ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

হেরাথ- বুড়ো হাড়ে ভেল্কি

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১১ অক্টোবর ২০১৭

হেরাথ- বুড়ো হাড়ে ভেল্কি

আবুধাবীতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অনন্য এক রেকর্ডের মালিক হয়েছেন শ্রীলঙ্কান বোলার রঙ্গনা হেরাথ। টেস্ট ইতিহাসের প্রথম বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে নিয়েছেন ৪০০ উইকেট! ফর্ম আর সামর্থ্য নিয়ে সংশয় ছিল না। একমাত্র প্রশ্ন ছিল বয়স নিয়ে। তবে বয়সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যার ক্রমাগত এগিয়ে চলা, তার সামনে কী আর বয়স বাধা হতে পারে! ৩৯ বছর বয়সেও ক্ষুরধার, ঠিকই পূরণ করছেন লক্ষ্য। বয়সের দিক দিয়েও একটি মাইলফলক ছুঁয়েছেন ওই টেস্টে। এর মধ্য দিয়ে ৩৫ পার হওয়ার পর পর ইতিহাসের প্রথম পেসার হিসেবে স্পর্শ করেন ২০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক। অর্থাৎ ক্যারিয়ারে ৪০০ শিকারের ২০০টিই বয়স ৩৫ থেকে ৩৯Ñএর মধ্যে! অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি লেগ স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেটের ১৯২ ছিল আগের রেকর্ড। ৩৫ বছর পেরেনোর পর ১৮১টি নিয়েছিলেন আরেক অসি গ্রেট শেন ওয়ার্ন। আবুধবীতে শ্রীলঙ্কার নাটকীয় জয়ের টেস্টে আরেকটি জায়গাতেও হেরাথের হাত ধরে একটি প্রথমের জন্ম হয়েছে। প্রথম বোলার হিসেবে ছুঁয়েছেন কেবল পাকিস্তানের বিপক্ষেই ১০০ উইকেট। এতদিন কপিল দেবের ৯৯ ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের সর্বোচ্চ। শেষ উইকেটে আরেকটি সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়েছে হেরাথের। ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে তার শিকার ১০০ ছাড়িয়ে। এখানে ১৩৮ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে ওয়ার্ন, ১০৬ উইকেট নিয়ে দুইয়ে মুত্তিয়া মুরালিধরন। আর একমাত্র পেসার হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে একশ উইকেট গ্লেন ম্যাকগ্রার, ১০৩টি। সব মিলিয়ে ৪০০ উইকেট পাওয়া চতুর্দশ বোলার হেরাথ। তবে তার চেয়ে কম টেস্টে এই মাইলফলক ছুঁয়েছেন কেবল তিনজন। ৭২ টেস্টে ছুঁয়েছিলেন মুরালিধরন, রিচার্ড হ্যাডলি ও ডেল স্টেইন ৮০ টেস্টে। হেরাথের লাগল ৮৪ টেস্ট। পাকিস্তানের বিপক্ষে অভাবনীয় জয়ের এই ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছেন হেরাথ। ম্যাচে ১০ উইকেট ৯ বার। এর মধ্য দিয়ে স্পর্শ করেন হ্যাডলিকে। তার সামনে কেবল এখন ওয়ার্ন (১০ বার) ও মুরালিধরন (২২ বার)। ব্যক্তিগত অর্জনে টইটম্বুর ম্যাচটি পূর্ণতা পেয়েছে দলের অসাধারণ জয়ে। আবুধাবী টেস্টকে নিশ্চিতভাবেই কখনো ভুলবেন না হেরাথ। লঙ্কান ক্রিকেটে রঙ্গনা হেরাথ এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নাম। অস্ট্রেলিয়ায় যেমনটা ছিলেন স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল। দুরন্ত স্পিনার হয়েও ভরা যৌবনে দু’জনেরই দলে নিয়মিত জায়গা হয়নি। ম্যাকগিল যেমন শেন ওয়ার্নে, তেমনি গ্রেট মুত্তিয়া মুরলিধরনের ছাঁয়ায় ঢাকা পড়েছিলেন হেরাথ। মুরলির বিদায়ের পর টেস্টে লঙ্কান বোলিং আক্রমণকে একাই টানছেন। এ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের ইনুরির কারণে গত বছর নবেম্বরে জিম্বাবুইয়ে সফরে প্রায় ৩৯ ছোঁয়া বয়সে এসে প্রথম নেতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন! ওই সিরিজে প্রতিপক্ষকে কেবল ২-০তে ‘হোয়াইটওয়াশ’ই করেননি, বুড়ো বয়সে উইকেট শিকারেও দারুণ সব অর্জন ঝুলিতে পুড়েছিলেন কুরু নাগালার এই বাঁহাতি অফস্পিনার। হারারেতে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে মুরলিধরন ও ডেল স্টেইনের পর বিশ্বের মাত্র তৃতীয় বোলার হিসেবে সব কটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে ইনিংসে পাঁচ শিকারের রেকর্ড গড়েন। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮, ম্যাচে ১৩ উইকেট নেয়ার পর নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন নাদুশ-নুদুশ চেহারার হেরাথ। ওই সিরিজেই মুরালির পর দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে কম টেস্টে ৩৫০ উইকেটের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেন লঙ্কান ঘূর্ণিজাদুকর। এজন্য হেরাথের লাগে ৭৫ টেস্ট, সবার ওপরে থাকা মুরলিকে খেলতে হয়েছিল মাত্র ৬৬ টেস্ট! হেরাথ এ তালিকায় সর্বোপরি সপ্তম স্থানে। তালিকায় পাঁচ জনই পেসার। তারা হলেন- নিউজিল্যান্ডের স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন, অস্ট্রেলিয়ার ডেনিস লিলি, গ্লেন ম্যাকগ্রা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাকলকম মার্শাল। ৭৭ টেস্টে সাড়ে ৩ শ’ উইকেট নিয়ে এর পরেই আছেন সাবেক ভারতীয় লেগস্পিনার অনিল কুম্বলে। ক্যারিয়ারের সাঁঝবেলায় বল হাতে হোরাথ যেন তরুণ হয়ে ওঠেন। নইলে দুই ম্যাচে ১৯ উইকেট! দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫-৮৯ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৮-৬৩Ñ জিম্বাবুইয়ের মাটিতে ম্যাচে যা সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড। আগে যেটি ছিল ইরফান পাঠানের (১২-১২৬)। ম্যাচে হেরাথের বোলিং ছিল ১৩-১২৫। অধিনায়ক হিসেবে যা ওয়াকার ইউনুস ও কোর্টনি ওয়ালসের সঙ্গে যৌথভাবে সেরা। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ালস নিয়েছিলেন ১৩-৫৫ ও ১৯৯৩Ñএ এই জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সাবেক পাক অধিনায়ক ওয়াকারের বোলিং ১৩-১৩৫। হেরাথের আগে অধিনায়ক হিসেবে ইনিংসে ৮ উইকেট নেয়া সর্বশেষ বোলার ছিলেন কপিল দেব, সেটি ৩১ বছর আগে, ১৯৮৫ সালে। মুরলি অতিমানবীয়, অবিশ্বাস্য নইলে কি আর হেরাথের মতো এমন একজনকে দিনের পরদিন সাইডলাইনে থাকতে হয়। এমন কি ক্যারিয়ারে সাড়ে ৩শ’ উইকেট নিতে গ্রেট ওয়ার্ন (৮০) আর হরভজন সিংয়েরও (৮৩) তার চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে গলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমন। ১৮ বছরে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৮৫টি টেস্ট, সেটি যে মুরলির দাপটের কারণে, তা বলাইবাহুল্য। ইনিংসে ৩৩ বার নিয়েছেন ৫ বা ততোধিক উইকেট। ম্যাচে ১০ উইকেট ৯ বার। ইনিংসে ৬৭ বার ৫ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে মুরলিধরন। আবার কষ্টটাই হেরাথের সান্তনার জায়গা, পূর্বসূরি মুরালির ভা-ারেই তো টেস্টের যত রেকর্ড! আনন্দ, গ্রেটের বিদায়ের পর পাওয়া সুযোগ শতভাগ কাজে লাগিয়ে দেশকে দু-হাত ভরে দিতে পারছেন। হেরাথ তো ‘অনসাং’ হিরোই। তুমুল প্রতিভাবান, তুখোড় পারফর্মার হয়েও ‘ভাগ্যের ফেরে’ শ্রীলঙ্কার হয়ে নিয়মিত খেলার সুযোগ পাননি! লঙ্কান ক্রিকেটে তার জন্মটা যে হয়েছিল ভুল সময়ে! মুরলিধরনের সময়ে!! ‘আমার যা বয়স তাতে ১০-১৫ বছর আগের মতো পারফর্ম করা সম্ভব নয়। এ সময়ে অনেকবার ইনজুরির সঙ্গে লড়তে হয়েছে। চল্লিশের কাছাকাছি গিয়ে আপনি ফিটনেসের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। ক্যারিয়ারজুড়ে সবসময় দলকে শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করেছি। বোঝা হয়ে ওঠার আগেই সরে যেতে চাই। চেষ্টা থাকবে বেশি বেশি টেস্ট ম্যাচ খেলার এবং দলের জন্য নিজের সেরাটা বিলিয়ে দেয়ার।’ কষ্ট চেপে মন্তব্য হেরাথের।
×