তু এখন সমস্যা অন্যত্র। সবজির দামের কি হবে, কি হবে মাছের দামের, মাংসের দামের। কি হবে রিক্সা ভাড়ার, বাড়ি ভাড়ার? এ সবই যে সহ্য সীমার বাইরে। এসব দেখার দায়িত্ব কার? অর্থমন্ত্রীর, বাণিজ্যমন্ত্রীর, না খাদ্যমন্ত্রীর? প্রতিষ্ঠান হিসেবে মূল্যস্ফীতি কমানোর- বাড়ানোর ‘বিধাতা’ বাংলাদেশ বলেই জানি। এমতাবস্থায় কার কাছে ‘বিচার’ দেব যে, পুঁটি মাছের কেজি ৩০০-৪০০ টাকা। গরিবের মাছ বলে খ্যাত মৌরলা, কাচকি ইত্যাদির মূল্য আকাশছোঁয়া। খাসির মাংসে হাত দেয়া যায় না। প্রতিদিন এসবের দাম বাড়ছে। এখন তো সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন বাড়েনি। এতদিন দোকানিরা বলত সরকারী কর্মচারীদের আয় বেড়েছে। অতএব জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। এখন কারও বেতন বাড়েনি। চাকরির সুযোগও সেভাবে বাড়েনি বলে পরিকল্পনামন্ত্রী সেইদিন এক কাগজকে বলেছেন। বরং অনেক লোকের চাকরি যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, গার্মেন্টস খাতে শত শত কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বহু লোকের চাকরি গেছে। আর কোন্ কোন্ খাতের লোকের চাকরি গেছে তার খবর প্রতিদিনই খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে। অতএব বলা যায়, বাজারে অতিরিক্ত টাকা (আয়) নেই যে, চাহিদার কারণে মাছের দাম, মাংসের দাম বাড়বে। অথচ তা বাড়ছে। তবে কি সরবরাহ ঘাটতির কারণে এসবের দাম বাড়ছে? সরবরাহ ঘাটতি যদি সত্যি হয় তবে বলতে হয়, সেই অনুপাতে তো বাজারে টাকাও কমেছে, অর্থাৎ মানুষের আয়ও কমেছে। যেহেতু লোক কর্মচ্যুত হয়েছে/হচ্ছে, সেহেতু নতুন কর্মসংস্থান নেই, অতএব বাজারে অতিরিক্ত টাকা নেই যে তার চাপে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এই বিষয়টি কোনভাবেই আমার ‘বুঝের’ মধ্যে আসে না। আরও আসে না কারণ দেখা যায় বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রীর মধ্যে কেউ মাছের দামের কথা, মাংসের দামের কথা বলেন না। চালের দাম নিয়ে তারা যেমন সোচ্চার হন, মাছ-মাংসের দাম নিয়ে তারা তেমন হন না। অথচ চালের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মাংস ও মাছ। মাছ-মাংস পুষ্টির বিষয়। শুধু সর্করা খাদ্য চাল দিয়েই মানুষের চলে না। দৈনিক যে ‘ক্যালরি’ দরকার তার কমপক্ষে ২০ শতাংশ আসা দরকার মাছ-মাংস, ডিম ইত্যাদি থেকে। শোনা যায় ‘মাছ-মাংস-ডিমের’ একজন মন্ত্রী আছেন। তার দায়িত্ব কী? বলা হচ্ছে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ভাল করছে। এতে সন্দেহ স্থাপন করা আমার কাজ নয়। কিন্তু মাছে, মাছ উৎপাদনে সফল হলাম, আর দেশের ভেতর নাগরিকরা মাছ পেল নাÑ এটা তো কোন কাজের কথা নয়। মজা হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে মাছের অভাব হলেও, সেই কারণে তার দাম বেশি হলেও মাছ রফতানি হয়। এর ব্যাখ্যাও আমি বুঝি না। দেখা যাচ্ছে পুষ্টির অভাবে আমাদের শিশুরা খর্বকায় থাকছে। অর্থমন্ত্রীর নিজের এলাকা সিলেট এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অঞ্চল। অথচ এই সিলেটের মাটির ওপরে চা বাগান (সোলার ফসল), মাটির নিচে গ্যাস-তেল (সোনার খনি) এবং দেশের বাইরে ধনাঢ্য, বড় বড় ধনাঢ্য সিলেটী। সেই অঞ্চলের লোকেরা পুষ্টির অভাবে ভুগছে, ভুগছে সারাদেশের মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা। ভাত আমাদের হয়েছে। তবে ভাতের ক্ষেত্রেও এখন সাবধানতা দরকার। ক্রমেই চাল উৎপাদনের ক্ষমতা সঙ্কোচনশীল। এই সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলেই উল্লেখ করতে হয় পুষ্টির কথা। পুষ্টি ছাড়া তো জাতি হবে না। চাল আমাদের কিছুটা ‘মেধা’ যোগায়। শিশু পুষ্টি ছাড়া তো মেধাহীন হতে হবে পরিণামে। এমতাবস্থায় সকল পক্ষকেই আমার প্রশ্ন : মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধিতে আমরা নির্বিকার কেন? কেন এই ক্ষেত্রের কথা আমরা ভাবছি না? এই ক্ষেত্রেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দরকার হবে? অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনে হয়। শুধু মাছ, মাংস ও ডিমের কথা বলি কেন? বলতে হলে দুধের দামের কথাও বলতে হয়। এই দুধ ঢাকা শহরে ৮০ টাকা লিটারে বিক্রি হয়। এই মূল্যটা কী ব্যাখ্যামূল্য? ন্যায্যমূল্য দুই রকমের। একজন ক্রেতার কাছে যা ক্রয়মূল্য, আরেকজন বিক্রেতার কাছে তা বিক্রয় মূল্য। বিক্রয়মূল্য হতে পারে অনেক যদি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা (পারচেজিং পাওয়ার) থাকে। ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে ৮০ টাকা দরে কে দুধ পাবে? অথচ দুধও দরকার। শিশুরা কি শুধু মায়ের দুধের অপেক্ষা করবে? মায়ের দুধ আসবে কোত্থেকে? যে মায়ের দুই বেলা খাবার নেই, যে মা অপুষ্টিতে ভুগছে সেই মায়ের দুধ কোত্থেকে আসবে? তবে আমদানিকৃত গুঁড়া দুধই ভরসা। বছরে কত টাকার। বলা দরকার কত হাজার কোটি টাকার গুঁড়া দুধ আমদানি হয়? এটা কি গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ- এর দেশ বাংলাদেশ হয়? শুধু মাছ, মাংস, ডিম, দুধের দামের কথা বলছি কেন? রয়েছে শাক-সবজি, তরিতরকারি এসবের দাম কী পর্যায়ে এখন বাজারে? এটা আশ্বিন মাসের শেষ। আর কয়েকদিন বাদেই কার্তিক মাস। ঋতু হিসেবে শরৎ শেষ, সামনে আসছে শীতকাল। শীতের আমেজও আছে এখন। এই সময়ে প্রচুর সবজি বাজারে উঠতে শুরু করে। বস্তুত বাংলাদেশে এখন সারা বছরই সবজি হয়। কোন না কোন অঞ্চলে কোন না কোন সবজি এখন হয়ই। কৃষকরা শুধু ধানী ফসল ও পাট, তামাকের ওপর নির্ভরশীল নয়। তারা অন্যান্য ফসল, শাক-সবজি করে অনেক লাভবান। বন্যাও সারাদেশে হয়নি। সীমিত সময়ে একটা বন্যা উত্তরাঞ্চলে হয়েছে। এতে কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু শাক-সবজি সব শেষ হয়ে গেছে এমন তো নয়। বাজারেও নতুন সবজি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কি যুক্তিতে সবজির ‘দাম’ কিলোতে’ ২০-৩০ টাকা বেড়ে গেছে? আলুর কেজি ২৫ টাকা অনেক দিন থেকেই। অবশ্যই এটা ‘কোল্ড স্টোরেজের’ আলু। বেগুন, মুলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, ডাঁটা, উচ্ছে, শসা, মিষ্টি কুমড়া থেকে শুরু করে লাউ, লাউশাক, পেঁপে কোন্টার দাম কম? ৬০ থেকে ৮০ টাকার নিচে কোন শাক-সবজির দাম নয়। ৪টা ডাঁটার দাম ৩০-৩৫ টাকা। লাউ ৪০ টাকা থেকে ৭০ টাকা হয়েছে। এই যে ‘বাজারি ডাকাতি’ দোকানিরা দিনের পর দিন করছে তার কী কোন প্রতিষেধক নেই? একে তো দাম, তার ওপর রয়েছে ওজনের প্রশ্ন। পাল্লার ঠিক নেই, ওজনের ঠিক নেই। কোন তদারকি নেই বাজারের ওপর। কে করবে তা? কাওরান বাজার থেকে কাঁচামালটা শান্তিনগর বাজারে আসলেই এর দাম দেড়গুণ, দ্বিগুণ হয় কি ভাবে? কৃষকরা যদি ৬০ টাকা কেজির মুলার দামের মধ্যে কেজি প্রতি ৩০ টাকাও পেত তাহলে কোন আপত্তি ছিল না। ঢাকায় আমরা যে দাম দিই তার কুড়ি শতাংশ দামও কৃষকরা পান না। ওই কৃষক বিক্রমপুরের হোক, নরসিংদীর হোক, বেলাবর হোক, মানিকগঞ্জের হোক। হোক বগুড়া ইত্যাদি অঞ্চলের। দিনের পর দিন পাইকারি ও খুচরা শাক-সবজি ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ঠকাচ্ছে, ধোঁকা দিচ্ছে মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের। কেউ দেখার নেই। কেন বাণিজ্যমন্ত্রী এসব দেখবেন না। কেন অর্থমন্ত্রী এসব দেখবেন না। যদি না দেখেন তাহলে কেউ তো দেখবেন যার কাছে ক্রেতা হিসেবে আমাদের কথা বলতে পারি। নিয়ন্ত্রণহীন বাজার আমাদের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। মাছের বাজারে অশান্তি, সবজির বাজারে অশান্তি। অশান্তি রিক্সাওয়ালার সঙ্গেও। দশ টাকা রিক্সা ভাড়া নেই। রিক্সায় উঠলেই কুড়ি টাকা। তার পরের ভাড়া ৪০ টাকা। এই অশান্তি, অত্যাচার থেকে বাঁচার পথ কী? সবশেষে একটা কথা। বিচার যখন পাবই না, তখন একটা প্রশ্ন করি। ধানম-ি, গুলশান, বনানী, উত্তরা, শান্তিনগর এবং পুরনো ঢাকার কাপ্তান বাজারের বড় বড় সবজি দোকানওয়ালা, মাছ-মাংসওয়ালার দৈনিক রোজগার কত? এটা কোন অনুমানের বিষয় নয়। দেখা যাচ্ছে আয়ের দিক থেকে তাদের সিংহভাগই পড়ে করের মধ্যে। অথচ এরা ট্যাক্স কত দেয় আমরা জানি না। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত ক্রেতা বাজারে যায় তাদের সিংহভাগ করের আওতায় এখন। ক্রেতারা কর দেয়, বিক্রেতা দোকানিরা কর দেয় না। অথচ তাদের সম্পদ গড়ে উঠছে, এই অবিচারের বিচার কি? দ্রব্যমূল্য যখন তখন বৃদ্ধি করে যারা তাদের আয় বাড়াচ্ছে, সম্পদ বাড়াচ্ছে তাদের কাছ থেকে শক্ত হাতে কর আদায় করা হোক। মাছ বিক্রেতা বলে কথা নয়। কথা হচ্ছে আয় নিয়ে। যার করযোগ্য আয় আছে তার কাছ থেকে কর আদায় করা সরকারের দায়িত্ব। দৃশ্যত ‘গরিব’, অথচ প্রকৃতপক্ষে প্রচুর মাসিক আয়ের এবং সম্পদের মালিক- এমন শ্রেণীকে করের আওতায় আনা হোক। এই দাবি করছি কারণ তারা বাজার থেকেই অসাধু পন্থায় হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। যেহেতু বাজার নিয়ন্ত্রণের কোন পথ নেই, তাই অন্তত তাদের কাছ থেকে কর (ট্যাক্স) আদায়ের ব্যবস্থা হোক। লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×