ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকি

উত্তরের ‘ইয়োলো গোল্ড’ বাড়ছে চাহিদা যাচ্ছে বিদেশেও

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১০ অক্টোবর ২০১৭

উত্তরের ‘ইয়োলো গোল্ড’ বাড়ছে চাহিদা যাচ্ছে বিদেশেও

সমুদ্র হক বাঙালীর মৎস্যপ্রীতি তো আছেই, প্রীতিতে শুঁটকি মাছও কম নয়। তাজা মাছের সঙ্গে শুঁটকি পাল্লা দিয়েছে। একদা পূর্বাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকার সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি ছিল জনপ্রিয়। এখনও তা আছে। তবে হালে দেশের সবচেয়ে বড় চলনবিলে মিঠা পানির মাছের শুঁটকির আধার তৈরি হয়েছে। সেখানে বসেছে শুঁটকির আড়ত। এই শুঁটকি এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মিঠা পানির মাছের শুঁটকির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় দেশের নদী তীরবর্তী এলাকার জেলেরাও তাজা মাছ ধরার পাশাপাশি শুঁটকি তৈরিতেও মেতে উঠছে। বাঙালীর খাদ্য তালিকায় দিনে দিনে শুঁটকির অভ্যাস এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে শুঁটকির ভাল রান্না মুখরোচক হলে চেটেপুটে খাওয়া হয়। পাঁচ তারকা খঁচিত হোটেলসহ ছোট বড় মাঝারি মানের হোটেলগুলোতেও শুঁটকির তরকারি মিলছে। দক্ষিণাঞ্চলের ‘হোয়াইট গোল্ড’ বা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ির হাল ধরে উত্তরাঞ্চলের শুঁটকি ‘ইয়োলো গোন্ড’ (হলুদ সোনা) হয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোনা পানির মাছের শুঁটকির স্বাদ একরকম, মিঠা পানির মাছের শুঁটকির স্বাদ আরেক রকম। লোনা পানির রূপচাঁদা মাছের শুঁটকির স্বাদ যারা নিয়েছেন তাদের কাছে শোল, বোয়াল টাকি, মাছের শুঁটকির স্বাদ আরও ভাল লাগবে। বিদেশীদের কাছেও মিঠা পানির মাছের শুঁটকির চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। দেশের মানুষের কাছেও মিঠা পানির মাছের শুঁটকির চাহিদা লোনা পানির মাছের শুঁটকির চেয়ে বেশি। চলনবিলের অনেকটাই শুকনো ভূমিতে পরিণত হয়ে মাছের আধার কমিয়েছে। তবে নতুন আধার সৃষ্টি করেছে শুঁটকি মাছের। বৃহত এই জলাভূমিতে আজ আর থৈ থৈ পানি নেই। বিলের অনেকটা ভূমি জুড়ে ধান পাট সবজিসহ নানা ফসলের আবাদ হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিলের নিচু ভূমির খালগুলোতে শুরু হয়েছে মাছের চাষ। মাছ আহরণের সময় উৎসবে পরিণত হয়। খেয়া জাল, সুতি জাল, বেড়া জাল, পলো দিয়ে মাছ ধরা হয়। এই মাছের সামান্য অংশ যায় স্থানীয় হাটবাজারে। মাছ আহরণের পর চার ভাগের তিনভাগই যায় শুঁটকি বানানোর জায়গায়। চলন বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে শুঁটকির চাতাল ও মাছ শুকানোর আলাদা স্থান তৈরি হয়েছে। বিল পাড়ের এলাকায় প্রবেশের পর শুঁটকির গন্ধ টেনে নিয়ে যায় চাতালের দিকে। এ ছাড়াও বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে ছোট ছোট অস্থায়ী চাতাল। বিলের মধ্যেই এ ধরনের ৫শ’র বেশি অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এইসব চাতালে মিঠা পানির নানা জাতের মাছের শুঁটকি বানানো হয়। চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, সরপুঁটি, খলসে, চেলা, ট্যাংরা, বাতাসি, মলা, ঢেলা, টাকি, ছাইত্যান, বাইম, কৈ, মাগুর, শিঙ্গীসহ মিঠা পানির সব ধরনের মাছের শুঁটকি বানানো হচ্ছে। এমন কি চিংড়ি মাছের শুঁটকি তৈরি হয় এই বিলে। আশ্বিন মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত শুঁটকি তৈরি হয়। প্রতি মণ তাজা মাছ শুকালে ১৬ কেজি শুঁটকি মেলে। সাধারণত ৩ মণ তাজা মাছে এক মণ শুঁটকি পাওয়া যায়। প্রায় ১শ’২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয়ের ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে এই বিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর আয়তনের জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাই ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশে এই শুঁটকি যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৪শ’ টনেরও বেশি শুঁটকি তৈরি হয়ে রফতানির তালিকায় যোগ হবে, এমনটি জানালেন একজন ব্যবসায়ী। শুঁটকি তৈরির পর এ, বি, সি, এই তিন গ্রেডে ভাগ করা হয়। এ গ্রেডের সকল শুঁটকি যায় বিদেশে। বি ও সি গ্রেড বিক্রি হয় দেশীয় বাজারে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, নীলফামারী, বরিশালসহ দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এই শুঁটকি বাজারজাত হচ্ছে। মানভেদে ছোট আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতি মণ ১৬ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকির দাম প্রতি মণ ৩০ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ব্যবসায়ী নাজমুল আলম বললেন, গত বছর তার চাতালে ৭শ’ মণ শুঁটকি তৈরি হয়েছে। সবই ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে গেছেন। মূলত ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে এই শুঁটকি বিদেশে যাচ্ছে। ঢাকার আশুলিয়ার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক জানালেন, এই ব্যবসায় লাভ লোকসান দুই-ই আছে। শুঁটকি ভালভাবে শুকানো না হলে পচে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। উন্নতমানের শুঁটকি কিনে বড় ব্যবসায়ীরা তা প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করে। চাটমোহরের ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ জানালেন, চলনবিলের শুঁটকির স্বাদ বেশি। শুঁটকির এত যে চাহিদা তারপরও প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা রফতানি করে তারাই নিজের উদ্যোগে সংরক্ষণ ও প্যাকেটজাত করে। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপার সম্ভাবনার এই খাতটিকে এগিয়ে নিতে চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। মৎস্য অধিদফতর এই কাজে এগিয়ে আসতে পারে। একই সঙ্গে শুঁটকির মান উন্নয়নে চাতাল মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পরামর্শ দিয়েছে তারা। দূর অতীতে ১৯১৪ সালে চলনবিলের বিশাল এই মাছের আধার থেকে কলকাতায় মাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশরা ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ নির্মাণ করে। একবিংশ শতকের মধ্য দশকে সেই চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকি দেশে সুনাম কুড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এখন দরকার শুঁটকির এই আধারকে টিকিয়ে রেখে আরও এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা, এমন মন্তব্য শুঁটকি ব্যবসায়ীদের।
×