ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

সৌন্দর্য বাণিজ্য এবং স্টাইল বিষয়ক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ অক্টোবর ২০১৭

সৌন্দর্য বাণিজ্য এবং স্টাইল বিষয়ক

সৌন্দর্য ও ফিটনেস সংক্রান্ত কিছু শব্দের সঙ্গে এদেশের মানুষের পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। গত শতকের শেষ দশক থেকে এসব শব্দের সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হতে থাকে। শব্দগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি আকাক্সক্ষা; নিজেকে সুন্দর করে তোলা। এসব শব্দের মোহ যখন ক্রমশ আচ্ছন্ন করছে পৃথিবীতে তখন ঘটে যাচ্ছে অর্থনীতির পটপরিবর্তন। বাজার অর্থনীতির খেলা। একই সমান্তরালে ঘটল মিডিয়া বিস্ফোরণ। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে স্যাটেলাইট। টেলিভিশনের রিমোট টিপলেই দূর দেশের মানুষজন, রাস্তাঘাট, লাইফস্টাইল নিমিষে পর্দায় হাজির। দেশ-কালের সীমারেখা ঘুচে গেল। বহুজাতিক কোম্পানির যে পণ্য আটলান্টিকের ওপারে বিক্রি হচ্ছে সেই একই পণ্য বাংলাদেশের বিপণিবিতানে সুলভ। সব কিছু হাতের নাগালে। শুধু ক্রয়ক্ষমতা থাকলেই হলো। বাজার বা বাণিজ্য চক্র গরিব দেশের নারীকে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে সেসব দেশে বাজার প্রসারিত করছে। ভারত বিশ্বসুন্দরীর এত শিরোপা এমনি এমনি পায়নি। বাংলাদেশেও ছোটখাটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা চালু হয়েছে আজকাল। চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর-কিশোরীরা নেট ঘেঁটে গ্রুমিং টিপস বের করে নিজের ওপর এ্যাপ্লাই করে। পার্লারে যায়, জিমে যায়। মডেল হওয়া বা টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যুক্ত হওয়ার গোপন ইচ্ছে ভেতরে লালন করে। উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের একাংশের তরুণ এবং মাঝ বয়সীরাও ভীষণভাবে ওমুখী। বিজ্ঞাপনের কাজই হলো মানুষের মনে আকাক্সক্ষা তৈরি করে তার ক্রয়ক্ষমতা শুষে নেয়া। চব্বিশ ঘণ্টা মনোলোভা বিজ্ঞাপন, মেকওভারে খুঁত ঢাকা মুখ, জিম করা দেহসৌষ্ঠব আর পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে তারিয়ে তারিয়ে লাইফস্টাইল প্রোগ্রাম উপভোগ বাংলাদেশের মতো না খেতে পাওয়া দেশের মানুষেরও মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। পকেটে যাদের গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা আছে তারা দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছেন, যাদের নেই তারা ফেয়ার এ্যান্ড লাভলি মেখে নিজেদের চামড়ার মসৃণতা পরিমাপ করেন দূর মফস্বলের স্কুলপড়ুয়া মেয়েও জানে কোন্ ক্রিম মেখে ত্বকের রং এক শেড উজ্জ্বল করা যায়। ছেলে জানে ফেসিয়াল ফেয়ারনেসের বিশেষ খবর। এই আকাক্সক্ষা এবং বিপণন, বিজ্ঞাপন ও বাস্তবতায় ফ্যাশন আর স্টাইলে তালগোল পাকিয়ে গেছে? ॥ দুই ॥ সত্যি বলতে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় বাজার বিপণনের চক্রব্যুহে বাঁধা পড়ে গেছে সব। সারাক্ষণ যেন এক অশরীরী প্রতিদ্বন্দ্বীকে অতিক্রম করার দুরন্ত চেষ্টা। ঘরে-বাইরে সবখানে। যার প্রভাব মন থেকে শরীরে, শরীর থেকে মনে সাইকোসোম্যাটিক ডিজিজের মতো দেখা দিয়েছে। সোম্যাটো সাইকিক ডিজিজ, যার অর্থ শারীরিক কারণে মানসিক ক্ষতি। দুটো শব্দ পরস্পর সংলগ্ন বা পরিপূরক। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্রমাগত সাফল্যে সংক্রামক রোগ এখন প্রায় পুরোটাই চিকিৎসকদের আয়ত্তে। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এখন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছে অন্য কিছু রোগ। যার কারণ বহুবিধ বা মাল্টি-ফ্যাকটোরাল। যে বিষয়গুলো মূলত এ রোগের জন্য দায়ী তার মধ্যে অন্যতম পরিবেশ, মন ও শরীর। এর সমন্বয়ে নানারকম সাইকোসোম্যাটিক অসুখ দেখা দেয়, যা থেকে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হৃদরোগের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। আজকাল অনেক কম বয়সে হার্ট এ্যাটাকের প্রবণতা বেড়েছে। চল্লিশের আগেই অনেকে এর শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের ঘটনার জন্য চিকিৎসকরা স্ট্রেস বা মানসিক চাপ এবং লাইফস্টাইলকে মূলত দায়ী করেন। স্ট্রেস হলে শরীরে মেটাবলিক পরিবর্তন ঘটে, যা নিউরো হরমোন ক্ষরণে বাধা দেয়। স্ট্রেস সরাসরি হার্ট এ্যাটাকের জন্য দায়ী না হলেও হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। হাইপারটেনশন, বিভিন্ন ধরনের পেইন; এর জন্যও মানসিক এবং শারীরিক চাপ মূলত দায়ী। তবে বাণিজ্যের বাইরে সুস্থ এবং কর্মক্ষম থাকতে নিজেকে ঠিক রাখার প্রতিও সচেতনতা বেড়েছে। সৌন্দর্য ধরে রাখতেও প্রয়োজন ফিটনেস। এ দুয়ের কোনটাকে এড়িয়ে সাফল্যে পৌঁছা বেশ কঠিন। কর্মক্ষেত্রে নিজেকে ফিট রাখতেই হবে, নইলে প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া পরিণতি। এক পুরুষ সহকর্মী ছিলেন, যিনি পঞ্চাশের কোঠা পেরিয়ে আরও দু’তিন বছর অতিক্রম করেছেন। কিন্তু অফিসে বয়সের সঠিক হিসেব সযতেœ লুকিয়ে রাখতেন। তার ভয় ছিল, অফিসে বেশি বয়স হয়ে যাওয়া মানে আনফিট হয়ে যাওয়া। আনফিট মানে ফুরিয়ে যাওয়া। তিনি জানেন, ফুরিয়ে গেলে চলবে না। ফিট তাকে থাকতেই হবে। তাই নিয়মিত হেলথ চেকআপ, চার্ট মেনে ডায়েটিং, এক্সারসাইজ এসব জীবনে অপরিহার্য করে নিয়েছিলেন। ফিটনেসের এও এক মনস্তত্ত্ব। নিজেকে আরও যোগ্য করে । ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী সাজ-পোশাক করা, পরিপাটি থাকার মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি আছে। আয়নায় নিজেকে ভাল লাগলে তবেই অন্যের কাছে উপস্থাপন স্মার্টলি হয়। পোশাক, পোশাকের রং, এক্সেসরিজ বা প্রসাধন অর্থাৎ সার্বিক দর্শনটা যেদিন নিজের কাছে খুঁতখুঁতে লাগে সেদিন সামান্য হলেও বিষণœ থাকে মন। কাজের মধ্যে কোথায় যেন তাল কেটে যায়। প্রত্যেক মানুষের নিজের কাছে নিজের চেহারার একটি কাক্সিক্ষত ‘রূপ’ থাকে। তা তিনি যতই সাজসজ্জাবিমুখ হন। সে রূপের ঠিকঠাক বহির্প্রকাশ মনের ওপর প্রভাব ফেলবেই। নিজের ব্যক্তিত্ব, রুচি, পেশা অনুযায়ী নিজস্ব স্টাইল যিনি তৈরি করে নিয়েছেন, অনেকের মধ্যে আলাদা একজন হয়ে তিনি সহসা চোখে পড়েন। নিজস্ব স্টাইল যার আছে তিনি হাল ফ্যাশন মেনে না চললেও সব সময় ফ্যাশনেবল। কিছু মানুষ আছেন, যাদের অপরিমিত গেটআপ-মেকআপ বলে দেয় তিনি প্রাচুর্যের অধিকারী, শুধু ঘাটতি রয়েছে পরিমিতবোধের। তার সাজে ‘বাজার’ প্রতিফলিত হচ্ছে, হারিয়ে গেছে নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বটুকু।
×