ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ এমদাদুল হক বাদশা

অভিমত ॥ নদী শাসন ও ভাঙ্গন প্রতিরোধ

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১০ অক্টোবর ২০১৭

অভিমত ॥ নদী শাসন ও ভাঙ্গন প্রতিরোধ

নদীমাতৃক বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী ভাঙ্গন রোধ এবং নৌ-চলাচলের সুবিধার্থে ড্রেজিংয়ের জন্য সরকার সব সময়ই অনেক অর্থ ব্যয় করে থাকে। এতে কিছু কাজ হয় কিন্তু এই গরিব দেশে মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ সাধারণ বাঁশ-চাটাই-গাছপালা-পাটের রশি ইত্যাদি দেশীয় অতি স্বল্প মূল্যের জিনিসপত্র দিয়েও যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা-গঙ্গা আপার মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বান্ডালিং করে নদী শাসন, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ, নাব্য বৃদ্ধি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এতে ড্রেজিং থেকে প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থ ব্যয় হবে। এটাকে প্রাকৃতিক ড্রেজিং (ঘধঃঁৎধষ উৎবফমরহম) বলা হয়। তবে ড্রেজিং অবশ্যই করতে হবে কারণ সব নদীতে সব সময় বান্ডালিং করে ভাল ফল পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে বুয়েটের ওয়াটার এ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বিআইডব্লিউটিএ নৌপথ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের প্রাক্তন কর্মকর্তাদের যথেষ্ট বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। গত ৩০ আগস্ট বুয়েটের আইডব্লিউএফএম ইনস্টিটিউটের প্রফেসর সাইফুল ইসলাম ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় লিখেছেনÑ উৎবফমরহম পধহ নব পড়হফঁপঃবফ হধঃঁৎধষ ধিুং ংঁপয ধং ধঢ়ঢ়ষুরহম ইধহফরষষরহম ঃবপযহরয়ঁবং যিরপয ঁংব ষড়পধষষু ধাধরষধনষব সধঃবৎরধষং ষরশব ইধসনড়ড়, ড়িড়ফ বঃপ. ঙঃযবৎ ষড়-িপড়ংঃ হধঃঁৎধষ ফৎবফমরহম ড়ঢ়ঃরড়হং পধহ নব বীঢ়ষড়ৎবফ ঃড় রসঢ়ৎড়াব ধিঃবৎ পড়হাবুধহপব পধঢ়ধপরঃু ড়ভ ঃযব ৎরাবৎ ধহফ ৎবফঁপব ভষড়ড়ফ ঢ়বধশং. বান্ডালিংয়ের ওপর বুয়েটের পানি সম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইনস্টিটিউটের ৩ জন বিশেষজ্ঞ এবং জাপানের কিওটো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হাজিমি নাকাগাওয়া ও প্রফেসর তাইসুকি ইশিগাকি ২০০৪-০৫ সালে ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় গবেষণা করে মতামত ব্যক্ত করেন যে, নৌপথের নাব্য সংরক্ষণের জন্য ড্রেজিং করা বান্ডালিংয়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি ব্যয়বহুল এবং যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা-গঙ্গা, আপার মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজিং টেকসই হয় না কারণ তা এক বছরও টেকে না। বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য ছিলÑ ‘নদীর নিরাপদ নাব্য এবং গভীরতা সংরক্ষণের জন্য ড্রেজিংয়ের চেয়ে বান্ডালিং অনেক কম ব্যয়সাপেক্ষ। যমুনা-পদ্মা/গঙ্গা সুরমা-কুশিয়ারার মতো পলিমাটিযুক্ত নদীগুলোতে ড্রেজিং করে এক মৌসুমও টেকসই রাখা সম্ভব নয়। নদীর নাব্য অব্যাহত রাখার জন্য বান্ডাল অথবা ড্রেজিং ও বান্ডালিংয়ের যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। বান্ডালিংয়ের সাহায্যে নদীর গভীরতা ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বান্ডালিংয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এই দুর্দশা লাঘবের জন্য বান্ডালিং কাজের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে নদীর গতিপথ স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। স্পার-ডাইক-লাইক স্ট্রাকচার (ঝঢ়ঁৎ-ফঁশব-খরশব ংঃৎঁপঃঁৎবং (জধযসধহ ্ গঁৎধসড়ঃড়, ১৯৯৯) স্থাপনের দ্বারা নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পরবর্তীতে এসব প্রতিবন্ধকতা অনেক বড় আকারে ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেয়। ফলে জলপ্রবাহ দীর্ঘমেয়াদীভাবে স্থিতিশীল হতে পারে না। নদীর পার্শাভিমুখীন ডিরেকশনে বান্ডালিংয়ের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিধায় নদীপথ সমন্বয় সাধন ও তীর ভূমি উন্নয়নের জন্য অনেক সময় পায়। পলিমাটিযুক্ত নদীতে বান্ডালিং পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে নদীর নাব্য এবং গভীরতা বৃদ্ধি পায়, বান্ডালিং করে উপরোক্ত নদীগুলোতে ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত গভীরতা বৃদ্ধি করা সম্ভব, এতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীর ভাঙ্গন রোধ, নৌচলাচল সুগম করা এবং মৎস্য চাষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করা যাবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সরকার ড্রেজিংয়ের ওপর জোর দিতে গিয়ে কম খরচে বান্ডালিংয়ের কথা ভুলে গেছে বিধায় গত ২-৩ বছর যাবত বিআইডব্লিউটিএর আরিচা থেকে চিলমারী-দইখাওয়া (সীমান্ত) এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত, অতি অল্প ব্যয়ে বান্ডালিং করে নাব্য বৃদ্ধির কাজটি ছেড়ে দিয়ে নদীগুলোর নাব্য হ্রাসে অবদান রাখছে। নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যমুনা নদী তীর রক্ষার জন্য প্রতি মিটার বান্ডালিংয়ের জন্য ব্যয় হয় মাত্র ৭০ ডলার আর আরসিসি স্পার এর জন্য ৯৫০ ডলার, রিভেটমেন্টের জন্য ৩৮শ’ থেকে ৪ হাজার ডলার, সলিড স্পারের জন্য ২৫শ’ ডলার, সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টের জন্য প্রতি মিটারে খরচ পড়েছে ২১ হাজার ডলার এবং যমুনা ব্রিজের গাইড বাঁধের জন্য প্রতি মিটারে ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ডলার। বিআইডব্লিউটিএ বছরে মাত্র ৪০-৪৫ লাখ টাকার বাজেট দিয়ে আবার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জটিল প্রক্রিয়ার ফলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি বিধায় মাঠ কর্মকর্তারা কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কারণে গত ৩ বছর যাবত বান্ডালিং হচ্ছে না ফলে নাব্য হ্রাস পাচ্ছে এবং বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ ১৯৮৮ সালে হল্যান্ডের ডিএইচভি রিপোর্টে বান্ডালিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে তখনকার বার্ষিক ২০ লাখ টাকা থেকে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞরা জোর সুপারিশ করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ বান্ডালিয়ের উপর গুরুত্ব দেয়নি। গত অর্থবছরে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের অনুপ্রেরণায় আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ৬৫ লাখ টাকার একটি বান্ডালিং প্রকল্প নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য দাখিল করি কিন্তু ৬৫ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ২ লাখ টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যার প্রায় অর্ধেক চলে যায় আনুষঙ্গিক ব্যয়ে। অথচ অন্যান্য প্রকল্পের জন্য কত হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ড্রেজিং সহায়ক বান্ডালিংয়ের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে ১ হাজার কোটি টাকার কাজ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব গবেষণামূলক অতিব জরুরী অপরিহার্য কাজের জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বান্ডালিং কাজে ন্যূনতম বরাদ্দ দিতে চান না। সত্যিই সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে খুব কম খরচে নদী শাসন, নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ এবং নিরাপদভাবে সারা বছর নৌচলাচলের সুবিধার্থে নৌপরিবহন, পানি সম্পদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বুয়েট, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিএর নৌপথ সংরক্ষণ-পরিচালন বিভাগের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথসভা করে স্বল্প ব্যয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বান্ডালিং কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে বিশেষ দাবি জানাচ্ছি। লেখক : সাবেক পরিচালক বিআইডব্লিউটিএ [email protected]
×