ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চাপ না থাকলে মিয়ানমার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী নাও হতে পারে ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১১ অক্টোবর ২০১৭

চাপ না থাকলে মিয়ানমার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী নাও হতে পারে ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান না হলে আগামীতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওপর নিরাপত্তা হুমকি দেখা দিতে পারে। এই সঙ্কটের ফলে এই অঞ্চলে জঙ্গী ও উগ্রবাদের বিকাশ হতে পারে। সে কারণেই এটা এখন কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এটি এখন আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ পেয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলায়তনে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াকে ‘জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট : বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে সমাপনী বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে তাদের ফিরিয়ে নেয়ার দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত না থাকলে মিয়ানমার মূল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী নাও হতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের আংশিক ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমিত করার কৌশল হতে পারে। মিয়ানমার নিজস্ব যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা সীমিত করার এবং নানা অজুহাতে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন বিলম্বিত করতে পারে। মাহমুদ আলী বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে সুচির এনএলডি সরকার রাখাইনে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও জীবনযাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ইতিবাচক নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে এবং সামরিক বাহিনী নেতিবাচক কর্মকা- থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। তারা যেন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাধ্য হয়, বাংলাদেশ সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, মিয়ানমারে মূল সমস্যার সমাধান এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে তাদের ফিরিয়ে নেয়া। তিনি বলেন, প্রথম ক্ষেত্রে মূল সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ অন্যান্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ করে দিতে হবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অপপ্রচার, ধর্মীয় বিদ্বেষ, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ প্রয়োগ না করলে মিয়ানমার মূল সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হবে বলে মনে হয় না। নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তৎপর হতে হবে। সঙ্কটের দ্বিতীয় অংশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াকে ‘জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী’ হিসেবে বর্ণনা করেন মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রেও মিয়ানমারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। সেখানে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশে সৃষ্টি করতে হবে। নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও জীবিকার নিশ্চয়তা না পেলে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ জোরালো ভূমিকা রাখছে- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ॥ পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত না করে তাদের জোর করে মিয়ানমার পাঠানো যাবে না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ ইইউসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জোরালো ভূমিকা পালন করছে। তবে মিয়ানমার চায় আমরা রোহিঙ্গাদের যেন শরণার্থী ঘোষণা করি। এটা করলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার পাঠানো কঠিন হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটিই একমাত্র সমাধান নয়। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরত আসার জন্য সবচেয়ে বেশি সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। কিন্তু তারাই বর্তমানে মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনার তীব্র নিন্দা করছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সহমত পোষণ করছে।’ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলছি না নিরাপত্তা পরিষদে কোন রেজ্যুলেশন আসবে না, তবে এই তিন পক্ষের সহায়তায় আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব।’ পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত রয়েছেন। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন। আমরা সেই কঠিন কাজটিই অব্যাহত রেখেছি। অনুষ্ঠানের উন্মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক, শিক্ষক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় তাদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব। গোলটেবিল আলোচনায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্লান বি হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে এগোতে হবে। এখানে আলোচনায় জেনেছি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সরকার থেকে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে গণমাধ্যমে যথাযথ আসেনি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশে নয়। মিয়ানমারের আশপাশেও আশ্রয় নিচ্ছেন। থাইল্যান্ডেও রোহিঙ্গা রয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে এসব দেশের সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
×