ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীরা গড়ছে নতুন আস্তানা ॥ অভিযানে ভাটা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৯ অক্টোবর ২০১৭

জঙ্গীরা গড়ছে নতুন আস্তানা ॥ অভিযানে ভাটা

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠনের পুরস্কার ঘোষিত সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য বলে পরিচিত ভয়ঙ্কর প্রকৃতির দুর্ধর্ষ পলাতক জঙ্গরীা উধাও। পলাতক থাকা এসব জঙ্গীকে ধরতে একের পর এক পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও তাদের হদিস মিলছে না। গোপন জঙ্গী আস্তানারও সন্ধান নেই। পুরস্কার ঘোষণা ছাড়া এমনকি তালিকাবহির্ভূত অনেক সুইসাইড স্কোয়াডের দুর্ধর্ষ জঙ্গী সদস্য ও জঙ্গী পরিবার রয়েছে যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও অজানা। গত এক মাস ধরে বড় ধরনের জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনারও খবর না থাকায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে ভাটা পড়েছে কিনা তাও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জঙ্গী তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের আট তারিখে রাজধানীর মিরপুরের মাজার রোডে সর্বশেষ জঙ্গীবিরোধী বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। আত্মঘাতী হয়ে আগুনে পুড়িয়ে জঙ্গী আব্দুল্লাহ ও তার দুই সহযোগী, দুই স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ সাতজন পুড়ে মারা যায়। আত্মঘাতী এ জঙ্গীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরস্কার ঘোষিত তালিকা কিংবা মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায়ও ছিল না। গ্রেফতারকৃত এক জঙ্গীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর দেয়া তথ্যানুযায়ী সুইসাইড স্কোয়াডের জঙ্গী পরিবারটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির জালে ধরা পড়ে। এই ধরনের অনেক দুর্ধর্ষ জঙ্গী ও জঙ্গী পরিবার গোপন জঙ্গী আস্তানায় নেই এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মকর্তাদেরই দাবি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, পুরস্কার ঘোষিত ছাড়াও পলাতক জঙ্গীরা কে, কোথায় এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। দেশে না বিদেশে সে ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পলাতকদের অনেকে ভারতে অবস্থান করছেন- বিভিন্ন মহল থেকে এমন ইঙ্গিত করা হলেও এ বিয়য়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছেন না কেউই। মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গীরা অধরা থাকলেও সরব রয়েছে নানা কৌশলে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় জেএমবির নাম নতুন করে আলোচনায় এসেছে। পুলিশ সদর দফতর ৫০ দুর্ধর্ষ জঙ্গীর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে পর্যালোচনা করেছে, যার মধ্যে অনেকেই মারা গেছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা কোন হদিসই মিলছে না। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) তাদের খুঁজছে। পলাতক ও পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ যেসব জঙ্গীর ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্রে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকে ভারত, অনেকে পাকিস্তান আবার অনেকে সিরিয়ায় পালিয়ে গেছে বলে খবর মিলছে। আবার অনেকেই পরিচয় গোপন করে দেশে ঘাপটি মেরে নাশকতার ফন্দিফিকির করছে, এমন তথ্যও রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে পলাতকদের ধরতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের ব্যাপারে চোখ রাখছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ছয় সদস্যকে ধরিয়ে দিতে ১৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ছয়জনের মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ এবং সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২-এর জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বাকি চারজনের প্রত্যেকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয় দুই লাখ টাকা করে। ওই চারজন হলো সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সালমান ওরফে সাদ, শিহাব ওরফে সুমন ওরফে সাইফুল এবং সাজ্জাদ ওরফে সজিব ওরফে সিয়াম ওরফে শামস। এরা ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক হত্যাকা-ে জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। এদের মধ্যে শিহাবকে উত্তরা বিমানবন্দর সড়ক থেকে আটক করার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকা থেকে ডিএমপির পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী নাঈম ওরফে সাইফুল ওরফে সাদ (৩০) ও সোহায়েল ওরফে শোভেলকে (২৮) গ্রেফতার করে পুলিশ। ব্লগার হত্যা মামলায় ওয়ান্টেড তারা। শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ ব্লগার অভিজিত রায় হত্যাকা-ের তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজে উপস্থিতি ধরা পড়ে। এই এবিটি সদস্যের বাড়ি বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে। সংগঠনের সদস্যদের সামরিক এবং আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকতেন তিনি। খিলগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার পর তামিম চৌধুরী তার দুই সহযোগী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। তবে মেজর জিয়ার অবস্থান এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজানা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যাকা-ের ঘটনায় রাজশাহী মহানগর পুলিশ জেএমবির সদস্য মোঃ শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ ও মোঃ নজরুল ওরফে বাইক হাসানকে ধরতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে। পরে বাইক হাসান ক্রসফায়ারে নিহত হয়। খালিদের কোন খবর নেই। ব্লগার ও লেখক অভিজিত-দীপন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সেলিমকে ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য আল ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতা সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২ (প্রকৃত নাম নাও হতে পারে)। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানের পুলিশ হত্যা করে শীর্ষ জঙ্গী নেতা মৃত্যুদ-ে দ-িত সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) ও রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ (৩৫) এবং যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেয় জঙ্গীরা। পরে টাঙ্গাইলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন হাফেজ মাহমুদ। প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়া জঙ্গী বোমারু মিজান ও সালাউদ্দিনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও হদিস মিলছে না। তারা দেশে না ভারতে এ নিয়ে তথ্য বিনিময় ছাড়া আর কোন অগ্রগতি নেই। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, গণমাধ্যমে যাদের ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল তাদের অনেকের বিষয়েই তথ্য পাওয়া গেছে। কারও কারও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুতই কেউ কেউ গ্রেফতার হবে। জঙ্গীদের তথ্য প্রদানে পাঁচ লাখ ও আত্মসমর্পণকারী জঙ্গীকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা প্রচারের অভাবে তেমন কোন সাড়া মিলছে না।
×