ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইন যথাযথ প্রয়োগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ অক্টোবর ২০১৭

আইন যথাযথ প্রয়োগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

বিকাশ দত্ত ॥ বাংলাদেশে অনেক আইনই আছে। কিন্তু কিছু কিছু আইনের কোন কার্যকারিতা নেই। অর্ধশতাধিক আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। আইনের শাসনের মূল মন্ত্রই হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বাংলাদেশে অনেক আইন থাকলেও যথাযথ প্রযোগ না হওয়ার কারণে মানুষ আইনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইনজীবীগণ বলেছেন, সরকার ও প্রশাসনযন্ত্রের সকল স্তরে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনগুলো সকল ক্ষেত্রে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তা হলেই জনগণ ন্যায়বিচার পাবে। যানবাহনগুলোতে অবাধে ব্যবহƒত হচ্ছে হাইড্রলিক হর্ন, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯, ভোজ্যতেলের ভিটামিন এ সমৃদ্ধআইন-২০১৩, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন, গ্রাম আদালত আইন, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনবার্সন) আইন-২০১১, পলিথিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১০, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩, মোটরযান নিযন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৬৩, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, বাংলাভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭, ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯, কপিরাইট আইন ২০০০, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০সহ আরও অনেক আইন আছে। এ ছাড়া অর্পিত সম্পত্তি আইনের ‘খ’ তালিকা করা হয়েছে, কিন্তু জমির মালিকেরা এখন পর্যন্ত নামজারি করতে পারছে না। নিয়মিত মাত্রার পলিথিন ব্যবহারের ওপর সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও আজও গ্রামগঞ্জে পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। এ সমস্ত আইন আছে কিন্তু বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই। ফলে মামলার জটিলতা যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাও হারাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বর্তমান আইনমন্ত্রী ও সাবেক আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইন প্রয়োগের বিষয়ে আইন আছে। সে সমস্ত আইন যেখানে প্রযোজ্য সেখানে আইনের প্রয়োগ করা হচ্ছে। কোন কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া হলে বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী রক্ষা করে রাজধানী ঢাকাকে ভেনিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সংবিধানে এবং আলাদা আইনে খাল নদী পুকুর জলাধার ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে ভরাট অব্যাহত রয়েছে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো বন্ধ না করতে পারলেও আদালত একটি আদেশ প্রদান করেছে। গত ৮ অক্টোবর মালিক-চালকদের কাছে থাকা যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত আদেশের পুলিশ প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এর আগে গত ২৩ আগস্ট রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ২৭ আগস্টের পর কোন গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা হলে ওই পরিবহন জব্দেরও নির্দেশ দেয় আদালত। বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭ হাজার মৃত্যুবরণ করে এবং পঙ্গুত্ববরণ করে প্রায় ৪ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৯৬ হাজার লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধূমপানজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ৪৩% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করে। এ হিসেবে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ, যার মধ্যে ২৩% ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করে এবং ২৭.২% ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের প্রবণতা নারীদের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৬৩% লোক অর্থাৎ ১ কোটি ১৫ লাখ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ৪৫% অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। দি টোব্যাকো এটলাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪.৬% পুরুষ ও ৫.৭ % মহিলা তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়। যা অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশের গড় থেকে বেশি। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের (পরোক্ষ ধূমপান) প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১৬৫০০০ জনই হলো শিশু। শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও এ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ শ্বাস প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় এও বেরিয়ে এসেছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর ওপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮১,০০০জন নারী মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, আইন প্রয়োগের বিষযে আইন আছে। সে সমস্ত আইন যেখানে প্রযোজ্য সেখানে আইনের প্রয়োগ করা হচ্ছে। একেবারে যে হচ্ছে না তা নয়। এর মাধ্যমেই জনগণ উপকৃত হচ্ছে। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আইনের প্রয়োগ করা হবে যদি মানুষ প্রয়োগ করতে চায়। জনগণ যদি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়, তা হলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদালতে গেলে তিনি অবশ্যই প্রতিকার পাবেন। তখন আদালত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদেশ প্রদান করে থাকেন। পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে। জনগণ প্রকাশ্যে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করছে। তাদের কিছুই হচ্ছে না। উপরন্তু যারা প্রতিবাদ করছেন তাদেরই নানা ধরনের ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছে। জনসাধারণের ব্যবহৃত স্থানে (পাবলিক প্লেসে) প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হচ্ছে। তা ছাড়া আইন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে ‘পাবলিক প্লেসের’ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে বারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেন যে, আইন থাকলে আইনের প্রয়োগ থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় শুধু একটি আইন নয়, সামগ্রিক আইন ব্যবস্থার প্রতি সংশয়ের সৃষ্টি হবে। তিনি উদাহরণস্বরূপ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কথা বলেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক স্বাক্ষরের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পৃক্ততা প্রমাণের কথা বলা হয়েছে, অথচ কয়টি মামলায় ইলেকট্রনিক স্বাক্ষরের খোঁজ নেয়া হয়, কে-ই বা নেয়? তিনি আইনের প্রয়োগহীনতার কারণে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে করেন। যেমন ধূমপান নিরোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে জীবনের অধিকার, অর্পিত সম্পত্তির কারণে সম্পত্তির অধিকার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কারণে আইনের অধীনে বিচার প্রাপ্তির অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রায় ৪০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের প্রয়োগ করা হয়নি বলে ১৯৭১-এর পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসরা ছিলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তাদের গাড়িতে উড়েছে সরকারী পতাকা- সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। ১৯৭১ সালে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার আজও চলমান আছে, গত প্রায় ৪০ বছর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা চোখের পানি ফেলেছে। সুতরাং, আইন থাকলে তার প্রয়োগে সরকারকে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন সময়েই প্রয়োজনে পড়ে নতুন নতুন আইন করতে হয়। সামাজিক শৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক আইন হয়েছে। যেগুলো আমাদের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু অনেক অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইনে দেখা যায়, এ আইনগুলো প্রয়োগ হচ্ছে না। যার কারণে যে উদ্দেশে আইন করা হয়েছিল সে পারপাস ফুলফিল হয় না। ধরুন পাবলিক প্লেসে ধূমপান আইন করা হলো। এটি অর্থবহ ও কার্যকর করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নতুবা আইনটি শুধু কাগজেই থাকবে। স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশে করা হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অপরদিকে এ রকম কিছু কিছু আইন কার্যকর করা না হলে জনগণের মাঝে একটি নেগেটিভ ধারণার সৃষ্টি হয়। যা কোন মানুষের মধ্যে আইন অমান্য করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। সমাজের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে জন্য আমি মনে করি সরকার ও প্রশাসন যন্ত্রের সকল স্তরে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনগুলো সকল ক্ষেত্রে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত ।
×