ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এম আজিজুল হক

চে-মরেও অমর যে বীর

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১১ অক্টোবর ২০১৭

চে-মরেও অমর যে বীর

কিংবদন্তি বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী ৯ অক্টোবর। অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও তার জনপ্রিয়তা এক বিন্দু কমেনি বরং বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য তার নিঃস্বার্থ প্রয়াস ও আত্মোৎসর্গেও কথা শুনে এখনও সবাই অভিভূত হয়। চে গুয়েভারা ব্যক্তি জীবনে একজন চিকিৎসক হয়েও বিপ্লবী ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে কিউবাকে সাম্রাজ্যবাদীদের কবল মুক্ত করেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভাগ বসাতে চাননি। ক্যাস্ট্রো তার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ আসন দিলেও তিনি তা অবহেলায় ত্যাগ করে বিশ্বের মেহনতী মানুষের জন্য বিপ্লবের ঝান্ডা কাঁধে তুলে নেন। তার লক্ষ্য ছিল কিউবার মতো লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও সাম্রাজ্যবাদীদের হটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে বিশ্বের ভুখানাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু সময়টা ছিল তার প্রতিকূলেÑ তার স্বপ্ন পূরণের পথে পাহাড় সমান বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। বিশ্ব তখন দু’ভাগে বিভক্ত একটি পুঁজিবাদী বিশ্ব ও অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত কমিউনিস্ট বিশ্ব। পরে এই জোটে চীনও যোগ দেয়। উভয় ব্লকের মধ্যে ‘কোল্ড ওয়ার’-বা স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ও উৎকণ্ঠা সব সময়ই বিরাজ করত। যেমন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোকে সাম্যবাদের পতাকাতলে আনার চেষ্টায় রত ছিল তেমনি মুক্ত বিশ্বের মোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র তার সিআইএসহ সমগ্র প্রশাসন যন্ত্র দিয়ে দেশে-বিদেশে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার চেষ্টায় সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যুত্থান, প্যাট্রিক লুমুম্বাসহ অনেক নেতার রহস্যজনক মৃত্যু, গুম, খুন ও অপহরণ তখন অনেকটা গা-সওয়া বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধের মূল কারণ ছিল একই। বিপ্লবী চে গুয়েভারার মৃত্যু বা হত্যাকা- ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট নিধন কর্মসূচীর ধারাবাহিকতার ফসল। চে তখন বলিভিয়াতে বিপ্লবী তৎপরতায় ব্যস্ত ছিলেন। সিআইএর কাছ থেকে পাকাপোক্ত খবর পেয়ে বলিভিয়া সামরিক বাহিনীর পাতা ফাঁদে চে তার কয়েকজন সহযোগীসহ আটকা পড়ে যান। তাদের গ্রেফতার করে ভেলিগ্র্যান্ড নামে একটি ছোট শহরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর তার দেহ প্রদর্শনের জন্য স্থানীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের খবর দেয়া হয়। এসব বিদেশী সাংবাদিকের মধ্যে এএফপি-সংবাদদাতা মার্ক হুটেনও ছিলেন। এই সাংবাদিক ২০১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিহত চে গুয়েভারার ও তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ দুই সহযোদ্ধার ছবি তোলে আনেন। তখন তার বর্ণনা ও ছবি বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মার্ক হুটেন বলেন, বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ থেকে প্রায় সাড়ে চার শ’ মাইল দূরে ভেলিগ্র্যান্ডে বিমান থেকে অবতরণের পর একটি পরিত্যক্ত গোয়ালঘরের দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ত্রিশজন সাংবাদিকের মধ্যে আমিসহ তিনজন ছিলাম বিদেশী সংবাদদাতা। ঘোয়ালঘরটি কিছুদিন যাবত অস্থায়ী মর্গ বা লাশ কাটাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে আমরা দেখি জলপাই রঙের প্যান্ট পরিহিত লম্বা চুল ও দাড়িবিশিষ্ট এক লোককে একটি স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার নিষ্প্রাণ খালি দেহে নয়টি গুলির চিহ্ন স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। চের মলিন বিবর্ণ দেহের ওপর ফরমালিন দেয়া ঝুলন্ত পানির পাত্র থেকে দ্রবণ নিঃসরিত হচ্ছিল যাতে করে সেখানের তীব্র গরমে শরীরে পচন না ধরে। ভেলিগ্র্যান্ড এলাকায় কমিউনিস্ট গেরিলা তৎপরতা দমনে নিয়োজিত কর্নেল আরনাল্ডো সসেডো সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, র‌্যামন নামের এই গেরিলা ভেলিগ্র্যান্ড থকে কয়েক কিলোমিটার দূরে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে রবিবার বন্দুক যুদ্ধে আহত হন এবং প্রচুর রক্তক্ষরণে সোমবার ভোরে তার মৃত্যু হয়। পরে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, র‌্যামনই চে গুয়েভারা। তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করা হয়েছে কী না এমন অভিযোগ কর্নেল আরনাল্ডো দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তবে এই কর্নেল যে নির্জলা মিথ্যে কথা বলছেন এ কথা প্রকাশ হতে খুব একটা বিলম্ব হয়নি। চে ও তার দুই সহযোদ্ধাকে যে সব সৈন্য বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছিল তারা শুনেছে যে, চে বিড় বিড় করে বলছিলেন, আমি চে গুয়েভারা, আজ আমি ব্যর্থ হলাম। মার্ক হুটেন বলেন, চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর খবরে চারদিকে গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুহূর্তের মধ্যে সাংবাদিক, আলোকচিত্র ধারক দল ও ক্যামেরাম্যানের ভিড়ে ভ্যালিগ্র্যান্ডের গোয়ালঘরের অস্থায়ী মর্গটিতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সবার মাঝে কেমন যেন অবিশ্বাস ও চিন্তার অসারতা নিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। এ সময় বলিভিয়ার এক সাংবাদিক আমাকে বলেন, আজ থেকে ভ্যালিগ্র্যান্ড নামটি দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া পেরিলা যুদ্ধে বলিভিয়ায় ৩৩ জন বিপ্লবী নিহত হন। তাদের মধ্যে বার জনেরও বেশি ছিল কিউবার নাগরিক। সবার লাশ ভ্যালিগ্র্যান্ড গোশালা মর্গে প্রদর্শন করা হয়। বলিভিয়ার সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আলপ্রেডো ওভানডো চে গুয়েভারার মৃত্যুর পর বেশ আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ঘোষণা করেন, জনসমর্থনের অভাবে বিপ্লবীদের গেরিলা এ্যাডভেঞ্চারের পরিসমাপ্তি হয়েছে। আমরা চে গুয়েভারাকে এই ভ্যালিগ্র্যান্ডের মাটিতেই সমাহিত করব। সে অনুযায়ী চে গুয়েভারা ভ্যালিগ্র্যান্ডের মাটিতে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর শায়িত ছিলেন। পরে তার দেহাবশেষ কিউবার সান্তাক্লারা স্মৃতিসৌধে স্থানান্তরিত হয়। -এএফপি
×