ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নদী থেকে সমুদ্রে বহমান গঙ্গা যমুনা উৎসব ॥ দেবশংকর হালদার

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১২ অক্টোবর ২০১৭

নদী থেকে সমুদ্রে বহমান গঙ্গা যমুনা উৎসব ॥ দেবশংকর হালদার

অভিনেতা দেবশংকর হালদার। মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র সবক্ষেত্রেই সাবলীল উপস্থিতি। ভারতের জি বাংলার রিয়েলিটি শো ‘হ্যাপি প্যারেন্টস ডে’র উপস্থাপক হিসেবেও জনপ্রিয়। তিনি যে একজন নিখুঁত অভিনেতা তা আবারও প্রমাণ করলেন ঢাকার দর্শকদের কাছে। শিল্পকলা একাডেমিতে চলমান গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে সম্প্রতি মঞ্চায়ন হয় দক্ষিণ রুচিবঙ্গ প্রযোজিত তার একক অভিনীত নাটক ‘বর্ণপরিচয়’। মঞ্চ ও টিভি নাটক এবং সিনেমা সম্পর্কে কথা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত এই অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে। আপনার দৃষ্টিতে গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব। দেবশংকর হালদার : উৎসবের নতুন করে ব্যাখ্যা করার কোন মানে হয় না। উৎসব মানে আমরা জানি যে অনেক মানুষের মিলনস্থল। যেখানে নানা কাজ নিয়ে নানান ভঙ্গিমার মানুষ আসেন। নাট্যোৎসব তাই নানান ভঙ্গিমা, ধরন ও দর্শনের নাটক নিয়ে হাজির হয় দর্শকের সামনে। বলা যেতে পারে একজন আরেক জনের থিয়েটার দেখে, আবার অন্য থিয়েটারকর্মীর সঙ্গে কথা বলে অনেক সময় নোট কম্পেয়ার করে। বিশেষ করে যারা শিক্ষানবীশ তাদের জন্য উৎসব একটি ক্লাসরুম হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃত নাটক দেখা এবং নাটকের রান্নাঘরের যে মানুষ, তাদের সঙ্গে কথা বলাÑ এই সমস্ত মিলে উৎসব একটা প্রযোজনার অন্যরকম নামান্তর আমার কাছে। এই কারণে আমার মনে হয়, যে কারণে যে কোন উৎসব যদি তার সদর্থক দিকটাকে শক্তভাবে ধরি তাহলে দেখব, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে শিক্ষণীয় এবং আমার পরবর্তী প্রযোজনা করবার মাল-মসলা বা উপাদান। সেই জায়গা থেকে গঙ্গা-যমুনা উৎসবটাকে আমি ওই রকম মনে করি যে এখানে নানাবিধ থিয়েটার আসছে এবং বাংলা ভাষায় যে থিয়েটার চর্চা, এই চর্চার একটা খ-চিত্র এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সবমিলিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে নাট্যজনেরা বা নাট্যামোদী দর্শক ও নাট্যকর্মীরা সকলে খুব স্বাচ্ছন্দ্য, সুস্থ ও উত্তেজিতবোধ করেন এবং কিছু স্বপ্নের উপাদান পান। এ উৎসবে গঙ্গা ও যমুনা এ দুটি নামের মধ্যেও বহমান বা বহতার ব্যাপার আছে, বয়ে চলার ব্যাপার আছে। আমাদের যা কিছু আমরা আগে করেছি, সেটাকে নিয়ে আমরা বয়ে যেতে চাই ভবিষ্যতের দিকে, অন্য পাড়ের দিকে আদতে সমুদ্রের দিকে। গঙ্গ-যমুনা উৎসব তাই আমার কাছে সেই রকম নদী থেকে সমুদ্রের দিকে বহমান একটি উৎসব বলে মনে হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা থিয়েটার সম্পর্কে আপনার ধারণা কি? দেবশংকর হালদার : বাংলা থিয়েটার বললে অনেক বড় ব্যাপার দাঁড়ায়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা যেভাবে চলে সর্বত্রই তার একটা প্রভাব পড়ে। শুধু শিল্পকলায় নয়, জীবনযাপনেও তার প্রভার থেকে মুক্ত নয়। তবে শিল্পকলাতে বেশি। থিয়েটার তার বাইরের কিছু না। নাট্যকর্ম সবসময় ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। তাই বাংলা থিয়েটার এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে এমন একটা মোহতে যে আজকের সময়টাকে চিহ্নিত করে দিক নির্দেশ করতে পারবে ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু এখানে কতগুলো পিছুটান আছে। পিছুটান বলতে আমি বোঝাতে চাইছি যেহেতু সময়টা চিরকালই গোলমেলে থাকে, তবুও আজকের দিনে টেকনোলজির দাপট এবং সেটাকে থিয়েটারে ব্যবহার না করা এ নিয়ে দ্বন্দ্ব। একটা প্রজন্মের শেষ হয়ে যাওয়া আরেকটা প্রজন্মের উত্থান এই ডিজিটাল প্রজন্ম। এই দুটোর মাঝখানের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে শিল্পকলা বা থিয়েটারের একটা পথ হচ্ছে। যে পথে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে আজকের সময়োপযোগী হয়ে। তাই এই সময়টা একটু তাকে ব্যথা দিচ্ছে। তাকে বিপন্ন করছে, তাকে ভোগাচ্ছে। কিন্তু সমস্ত অন্বেষণের ভেতরেই একটা বিপন্নতা থাকে। আমি কি খুঁজে পাব আমার সেই পথ, আমি কি দেখতে পাব সেই আলো- যা আমি খুঁজছি, আমি কি নিজেকে প্রকাশ করতে পারব। এসব বিপন্নতার প্রশ্নগুলো আমাদের আসলে একটা উত্তরণের দিকেই ঠেলে দেয়। বাংলা থিয়েটার কিন্তু সেই রকম একটা খোঁজের জায়গায় আছে। সেদিক থেকে আমি বলব যে আমাদের বাংলা থিয়েটারের ভয় পাবার মতো তেমন কিছু এখনও হয়নি। আমরা কোন একটা সময় স্থিতাবস্থায় পড়ছি, কোন এক সময় খুঁজে পাচ্ছি না আমাদের নিজস্বভাষা, কিন্তু আমাদের চর্চা অব্যাহত। আমার ধারণা যে পথ আমরা খুঁজছি সেটা আমাদের নিশ্চিত সেই পথের দিকে ঠেলে দেবে। আমাদের এপার বাংলা-ওপার বাংলার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আরও বাঙালীরা থিয়েটার করেন, সর্বত্রই দেখেছি বাঙালীদের মধ্যে থিয়েটার করার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক প্রকাশ করার একটা চেষ্টা চলছে। থিয়েটার তো সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে থিয়েটারকে সবসময় প্রতিবাদী চরিত্র হয়ে উঠতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। একটা যে কোন প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প সেটাও সমাজেরই একটা খ-চিত্র বটে। এসব যে উৎসাহ ও সরলতায় এখনও মানুষ বাংলা থিয়েটার নিয়ে চর্চা করে যাচ্ছেন আমার কাছে সেটা খুব আশ্চর্যজনক লাগে। সত্যি বলতে কি থিয়েটার তো ক্রিকেট খেলা নয়, থিয়েটার তো ধামাকা নয়। যদি হাউসফুল হয় তো একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় শ’ জন লোকে এটা দেখে। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান কোটি কোটি লোক দেখে। সুতরাং থিয়েটার একটা মাইলোরজি কালচার। সেখানে দাঁড়িয়ে এত মানুষ সেখান থেকে তেমন কিছু পাচ্ছে না জেনেও যে নিজেদের এর সঙ্গে যুক্ত রাখছেন এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে থিয়েটার চর্চা করে চলেছেন সেটা তো আমাদের আশার কথাই বলে। আমাদের বাংলা নাটক কোন্ দিকে যাচ্ছে? দেবশংকর হালদার : আমি এতক্ষণ বোধহয় সেই কথাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। মানুষের সঙ্গে সংযোগের কারণেই নাটক করি। এই সংযোগের ভঙ্গিমা একেক জনের একেক রকম। কেউ কথা না বলে, না বলা বাণীর ধনযামিনীর মাঝে একটা কথা লুকিয়ে রেখে অন্যকে ছুঁতে পারে। কেউ অনেক কথা বলে সেটাকে ছুঁতে পারে। শুধু ভঙ্গিমা আলাদা। দর্শকের সঙ্গে যদি থিয়েটারের সংযোগ না ঘটে তো মুশকিল। আমার ধারণা দর্শককে বোকা বা অশিক্ষিত না ভেবে তাদের উপযোগী করে আমাদের প্রযোজনাগুলো তৈরি করা উচিত। বলতে চাইছি না যে লঘু করুন। দর্শক সবই বুঝতে চান। এই বুঝতে চাওয়াটাকে মান্যতা করা। একটি নাটকে কাচ কাটা হিরের মতো বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেললে আমার ধারণা দর্শক সেটা ছুঁতে পারবে। অনেক সময় আমাদের থিয়েটারগুলো কম্যুনিকেশনের নামে দর্শক বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। সেই কারণেই দর্শক পায় না বলে আমার মনে হয়। আরেকটা হচ্ছে থিয়েটারের কিছু দৈন্য থাকে। অর্থনৈতিক দৈন্য বা সামাজিক দৈন্যগুলোকে মুছে ফেলে, সেঁটে, প্রযোজনায় নিশ্চই আরও যতেœর ছাপ বেশি করে প্রয়োজন। থিয়েটার নিয়ে আপনার আগামী পরিকল্পনা কি? দেবশংকর হালদার : আমি প্রতিদিন থিয়েটার করি। অলমোস্ট প্রতিমাসে ২৫ থেকে ২৬টি নাটক করি। প্রতিদিনের ভঙ্গিমা আলাদা। নতুন কিছু করব বলাটা আমার কাছে স্লোাগান বলে মনে হয়। আমি যা যা প্রযোজনা করছি তার সঙ্গে এর বাইরের যেগুলো এখনও ছোঁয়া হয়নি, সেই সমস্ত টেক্সট করাার চেষ্টা করব। এখনকার বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বলুন। দেবশংকর হালদার : আমি পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রের কথা বলছি, কারণ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আমার তেমন দেখা হয় না। পৃথিবীব্যাপী এখন সিনেমার ধরন পাল্টাচ্ছে। চলচ্চিত্র দেখিয়ে গল্প তৈরি করার যে মুন্সিয়ানা এখন পরিচালকরা দেখাচ্ছেন সেটা খুব ভাল। এখন একটা টিফিনবাক্স নিয়ে সিনেমার গল্প তৈরি হয় এবং সেটা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। এটা আমরা আগে ভাবিনি। এখন এগুলো শুধু বিষয় হিসবে নয়, চিত্রগ্রাহক বা পরিচালকরা এমন সুন্দর ছবিও তুলছেন যাতে টেকনোলজি হেল্প করছে। আমার তো মনে হয়, নানান ধরনের কাজ হচ্ছে এবং বাংলা সিনেমা এগুচ্ছে। টিভি সিরিয়াল সম্পর্কে কিছু বলুন। দেবশংকর হালদার : টিভি সিরিয়াল নিয়ে আমার বেশি কিছু বলার নেই। দর্শক কি দেখতে চাইছে এটা নিয়ে ওরা সার্ভে করে। দর্শক অপছন্দ করলে ওরা বন্ধ করে। পুরোপুরি দর্শকের চাহিদার ওপর নির্ভর করে ওরা এটা চালায়। এতে টাকা পয়সাও পায়। মাঝে মধ্যে ভাল গল্পও থাকে। সিরিয়াল এমন একটি জায়গা যেখানে অভিনয়ের স্কোপ আছে। চেষ্টা হচ্ছে গল্পের একঘেয়েমিতা কমানোর। ওখানেও খুব আশাবাদী নই। আপনি তো রিয়েলিটি শোয়েরও উপস্থাপক। দেবশংকর হালদার : আমি একজন অভিনেতা। কখনও ভাবিনি এই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করব। আমি রিয়েলিটি শোতে বিশ্বাসী নই। আমাকে ওরা বলল, ‘হ্যাপি প্যারেন্টস ডে’ অনুষ্ঠানটি বাবা ও মা সম্পর্কে একটা মেসেজ আছে, সেটা আমার ভাল লেগেছিল। আমাদের মধ্যে থেকে সামাজিক মূল্যবোধ অনেক ক্ষেত্রে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই অনুষ্ঠানে এই ধরনের অবস্থান দেখে হয়তো নতুন করে সেই মূল্যবোধ জাগ্রত হয় বলে আমার ধারণা। - গৌতম পান্ডে
×