ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ অক্টোবর ২০১৭

কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা ইস্যু দ্রুত সমাধান না হলে তা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে। তেমনি এ সমস্যা বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না হলে বিশ্বে জঙ্গীবাদের মাত্রাও বাড়বে। তাই সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ হলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো। যদিও বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতায় এখনও সঠিক পথেই চলছে বলে মনে করেন তারা। ‘রোহিঙ্গা সমস্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্ট ও বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিষদ এ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক তা প্রমাণ করতে পারলে ফেরত নেবে। এজন্য আমরা আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দিচ্ছি। আশা করি কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হব। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ববিবেক আজ জাগ্রত। তারাও চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিক। উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় ধারণ ক্ষমতায় চেয়ে এখন চারগুণ বসতি উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বেশি মানুষের কারণে সামাজিক সমস্যা বাড়ছে। পাহাড় কাটা ও ঘনবসতির কারণে পরিবেশগত সমস্যা তো চলছেই। এছাড়া অনেক রোহিঙ্গা এইচআইভিতে আক্রান্ত। এজন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ফেরত নিতে বিলম্ব হলে রোহিঙ্গাদের পৃথক বাসস্থানের চিন্তা করা হচ্ছে। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে প্রায় ১০লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে আশ্রিত একথা উল্লেখ করে কামাল বলেন, কিছু দিনের মধ্যেই আমার মিয়ানমার সফরে যাবার কথা রয়েছে। সেখানে আলোচনার মূল এজেন্ডা হবে, তারা কবে আমাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের কিভাবে ফিরিয়ে নেবে। মূল বক্তব্য হলো, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করুন। এছাড়া আর কোন আলোচনা নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ২৮বার মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের কথা জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে মিয়ানমার সেনারা সীমান্তে টহল দিচ্ছে। মাইন পুঁতে রেখেছে। এটাও ঠিক নয়। কিন্তু আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করি না। কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলেও মনে করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোটা বিশ্ব মিয়ানমারকে ধিক্কার দিচ্ছে এমন মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এখন সবাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। আশা করি সকলের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার নজির পৃথিবীতে কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশ সরকার উৎসাহ দেবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় বাংলাদেশে হবে না। আমরা মিয়ানমারের সন্ত্রাসী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসাকে যেমন ঘৃণা করি তেমনি সেখানে মানুষের ওপর যেভাবে সেনারা অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে তাও মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি শুদ্ধানন্দ মহাথের বলেন, কোথাও আমরা মানুষের ওপর অন্যায়-অত্যাচার চাই না। শান্তি চাই। মিয়ানমারে যখন গিয়েছিলাম তখন সুচিকে বলেছি রোহিঙ্গারা মানুষ। তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করুন। তাদের বাসস্থানের জন্য পৃথক জায়গা ঠিক করে দিন। কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি। তিনি বলেন, সকলের সম্প্রীতির হাত প্রসারিত করা উচিত। আরও হাজার হাজার বছর আমরা সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করতে চাই। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিকতা অটুট থাকবে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রধান পথ হল কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো এমন মতামত দিয়ে ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধ হলে পাকিস্তানসহ যারা মিয়ানমার-বাংলাদেশ ভূখ- মিলিয়ে পৃথক রাষ্ট্র চায় তারা লাভবান হবে। এতে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুদ্ধ কোন সমাধানের পথ তৈরি করবে না। জামায়াত রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তরুণদের সরিয়ে নিচ্ছে এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, তরুণদের সরিয়ে নেয়া খুবই ভাবনার বিষয়। আমরা জানতে পেরেছি, অর্থনৈতিকভাবে অসহায় এই তরুণদের জঙ্গী বানাতে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে আত্মঘাতী প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কাজে জামায়াত সফল হলে গণতন্ত্র, রাষ্ট্র ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। এই বাস্তবতাটুকু কূটনীতিকদের মাধ্যমে ভারত, চীন ও রাশিয়াকে বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে সমস্যার সৃৃষ্টি হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও বাঁচবে না। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দেশে ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, অতীতে বিভিন্ন দেশে দেড় লাখ ভুটানী উদ্বাস্তুতে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। তাই শরণার্থী ভাগ করে নিতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। রোহিঙ্গা ইস্যুটিতে কাজে লাগাতে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী তৎপর একথা উল্লেখ করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ’৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ আসছেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশে ১২৫টি জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে ২৫টি ছিল রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠন ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটির’ দফতর এখন পাকিস্তানে। বাংলাদেশ ঘিরে তাদের এজেন্ডা আছে। তারা বাংলাদেশের টেকনাফ ও মিয়ানমার মিলিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর অব আবদুর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা ধর্মীয় নয়, নৃগোষ্ঠীর লড়াই। তাই ধর্মের সঙ্গে এ সমস্যাকে মেলালে চলবে না। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বড় সমস্যা হলেও সমাধানযোগ্য। কারণ আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ কূটনীতিতে এখনও বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। কারণ সম্প্রতি যারা এ বিষয়ে কোন কথা বলেনি তারাও এখন বাংলাদেশের পাশে আছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে সেনা শাসনের সমন্বয় হয় না বলেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চলছে মন্তব্য করে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন রোহিঙ্গাদের কেউ না খেয়ে মরবে না। প্রয়োজনে খাবার ভাগাভাগি করে খাব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আবেদন গোটা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই গোটা পৃথিবী এই ইস্যুতে সামনে এসেছে। বার্মায় জনগনের গণতান্ত্রিক সরকার দরকার একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলে সেখানে হত্যা থামবে। যেসব সেনা কর্মকর্তা মিয়ানমারে মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিচারের দাবিও জানান তিনি। বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে তা এ অঞ্চলের জন্য ঝুঁকি। তেমনি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি বলেও মন্তব্য করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না হলে বিশ্বে জঙ্গীবাদের মাত্রা বাড়বে একথা জাতিসংঘও বলছে। আমাদের প্রত্যাশা, কূটনৈতিক তৎপরতায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে অধিকার নিয়ে ফিরবে। বাংলাদেশ স্টাডি ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান, ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া প্রমুখ।
×