ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্বা বর্ধনের মা বললেন মেয়ে গেম খেলে মারা গেছে এ কথা বলিনি, মিডিয়া ভুল প্রচার করেছে

বাংলাদেশে ব্লু হোয়েল খেলে কেউ মারা গেছে এমন নজির নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১১ অক্টোবর ২০১৭

বাংলাদেশে ব্লু হোয়েল খেলে কেউ মারা গেছে এমন নজির নেই

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘মেয়ে ব্লু হোয়েলে আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে তা কিন্তু আমরা বলিনি। আমরা সন্দেহ করেছি। তবে মারা যাওয়ার ৮-১০ দিন আগে থেকে ও খুব অন্যমনস্ক ছিল। তার আচরণে মনে হয়েছে সে কোথাও একটা দুঃখ পেয়েছে। দেখা যেত সে হাসছে। কিন্তু হঠাৎ করে যেন কোথায় হারিয়ে যেত। জিজ্ঞেস করলে হেসে হেসে বলত কিছুই হয়নি তো মা! তবে মেয়েটা আমার ইন্টারনেটের প্রতি খুব আসক্ত ছিল। সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করত এমন নয়। যতক্ষণ বাসায় থাকত ততক্ষণই তার হাতে মোবাইল থাকত। স্কুল থেকে এসেই মোবাইল নিয়ে বসে পড়ত। সে আমার মোবাইল ব্যবহার করত। তবে বাইরে যাওয়ার সময় সব এ্যাপসে প্যাটার্ন লক দিয়ে যেত। মেয়ে মোবাইলে কী করত তার সবকিছুই আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত।’- কথাগুলো বলছিলেন সদ্য আত্মহননের পথ বেঁছে নেয়া কিশোরী অপূর্বা বর্ধনের মা সানি বর্ধন। রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের এই ছাত্রী ব্লু হোয়েল গেমসের মরণফাঁদে পা দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়। তবে তার পরিবার এমনটি মনে করছে না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মেয়ের হাতে নীল তিমির আঁকা কোন ছবি পাওয়া যায়নি! মঙ্গলবার রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে অপূর্বাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শোকে বিহ্বল পুরো পরিবার। যেন সব কিছু থেমে গেছে। বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন অপূর্বার বাবা সুব্রত বর্ধন। থেমে থেমে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কখনওই সরাসরি বলিনি আমার মেয়ে ব্লু হোয়েল গেমের শিকার। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টের সময় জুইই প্রথম বলে অপূর্বা সম্ভবত ব্লু হোয়েল গেমসে আক্রান্ত হয়েছে। ওরও মনে হয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল। তবে এটি প্রমাণিত সত্য নয়। আর আমি কোথাও বলিনি আমার মেয়েসহ এতজন ব্লু হোয়েল গেমসে আক্রান্ত হয়েছে। গণমাধ্যমে আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ প্রসঙ্গত, জুই অপূর্বার পিসি। তিনিই প্রথম অপূর্বার মৃত্যুর পেছনে ব্লু হোয়েল প্রসঙ্গ টেনে আনেন। দিয়েছিলেন ফেসবুকে স্ট্যাটাসও। পরে অবশ্য এক স্ট্যাটাসে তিনি তার সন্দেহের কথা জানিয়ে বলেছেন, ব্লু হোয়েল নিয়ে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই তবে মেয়ের হাতে নীল তিমির আঁকা কোন ছবি পাওয়া যায়নি। রাজধানীর সেন্ট্রাল রোড এলাকাটি নিউ মার্কেট থানার আওতাধীন। অপূর্বার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা করা না হলেও বিষয়টি তদন্ত করছে নিউ মার্কেট থানা পুলিশ। জানতে চাইলে নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে তদন্ত করছি। তবে অপূর্বার হাতে নীল তিমির আঁকা কোন ছবি পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত তদন্ত করে আমরা ব্লু হোয়েলের কোন অস্তিত্ব পাইনি। তারপরও তদন্ত অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ওর নিজের কোন মোবাইল ছিল না। মায়ের মোবাইল ব্যবহার করত। আমরা মোবাইলের বিভিন্ন এ্যাপস চেক করেছি। তবে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছিÑ বাংলাদেশে ব্লু হোয়েল গেমস খেলে কেউ আত্মহত্যা করেছে এমন কোন নজির নেই। মঙ্গলবার সরেজমিনে অপূর্বার রুমে গিয়ে দেখা যায়, বেশ সাজানো গোছানো সব। হাতের চুড়ি, ফুলের টব, দামী পারফিউম সবই আছে। টেবিলে সাজানো সম্মাননা সার্টিফিকেট। বুক সেলফে হুমায়ূন থেকে রবীন্দ্রনাথ। শেক্সপিয়ারও আছে। তিনটি ভূতের বইও পাওয়া গেল। আর পড়ার টেবিলে ক্রেস্টের ঠিক ওপর দিকে শোভা পাচ্ছে শিশু অপূর্বার ছবিও। বিছানার পূর্ব দিকে বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গেও তার বিশাল ছবি। সবই আছে- তবে নেই শুধু অপূর্বা! পরিবার ও আশপাশের মানুষের চালচলনই বলে দিচ্ছে শূন্যতায় গ্রাস করছে পুরো বাড়ি। দীর্ঘ কথা হয় অপূর্বার বাবা সুব্রত বর্ধনের সঙ্গে। মেয়ের মৃত্যুর পেছনে ব্লু হোয়েল গেমসকে তিনি সন্দেহ করছেন ঠিকই তবে ইন্টারনেটের অপব্যবহারকেই দুষছেন বেশি। জানালেন ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও ব্লু হোয়েল গেম সম্পর্কে সবার আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। ইন্টারনেটের অপব্যবহারে কথা জানিয়ে অপূর্বার বাবা সুব্রত বর্ধন জনকণ্ঠকে বলেন, সবার এখন গভীর রাত পর্যন্ত জাগার অভ্যাস হয়ে গেছে। এতে কিশোর-কিশোরীরা ইন্টারনেটের অপব্যবহারে জড়িয়ে পড়ছে। আমার মেয়েও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকত। দেখা যেত সে পড়ছে। হাতে মোবাইল থাকত। মোবাইলে স্টাডির কথা বলত। একদিন রাত তিনটায় মেয়ের রুমে গিয়ে দেখি সে সজাগ। মেয়েকে বলি মা তুমি এখনও জেগে আছো? কয়টা বাজে? বুঝতে পারলাম সময়ের দিকে মেয়ের কোন নজর নেই। তখন তার মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি একটা প্যারাগ্রাফ। সন্দেহ করে নিজেই লজ্জায় পড়ে যাই। এরপর থেকে সন্দেহ কমে যায়। তবে সে নেটে কী করত তা আমরা জানতাম না। তিনি বলেন, মেয়ে হ্যাং আউটে যেতে চাইত। একবার তার মায়ের কাছে আবদার করে। যেতে দিইনি। তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে সে আমাদের এড করেনি। পাসওয়ার্ড বা মেইল দিত না। তার ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের কোন কিছুই আমাদের সঙ্গে শেয়ার করত না। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ব্লু হোয়েল গেমসের শিকার কিশোর-কিশোরী। বড়দের আক্রান্ত করা যায় না। কিশোর-কিশোরীদের বাঁচাতে গেলে এ গেমটা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আমার মেয়েটা গেছে। আমি চাই আমার মেয়ের বিনিময়ে হলেও যেন সচেতনতা তৈরি হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেয়ে মৃত্যুর পূর্বে মোবাইলের সব কনভার্সেশন ডিলিট করে গেছে। খুব পরিকল্পিতভাবে সে আত্মহত্যা করছে। সে তার বড় আপুদের সঙ্গে মিশত। তার স্কুলের বড় আপুরা কী করে তা নিয়েও আমার সন্দেহ হয়। অপূর্বার মা সানি বর্ধন জনকণ্ঠকে বলেন, স্কুলে ওর বান্ধবী থাকলেও আজকাল ওদের সঙ্গে তার তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুকে তার ফ্রেন্ড ছিল। একটা গ্রুপ ছিল। ওদের সঙ্গে বেশি সময় দিত। ও মারা যাওয়ার একদিন পর ওই গ্রুপ থেকে তিন-চারজন কল দিয়েছে। রাদিন নামের একটা ছেলে ফোন দিল। অপূর্বা সম্পর্কে সে জানতে চাইল। সামির আহমেদ নামের একটা ছেলে গেম সম্পর্কে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু তখন আমি খুব বিপর্যস্ত থাকায় বুঝতে পারিনি। এই তিন-চারটা মেয়ে সবাই কিন্তু ওর থেকে খুব বড়। খুব বেশি সিনিয়র। ওরা গ্রুপভিত্তিক হ্যাং আউটে যেতে চাইত। রাদিন ওদের ওই গ্রুপের ভাইয়া। অপূর্বা আমাকে এর আগেও রাদিনের সঙ্গে একবার কথা বলিয়ে দিয়েছিল। তার এই ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ হয়। কারণ একটা মেয়ে তো হঠাৎ করে আত্মহত্যা করতে পারে না। হয়ত কিছু না কিছু একটা হয়েছিল। ছেলে ও মেয়ের মাঝে তো খুব বেশিদিন বন্ধুত্ব থাকে না। হয় না। তবে আমরা কাউকে সন্দেহ করছি না। রাদিনের সঙ্গে হ্যাং আউটে নেয়ার জন্য আমাকে এর আগেও কল দিয়েছিল। অন্য একটা গার্ডিয়ানকে দিয়েও কল করানো হয়েছিল। শুনেছি রাদিন বনানীতে একা থাকে। আর তার দেশের বাড়ি বগুড়া। ওর বাবা খুব সম্ভবত আওয়ামী লীগের একজন নেতা। হয়ত এমপি পদেও দাঁড়িয়েছিল। তানজিম তাজরিন নামে একটা মেয়ের সঙ্গেও ওর খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। কিছু একটা হলেই বলে উঠত তানজিম আপু। তানজিম আপু। এই একই মেয়ের আরেক নাম পারসিফোনা। এই মেয়েটার সঙ্গেও অপূর্বার খুব ভাব ছিল। সে নাকি ভিকারুন্নিসায় টেনে পড়ে। কোন ক্ষেত্রে এদের দ্বারাও প্ররোচিত হতে পারে। তবে কাউকে দোষ দিচ্ছি না। ব্লু হোয়েল গেম ॥ ২১ বছর বয়সী রুশ ছাত্র ফিলিপ বুদেইকিন ২০১৩ সালে প্রথম ব্লু হোয়েল গেমটি তৈরি করেন। তার পড়াশোনার বিষয় ছিল মনোবিজ্ঞান। এই গেম ২০১৬ সাল থেকে ছড়াতে থাকে। গেমটির মূল লক্ষ্য দুর্বলচিত্তের মানুষ, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা। চলতি বছর পর্যন্ত রাশিয়া, ভারতসহ ব্লু হোয়েল গেম খেলে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর এসেছে। যেভাবে খেলা হয় ॥ ব্লু হোয়েল অন্য গেমগুলোর মতো ইন্টারএ্যাকটিভ নয়। এই গেম খেলোয়াড়ের কাছে লিখিত বার্তায় গেম এডমিনিস্ট্রেটরের নির্দেশনা আসে। সেখানে একটা একটা করে কাজের নির্দেশ বা চ্যালেঞ্জ থাকে। সে কাজটা করার পর ছবি তুলে বা ভিডিও করে গেম এডমিনিস্ট্রেটরকে পাঠাতে হয়। এভাবে ৫০তম ধাপ বা ৫০তম দিনে সবশেষ নির্দেশটি আসে। এই নির্দেশটি হলো আত্মহত্যা করার। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে গেমে আসক্ত হয়ে পড়ায় তখন আর খেলোয়াড়ের স্বাভাবিক কা-জ্ঞান থাকে না। গেমের মরণফাঁদে পা দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। ইন্টারনেট দুনিয়ায় নিষিদ্ধ ব্লু হোয়েল গেম ব্লু হোয়েল একটি অনলাইন গেম। তবে এটি ইন্টারেনেটে প্রকাশ কোন ওয়েবসাইটে (পাবলিক ডোমেইন) পাওয়া যায় না। ইন্টারেনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপি এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, এই গেম কোন ওয়েবসাইট বা এ্যাপ স্টোরে থাকে না। কারও কাছ থেকে পাওয়া ওয়েবসাইটের ঠিকানা (লিংক) থেকে গেমটি নামিয়ে (ডাউনলোড) নিয়ে খেলতে হয়। সংগঠনটির মতে, বাংলাদেশে কোন নেটওয়ার্কে এখনও ব্লু হোয়েলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে সত্যিই ব্লু হোয়েল গেমের কোন অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অনলাইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুগল প্লে স্টোরে ব্লু হোয়েলের কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ কেউ বলছেন, ডার্ক ওয়েবে আছে। তবে ডার্ক ওয়েবে সাধারণ ব্যবহারকারী পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশ থেকে ডার্ক ওয়েব ব্যবহারও ততটা সহজ নয়। আবার অনেকে ধারণা করছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লু হোয়েলের লিঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে এর সত্যতাও মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্লু হোয়েল গেম সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে।
×