ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি কেন অবৈধ হবে না ॥ হাইকোর্টের রুল

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১০ অক্টোবর ২০১৭

সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি কেন অবৈধ হবে না ॥ হাইকোর্টের রুল

সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তী ও দুদক চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠির বিষয়ে রুল মানেই সিনহার বিরুদ্ধেই রুল জারি স্টাফ রিপোর্টার ॥ আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান না করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দেয়া সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের চিঠি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সোমবার এ সংক্রান্ত এক আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করে। দশ দিনের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী এবং বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আগামী ১৯ অক্টোবর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেছে আদালত। আদেশের পর আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের এই চিঠির বিষয়ে রুল জারি করা মানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধেই রুল জারি করা। গত ২৮ মার্চ বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ করতে দুদককে চিঠি দেয় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নির্দেশে দেয়া হয়েছিল বলে দুদককে জানান তিনি। গত ৫ ও ১৭ জুন ‘সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!’ এবং ‘সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে থেমে নেই দুদক’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক জনকণ্ঠে। এর পরই আলোচনায় আসে এই চিঠি। দুর্নীতি বন্ধে সুপ্রীমকোর্টের এমন চিঠি নিয়ে উত্তাপ হয় সংসদও। সাবেক দুই প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের এই নির্দেশনা মানতে বাধ্য নয় দুদক। বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুলের কর্মজীবন-সংক্রান্ত নথিপত্র দুদকে পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে জনকণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনও নেন বিচারপতি জয়নুল আবেদীন। পরে সুপ্রীমকোর্টেও তা বহাল থাকে। সোমবার সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ বদিউজ্জামান তরফদার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত চিঠি হাইকোর্টের নজরে আনেন। এ সময় আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন বদিউজ্জামান নিজেই। দুদকের পক্ষে এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খানও আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আদেশের পর খুরশীদ আলম খান জনকণ্ঠকে বলেন, আদালত সুপ্রীমকোর্টের ওই চিঠি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। রুল শুনানির জন্য আদালত তিনজন এ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) নিয়োগ দিয়েছেন। এরা হলেনÑ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন ও প্রবীর নিয়োগী। আগামী ১৯ অক্টোবর আদালত শুনানির দিন ধার্য করেছে বলে জানান তিনি। আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আদেশের পর জনকণ্ঠকে বলেন, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত ওই চিঠির বিষয়ে রুল জারি করার অর্থ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধেই রুল জারি করা। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, চিঠির বিষয়ে দুদক যাচাই-বাছাই করলে অরুনাভ চক্রবর্তী দুদককে জানিয়েছিল প্রধান বিচারপতির নির্দেশেই তিনি এই চিঠি দিয়েছিলেন। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিষয়ে অনুসন্ধানের স্বার্থে দুদকে তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণীর সুষ্ঠু যাচাই ও অনুসন্ধানের কথা উল্লেখ করে তার চাকরির (বিচারপতি হিসেবে) মেয়াদ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র (যোগদানপত্র, অবসর গ্রহণের তারিখ সংবলিত কাগজপত্র) ও চাকরি সূত্রে বিভিন্ন (বেতন, ভাতা, অবসর সুবিধা ইত্যাদি) খাতে গৃহীত অর্থের বিবরণী (অর্থ বছর হিসেবে) চেয়ে চলতি বছরের ২ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর চিঠি দেয় দুদক। জবাবে ২৮ মার্চ সুপ্রীমকোর্ট আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দুদকে পাঠায় সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন দীর্ঘকাল বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপীল বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক মামলার রায় প্রদান করেন। অনেক ফৌজদারি মামলায় তার প্রদত্ত রায়ে অনেক আসামির ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দেয়া রায় সবার ওপর বাধ্যকর। এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে দুদক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তার দেয়া রায়সমূহ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং জনমনে বিভ্রান্তির উদ্রেক ঘটবে। সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না, মর্মে সুপ্রীমকোর্ট মনে করে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। দুদক সূত্র জানায়, চিঠি পাওয়ার পর তা যাচাই-বাছাইও করেছে দুদক। চিঠি পাওয়ার পর তা কমিশনের সভায় উপস্থাপন করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিটির সঠিকতা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিঠির সঠিকতা যাচাই করে তা আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তীরই বলে নিশ্চিত হয় দুদক। এ বিষয়ে দুদকের একটি নথিতে বলা হয়েছে, ‘পত্রটি স্বাক্ষরকারী অরুনাভ চক্রবর্তী মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির অনুমোদন ও নির্দেশক্রমে প্রেরিত পত্রটিতে তার স্বাক্ষর সঠিক।’ এ বিষয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে গত ৫ ও ১৭ জুন ‘সাবেক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের বাধা!’ এবং ‘সাবেক এক বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে থেমে নেই দুদক’ শিরোনামে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন যুক্ত করে আগাম জামিনের আবেদন করেন সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীন। পরে হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়। এরপর এ জামিন আবেদনের বিরুদ্ধে দুদক আপীল বিভাগে গেলে সেখানেও তার জামিন বহাল থাকে। একই সঙ্গে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের জামিনের বিষয়ে জারি করা রুল দ্রুত নিষ্পত্তির আদেশ দেয় আপীল বিভাগ। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায় নিয়ে গত ৯ জুলাই সংসদে ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের প্রসঙ্গটিও আসে। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনগুলো উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করতে গিয়ে এ বিষয়টি তুলে ধরে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ওই চিঠি দেয়ার মাধ্যমে বিচারপতি এস কে সিনহা ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন, যা দ-বিধির অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি সুপ্রীমকোর্টের নাম শুধু ব্যবহারই করেননি, তিনি সুপ্রীমকোর্টের প্যাডও ব্যবহার করেছেন, যদিও এটা ছিল তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’ এর আগে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিষয়ে দুদকের তদন্ত করা সমীচীন নয়Ñ এমন চিঠি সুপ্রীমকোর্ট থেকে পাঠানোর পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তিনি বলেন, সাবেক বিচারপতির দুর্নীতির তদন্ত বন্ধের সুপ্রীমকোর্টের দেয়া চিঠির নির্দেশনা মানতে দুদক আইনত বাধ্য নয়। আইনের চোখে সবাই সমান। যে কোন অভিযোগের বিষয়েই দুদক তদন্ত করতে পারবে, দুদক আইনে তাই বলা আছে। আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ তাফাজ্জাল ইসলামও বলেছেন, আইনের চোখে সবাই সমান। উল্লেখ্য, মোঃ জয়নুল আবেদীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০০৯ সালে আপীল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসরে যান তিনি। আলোচিত এ বিচারপতি ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করেছিলেন বলে জানা গেছে। আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয় দুদক। দুদকের দেয়া নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ২০১০ সালের ২৫ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করেছিলেন। রিটের ওপর শুনানি গ্রহণের পর বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেয়। ওই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রিট খারিজের ফলে এখন দুদকের দেয়া নোটিসের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে আর কোন আইনগত বাধা নেই। সম্পদ বিবরণী চেয়ে গত ১৮ জুলাই দুদক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে নোটিস দিয়েছিল বলে তিনি জানান। রিট দায়েরকারীর আইনজীবী আহসানুল করিম ওই সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনাকে দুদক সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস দেয়। ওই নোটিস দেয়ার প্রক্রিয়া আইনানুগ হয়েছে বলে আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত রয়েছে। আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত হাইকোর্টের জন্য মানা বাধ্যকর। এ যুক্তিতে আদালত রিটটি উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেয়।
×