ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

মানবতার জননী

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ৯ অক্টোবর ২০১৭

মানবতার জননী

১৮ মে ১৯৮০ মানিক মিয়া এভিনিউতে জনম দুঃখিনী এক কন্যা এসে প্রকৃতির কান্নার মাঝে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণ ছিল বাংলাদেশের নিয়তির অভিসার। দৃপ্ত শপথ, ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে, যেই রাজনৈতিক দর্শন তিনি অন্তরে লালন করেছেন, তা ছিল বাঙালী জাতি তথা বাঙালীর মুক্তির অভিপ্রায়। ১৯৮০ থেকে ২০১৬, সুদীর্ঘ ৩৬ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি দেশের ইতিহাসে এটা খুবই অল্প সময়। অল্প সময় হলেও প্রাপ্তি বিশাল। মানবকল্যাণ সূচক উন্নয়নের দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষা এবং গবেষণায় বাংলাদেশ ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (ডঐঙ, টঘওঈঊঋ, টঘ এবং টঘউচ, ঋঅঙ) প্রায় সবাই এ উন্নয়নের স্বীকৃতিও দিয়েছে। ৩৬ বছরের আন্দোলন, নির্বাচন, বিরোধী দলের আসনে বসা এবং সরকার পরিচালনার পুরো সময়টাকে আমরা নিম্নোক্তভাবে ভাগ করতে পারি- ১. সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো, ২. জাতির জনকসহ সকল নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারের জন্য সোচ্চার হওয়া এবং সর্বশেষ বিচার করা ৩. জাতির জনকের নেতৃত্বে প্রণীত ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে আসা ৪. অনগ্রসরতা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ ৫. বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা ৬. ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারী সম্পত্তি ভোগদখল মুক্ত করা ৭. নারী শিক্ষাসহ নারী অগ্রগতি এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা ৮. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ৯. তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করা ১০. ভূমি সংস্কার ১১. ধর্মকে রাজনীতির বাইরে তার নিজস্ব আসনে প্রতিষ্ঠা ১২. ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্রের খাদ্য সংস্থান ১৩. পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ ও কাজের অধিকার সুনিশ্চিত করা ১৪. গড় আয়ু বৃদ্ধি ১৫. শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস ১৬. ধর্মীয় স্বাধীনতা ১৭. প্রবীণ ভাতা ১৮. অটিজমসহ ¯স্নায়ুবিক দুর্বলতার শিকার শিশুদের ভাতা এবং বিশেষ যতœ ও বিশেষ সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ১৯. সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমতা অর্জন, কল্যাণকর রাষ্ট্রের মতো বিভিন্ন সেক্টরে ভাতা প্রদান, ইত্যাদি আরও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ। রাষ্ট্রের এই অগ্রযাত্রা, সার্বিক উন্নয়ন সূচকের উন্নতি, কৃষিতে সমৃদ্ধি ইত্যাদি অনেক কারণেই তিনি আজ জগত নন্দিনী। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদক বলেছিলেন, যে চারটি আদর্শ নিয়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা ধ্বংস করে বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানী লেবাসে সামরিক শাসনের দিকে ধাবিত হলো। তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে লিখেছিলেন পড়লে মনে হয় তিনি শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কবর হয়ে গেছে।’ তার সেই সর্বনাশের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়নি। বরং বলা যায় শেখ হাসিনার দর্শনের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যে সেনাবাহিনীর একটা বিচ্ছিন্ন অংশ ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিল, যার সূত্র ধরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন, সেনানিবাসে অবস্থান করে রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সংবিধান সংশোধনের নামে ’৭২-এর সংবিধানকে পদদলিত করেছিলেন, পরবর্তীতে জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একই প্রক্রিয়ার ক্ষমতা দখল করলেন। একই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখল করে সেনা ছাউনিতে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, তা থেকেও তাকে নামতে হলো শেখ হাসিনার নির্দেশিত পথ ধরে। গণতন্ত্রের সূর্য পূর্বাকাশে উঁকি দিতে লাগল। কিন্তু ১৯৯১-এর নির্বাচনে পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র, সূক্ষ্ম কারচুপি, আইএসআইয়ের অর্থের কাছে নিশ্চিতভাবে জয়ী হওয়ার প্রত্যাশী আওয়ামী লীগ হেরে গেলেও শেখ হাসিনা দমে যাননি। বিরোধী দলের আসনে বসে তিনি সংসদকে এবং সরকারী দলকে শিখিয়ে দিলেন গণতন্ত্র কি, কিভাবে তার চর্চা করতে হয়। ১৯৯১ তে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নয়, এই পরাজয় ছিল গণতন্ত্রকামী বাঙালীর। দীর্ঘ ইতিহাস সম্পন্ন, কোন পুরনো সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে নীতি পরিবর্তনের জন্যও বিরোধীপক্ষকে শাসকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ দেয়। গণতন্ত্রের এই দর্শনতত্ত্বকে উপলব্ধি করে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ব্যাখ্যা করে তুলে ধরলেন, কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যায়। আইন, যুক্তি-তর্ক কোনটাকেই সরকারদলীয় নেতা এবং উপনেতা খন্ডন করতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রধান ব্যর্থতাগুলোর প্রতিকারের উপায়টি রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও সামাজিক দাবির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই কারণেই ভবিষ্যত কর্মপন্থা ও লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার দিক দিয়ে শেখ হাসিনার নিয়তির অভিসার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে যা আপনাআপনি ঘটার কথা ছিল, এক উর্ধমুখী সরলরেখায় যার অগ্রগতি ধাবমান হওয়ার কথা ছিল, ’৭৫-এর আগস্টের পরে তা মুখ থুবড়ে পড়ল, যা একালের জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী নতুন করে এগিয়ে নিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেখালেন। ’৭৫ সালের বর্বর, নিষ্ঠুর ঘৃণিত ইতিহাসের এই বিরল হত্যাকা-ের পর বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা যে দুঃখ এবং বিভীষিকার স্মৃতি নিয়ে বেঁচেছেন, তা তাদের আমৃত্য বেদনার অতল গহ্বরে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তা তাদের দুজন ছাড়া আর কেউ কখনও উপলব্ধি করতে পারবেন না। তাই তারা দুজনই হলেন জনম দুঃখিনী। শেখ হাসিনার বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র, যার তুলনা চলে আলফ্রেড টেনিসনের অনবদ্য বর্ণনার সঙ্গে আমি ভবিষ্যতের গভীরে তাকালাম মানব চক্ষু যতদূর দেখতে পায় সারা বিশ্ব উদ্ভাসিত হলো সে অপরূপ সম্ভাবনা, আমাদের সামনে অপরূপ সম্ভাবনার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা আজ যে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে, তাতে পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে নিশ্চিত। বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যা, যাকে শরণার্থী সমস্যা বললে ভুল হবে। এটা হলো মানবতা ভূলুণ্ঠিত করে একটা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তার পিতৃভূমি বা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা। ইতিহাসের এই বর্বরতা দেখে গোটা বিশ্ব বিস্মিত হলেও সত্যিকার প্রতিবাদ হয়নি। মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে বুঝতে কষ্ট হয়নি, এখানে শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা হয়নি, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এমন কি জঙ্গী আন্দোলনের যোগসূত্র থাকাতে পারে। এমন সবকিছু তিনি বিবেচনায় রেখেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে ছুটলেন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে। সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক আলো, আমাদের প্রিয় ছোট আপা শেখ রেহানা। আমার মতে সিদ্ধান্ত নিতে তিনিও কেতাদুরস্ত। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের পূর্বে তিনি দল এবং সরকারকে এমন কি নির্দেশনা দিয়ে গেলেন। তার অনুপস্থিতিতে সরকার এবং দল ঝাঁপিয়ে পড়ল রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে। আমি আগেও আমার বিভিন্ন লেখায় লিখেছিলাম, শুধু শিশুপাগল নয়, শিশু বশীকরণে অভিজ্ঞ আমাদের এই জননেত্রী, রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের স্মার্ট কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন। জাতিসংঘে চর্তুদশবারের মতো পিতার পদাংক অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় বিশ্ব বিবেকের কাছে সুস্পষ্ট এবং হৃদয় অঙ্গম করার মতো ভাষণ দিয়ে বললেন, ১৬ কোটি লোকের বাংলাদেশ তাদের খাদ্যের অভাবে বা চিকিৎসার অভাবে মরতে দেবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মতো প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তবে আমার হৃদয় আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। কেননা, আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি।’ ইউরোপের কোন দেশে যদি কয়েক হাজার শরণার্থী উপস্থিত হয়, তা হলে ইউরোপীয় সরকারগুলোর চিৎকারে পুরো বিশ্ব কেঁপে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সারমর্ম, রোহিঙ্গা সমস্যা নিষ্পত্তিতে ৫ প্রস্তাব, মিয়ানমারে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুসন্ধানী দল প্রেরণ, মিয়ানমারে দ্রুত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্ববধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা। রাখাইন থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। আনান কমিশনের সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও শান্তি ও ন্যায় বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মানবতাবাদী, একজন মা হিসেবে রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন এবং বিতাড়নকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছে। যেখানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে কয়েক হাজার উদ্বাস্তু ইউরোপের দেশে আশ্রয় নিলে তাদের চিৎকারে বিশ্ব কম্পমান, সেক্ষেত্রে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বের দরবারে নিজেকে, বাংলাদেশকে এবং বাঙালী জাতিকে এক সুউচ্চ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যখন বললেন, আমরা আধা পেট খেয়ে হলেও শরণার্থীদের খেতে দেব। এই কথাটি আমাকে ছোটবেলায় কোটেশন পড়তে গিয়ে আমার প্রিয় একটি কোটেশন ডরষষরধস জঁপশবষ ঝযধংি এর কথা মনে করিয়ে দেয় ‘Nature Provides a free lunch only if we control our appetites’ আজ তিনি পৃথিবীতে স্বীয় মাতৃত্ব, সহমর্মিতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তার নির্লোভ গুণাবলীর জন্য মানবতার জননী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা আমাদের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করব, সরকারকে সঠিকভাবে সহযোগিতা করব এ অঙ্গীকার করছি। স্রষ্টার কাছে বিনীত প্রার্থনা বাংলার মানসকন্যা, বঙ্গ সমাজের কুলবধূ, রমণীকুলের অলঙ্কার, বঙ্গভূমির অহঙ্কার, জগত নন্দিনী, জনম দুঃখিনী, মানবতার জননী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তুমি দীর্ঘায়ু কর, বাংলাদেশের অসংখ্য দরিদ্র মানুষের যেন ক্ষুধা ও নিরক্ষতার অবসান ঘটাতে পারেন তিনি। লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×