ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

প্রোটিয়া ভূমিতে ভরাডুবি- নতুন কিছু নয়

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১১ অক্টোবর ২০১৭

প্রোটিয়া ভূমিতে ভরাডুবি- নতুন কিছু নয়

গত তিন বছর ধরে যা হয়নি, সেই ভাগ্যই এবার বরণ করতে হয়েছে। এমন পরাজয়ই শুধু নয় টেস্ট ক্রিকেটে ধারাবাহিক হারটাই ভুলে যেতে বসেছিল বাংলাদেশ দল। পরাজয়ের পাশাপাশি ড্র কিংবা জয়ও এসেছে গত ২ বছরে। কিন্তু তিন বছর পর আবার ইনিংস হারের লজ্জা সঙ্গী হয়েছে এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। ইনিংস ব্যবধানে হার যেন ভুলেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। সাড়ে তিনবছর ধরে সেই হারের খপ্পরে পড়েনি বাংলাদেশ। উল্টো জয়ও মিলছিল। গত বছর ইংল্যান্ডকে হারানোর পর এ বছর শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইনিংস ও ২৪৮ রানে যে হেরেছিল বাংলাদেশ, আবার সেই হারের গোলক ধাঁধায় আটকা পড়ল প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে। ইনিংস ও ২৫৪ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়ে দুই টেস্টের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়। আর এই হারের জন্য মূলত প্রোটিয়া পেস আক্রমণ দায়ী। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা শর্ট অব লেন্থের এবং বাউন্সি বলের বিরুদ্ধে যে কতটা অসহায় এখনও সেটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। দুই টেস্টে বাংলাদেশের ৪০ উইকেটের মধ্যে ৩০টিই শিকার করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার পেসাররা। যদিও এই পেস আক্রমণে ছিলেন না দুই অন্যতম পেসার ডেল স্টেইন, ভারনন ফিল্যান্ডার। দ্বিতীয় টেস্টে ছিলেন না আরেক অভিজ্ঞ মরনে মরকেল। তবু ব্যাটিং বিপর্যয় ঘটেছে প্রোটিয়া পেসের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এর আগেও ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। এবার সিরিজের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে চার টেস্টে খেলেছে বাংলাদেশ, চারটিতেই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে। এবার পোচেফস্ট্রুম টেস্টে সেই ইনিংস ব্যবধানে হার এড়িয়েছে বাংলাদেশ। তবে ব্লুমফন্টেইনে আবারও ইনিংস ব্যবধানে হার দেখতে হলো। সেই হারটি আবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সবচেয়ে বাজে হার হয়েছে। সবচেয়ে বড় হার হয়েছে। এমন দুর্দশায় এর আগে কখনই পড়েনি বাংলাদেশ। এবার পড়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ৬ টেস্ট খেলে সবকটিতে হার হলো বাংলাদেশের। এরমধ্যে ৫টি টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হার হয়েছে। ২০০৮ সালে সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেছিল বাংলাদেশ। প্রায় ৯ বছর পর আবার খেলতে নামল। এবারও একই দশা হলো। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনবার দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলে সবকটিতে হোয়াইটওয়াশও হলো বাংলাদেশ। এবারতো সবচেয়ে বড় হারটিই হয়ে গেল। আবার ৯ বছর আগের সেই পুরনো দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশকেই যেন দেখা গেল। অথচ বাংলাদেশ দল সাম্প্রতিক সময়ে অনেক সাফল্য পাচ্ছিল টেস্ট ক্রিকেটেও। শ্রীলঙ্কার মাটিতে সাধারণত সফরকারী দলগুলো সবসময়ই সমস্যায় পড়ে। এবার মার্চে সেই শ্রীলঙ্কাকেও তাদের মাটিতে হারিয়ে দেয়। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হারলেও দুই টেস্টেই পুরো ৫ দিন ভাল ক্রিকেট খেলেছে। অন্তত ম্যাচ শুরুর আগেই হেরে যায়নি। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে যেন এলোমেলো হয়ে গেছে দল। এবার যেন সেই আত্মবিশ্বাসী মনোভাব কিংবা শরীরী ভাষায় প্রত্যয় একেবারেই দেখা যায়নি। এমনই পরিস্থিতি, যেন মনের বাঘেই ক্রিকেটারদের খাচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা বোলারদের বলগুলোকে মোকাবেলা করা কঠিন। এমন ভীতি যেন ব্যাটসম্যানদের ভেতর ঢুকে গেছে। তা না হলে কী আর এমন দশা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আলোচনায় ছিল পেস আক্রমণ। এখানকার কন্ডিশনে সাধারণত পেসাররাই সুবিধা পেয়ে থাকেন। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শুরু থেকেই মূল আলোচনা ছিল স্বাগতিকদের পেস আক্রমণকে মোকাবেলা করার কৌশল তৈরি করা। কিন্তু সেই কৌশলে ব্যর্থ হয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। প্রথম টেস্টে পেসারদের পাশাপাশি স্পিনার কেশভ মহারাজের ঘূর্ণিতেও ভেঙ্গে পড়েছিল বাংলাদেশের ইনিংস। কিন্তু ব্লুমফন্টেইনে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে পুরোটাই ছিল পেসারদের দাপট। কাগিসো রাবাদা একাই দুই ইনিংসে ধসিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও তিনি ৫ উইকেট শিকার করেন। ক্যারিয়ারের ২২তম টেস্টে এর মাধ্যমে ১০০ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান রাবাদা আর তৃতীয়বারের মতো নেন ম্যাচে ১০ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট দলে এবার অন্যতম দুই পেসার ডেল স্টেইন ও ভারনন ফিল্যান্ডার নেই। কিন্তু প্রথম টেস্টে নামার পর তাদের অভাবটা টেরই পাওয়া যায়নি। দুই পেসার রাবাদা ও মরনে মরকেলের গতির কাছে দিশেহারা হয়ে গেছে বাংলাদেশ দল। পোচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে প্রোটিয়া পেসাররা বাংলাদেশের ১১ উইকেট দখল করেন। দ্বিতীয় ইনিংসে মরকেল প্রথম ওভারেই দুই উইকেট নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তবে ইনজুরিতে পড়ে ইনিংসের ১১তম ওভারেই তিনি মাঠের বাইরে চলে যান। তবে তার অভাবটা বুঝতেই দেননি রাবাদা। পরদিন তিনি নেন ৩ উইকেট। তার সঙ্গে তরুণ ডুয়ান অলিভিয়েরও দারুণ বোলিং করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কোণঠাসা করেন। আর তাদের গতির সঙ্গে বলের ওপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ, সুইং ও বাউন্সের বিরুদ্ধে পুরোপুরি অসহায় হয়ে একের পর এক আত্মসমর্পণ করেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। গত ১০ বছরে টেস্টে নিজেদের সবচেয়ে খারাপ ব্যাটিংয়ের চিত্রটা দেখা যায়। মাত্র ৯০ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৬২ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল। তারপর এটিই ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে যাওয়ার ঘটনা মুশফিকুর রহীমদের। এবার ইনজুরির কারণে বাংলাদেশের অন্যতম ওপেনার তামিম ইকবাল দ্বিতীয় টেস্টে খেলতে পারেননি। প্রথম টেস্টে পুরোপুরি ফিট না হয়েও খেলতে নামেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি ফিটনেসের কারণেই। ৩৩৩ রানের বড় ব্যবধানে হারের লজ্জার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১১ টেস্ট খেলার ইতিহাসে সর্বনি¤œ সংগ্রহে গুটিয়ে যাওয়ার কলঙ্ক যোগ হয়। তবে ব্লুমফন্টেইন টেস্টে ভীতি কাটিয়ে ওঠার প্রত্যয় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাসী কথা শুনিয়েছিলেন মুশফিক। সেটা হয়তো সম্ভবও ছিল। কারণ প্রোটিয়া পেসার মরকেলও ইনজুরির কারণে এই টেস্টে খেলতে পারেননি। ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণ আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। মাত্র দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার হলেও রাবাদা ২১ টেস্ট খেলে দলের পেস আক্রমণে সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তার সঙ্গে তরুণ অলিভিয়ের এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ পুরনো কিন্তু টেস্টে কম অভিজ্ঞ ওয়েন পারনেলকে নিয়ে আক্রমণ সাজায় প্রোটিয়ারা। এরপরও পেস আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা কতটা অসহায় সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় প্রথম ইনিংসেই। পোচেফস্ট্রুমের মতোই ব্যাটিং স্বর্গ ছিল ব্লুমফন্টেইনে। দক্ষিণ আফ্রিকা ওভারপ্রতি ৪.৭৭ করে মাত্র দেড় দিনে ৪ উইকেটে ৫৭৩ রান তোলার পর সেটা সঠিক প্রমাণিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতাটা বেশ ভালভাবেই জেনে গিয়েছিল প্রোটিয়ারা। ব্যাটিং উইকেটেও প্রোটিয়া পেসারদের সুইং, বাউন্স আর শর্ট লেন্থের বলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন ব্যাটসম্যানরা। আর এর পুরো কৃতিত্বই দেখিয়েছেন রাবাদা। প্রথম ইনিংসে তিনি শিকার করেন ৫ উইকেট, অলিভিয়েরের ঝুলিতে আসে ৩টি এবং পারনেল নেন ১টি উইকেট। পেসারদের দাপটে মাথা নত করে বাংলাদেশ ৯ উইকেট খুঁইয়ে অলআউট হয় মাত্র ১৪৭ রানে। পেসারদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ইনিংসে আরও করুণ আর্তনাদ দেখা গেছে ব্যাটসম্যানদের। শর্ট অব লেন্থের বলে শুরু থেকেই ব্যাটসম্যানরা উল্টাপাল্টা খেলেছেন। তাদের ব্যাটিংয়েই পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে পেসভীতি। এমনকি অভিজ্ঞ মুশফিকও ঠিকমতো গতি ও বাউন্স বুঝতে ব্যর্থ হয়ে রাবাদার বলে হেলমেটে আঘাত পান। চার পেসার দিয়েই অবিরাম বোলিং চালিয়ে গেছে প্রোটিয়ারা বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের অসহায়ত্ব দেখে। রাবাদা, আন্দিলে ফেহলুকোয়াও মিলে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেন। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৭২ রানেই দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। আবার ৫ উইকেট রাবাদার, ফেহলুকোয়াওয়ের ৩ এবং পারনেল ও অলিভিয়ের নেন বাকি দুই উইকেট। স্পিনার মহারাজ মাত্র ৬ ওভার বোলিং করেছেন। বাকি ৩৬.৪ ওভার বোলিং করে বাংলাদেশের ১০ উইকেট তুলে নিয়েছেন প্রোটিয়া পেসাররা। তাদের কাছেই হারল বাংলাদেশ দল। এ কারণেই প্রোটিয়া অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিস ম্যাচশেষে বললেন, ‘গত এক দুই বছরে ওদের খেলা দেখলে দেখবেন ওরা কিন্তু ভাল মানের টেস্ট দল। তাই আমি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আশা করেছিলাম। ওদের সিরিজ জেতার আশা হয়ত করিনি। কিন্তু মনে করেছিলাম কয়েক সেশন হয়তো ওরা আমাদের চাপে রাখবে। সহজ ভাষায় বাউন্স খেলাটা এখানে অস্বস্তিকর। তাই শর্ট বলের ভয়টাকে কাটিয়ে উঠতে হবে ওদের। আর পরিকল্পনা যদি থাকে, যে কিভাবে এর মুখোমুখি হবেন, তাহলে আরও ভাল করা যাবে।’
×