ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ডাকসু নির্বাচন তবে সুদূরপরাহত

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৯ অক্টোবর ২০১৭

ডাকসু নির্বাচন তবে সুদূরপরাহত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবন আছে। কার্যালয় আছে। আছে কাফেটারিয়ান। কর্মচারীও আছে। কিন্তু নেই ছাত্র প্রতিনিধি। অনেক ছাত্রই জানে না এই কার্যালয়টি কি কাজে ব্যবহার হয়। বছর বছর ছাত্ররা ডাকসু ফি দিয়ে আসছে। অথচ ডাকসু বলে কিছু নেই। এমন অবস্থা গত ২৭ বছর ধরেই চলে আসছে। শুধু ডাকসু নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনও হচ্ছে না এই সময় ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উপলক্ষ হচ্ছে তার শিক্ষার্থী। আর তাদের কথা বলার জায়গা হচ্ছে ছাত্র সংসদ। ক্লাস পাঠের বাইরে ছাত্র সমাজের সুকুমার বৃত্তির চর্চাসহ, সংস্কৃতি, ক্রীড়া চর্চার ক্ষেত্রটি এখন আর দৃশ্যমান নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন; শিক্ষক সমিতি, অফিসার সমিতি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী নির্বাচন হয়ে আসছে নিয়মিত। শুধু হয় না ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কিন্তু কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে সবাই যে মাথা ঘামায় তা নয়। পাকিস্তান যুগে, এমনকি সামরিক শাসনামলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। গত শতকের ১৯৯০ সালে শেষ নির্বাচন হয়েছিল। এরপর আর নির্বাচন হচ্ছে না গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবহার এই যুগে। একুশ শতকের শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্র সংসদ কি এবং কেন প্রয়োজন, সে বিষয়টি ধরা দেয় না। যাদের জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছে। সেই শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার পরিষদ ছাত্র সংসদ নেই। এই না থাকার ফলে শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক বিকাশের পথে পথে নানা অন্তরায় কাজ করছে। সারাদেশে এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো স্কুল পর্যায়ে ‘কেবিনেট’ নির্বাচন হয়েছে। স্কুল জীবনেই শিক্ষার্থীরা গোপন ব্যালটে ভোটদানের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করছে। একই সঙ্গে শিখেছে গণতন্ত্রের চর্চা করা। অর্জন করছে নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলী। কিন্তু এরাই যখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে, কি দেখবে তারা? দেখবে সেখানে ছাত্র সংসদ নেই, ছাত্র প্রতিনিধি বলে কিছু নেই; নির্বাচনও হয় না। তখন তাদের পূর্বে অর্জিত চর্চার বিকাশ ঘটবে কিভাবে? দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তারা আর নিজেকে তৈরি করতে পারবে না। দেশের কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাসিত আজ। এই এক বন্ধ্যা সময় ছাত্র সমাজের জন্য। ঢাকাসহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র প্রতিনিধি না থাকার ফল কি দাঁড়িয়েছে। সে নিয়ে কোন গবেষণা কাজও নেই। ছাত্ররাও যে নির্বাচন নিয়ে খুব আগ্রহী, তেমনটা পরিলক্ষিত হয় না। মাঝে মাঝে ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনের দাবি তোলে। কিন্তু সে কণ্ঠ অতি ক্ষীণ। গণতন্ত্র চর্চা, মূল্যবোধকে সমুন্নত করা, ছাত্র সমাজের অধিকার অর্জনের বিষয়গুলো আর প্রকটিত হয় না। নির্বাচন না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও দাবির বিষয়ে কথা বলার কোন পরিষদ নেই। নির্বাচন নেই বলে মেধাবী নেতৃত্বও আসছে না উঠে। বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সংস্কৃতিতে সুনাগরিক ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রক্রিয়া থমকে আছে। ছাত্র সংসদ না থাকায় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। সুতরাং ছাত্রদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ’৭৩-এ অবশ্য ছাত্র প্রতিনিধি থাকার বিধান রাখা হয়েছে। ডাকসু এ প্রতিনিধির নির্বাচক। এটা তো বাস্তব যে, সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনায় মতামত প্রদান থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরা যাচ্ছে না। সিনেটে বাজেট পাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিদের মতামত থাকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে ডাকসু থেকে নির্বাচিত পাঁচজন প্রতিনিধির ভোটাধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকারও রহিত অদ্যাবধি। এই অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং সম্পূর্ণ বেমানান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যেখানে ছাত্রদের কল্যাণ ও মঙ্গল এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলা, সেখানে তাদের বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করে রাখার অর্থ তাদের ‘বনসাই’ হিসেবে টিকে রাখা। বাংলাদেশের ইতিহাসই তো বলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। ডাকসুর নেতৃত্বেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ডাকসুর নেতারাই আজ দেশের রাজনীতিতে শীর্ষ পর্যায়ে। বাংলাদেশের ইতিবাচক ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। সৃষ্টি করেছে ঐতিহ্য এবং তা রাজনীতির আদর্শবাদী ধারায়, এমনটাই বলা হয়। ডাকসুকে বলা হতো দেশের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট।’ এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ডাকসুর এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ডাকসুর ভূমিকা রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে কম নয় বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তো সংঘটিত হয়েছিল ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে। সেদিন সারা পূর্ববঙ্গকে তিনি আলোড়িত করেছিলেন। তার অঙ্গুলির নির্দেশে সারাবাংলার ছাত্রসমাজ নেমে এসেছিল রাজপথে। জেলের তালা ভেঙ্গে মুক্ত করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। একাত্তরের মার্চে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম উত্তোলন করা হয়েছিল বাংলাদেশের পতাকা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আজ যখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে সংঘাত-সংঘর্ষসহ বিভিন্ন অপঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়, তখন ডাকসু নির্বাচনের অপরিহার্যতার কথা আরও বেশি গুরুত্ব পায়। শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকার কারণেই কোন বিশেষ সঙ্কটের সমাধানে বৈধ কর্তৃপক্ষ পাওয়া যায় না এবং তাই সঙ্কটের সমাধান তো হয়ই না বরং তা কখনও কখনও ঘনীভূত হয়। ছাত্র সমাজের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য হলেও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির আবশ্যকতা রয়েছে। ছাত্র সমাজের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ নেই। ছাত্র সংসদবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছাত্র সংসদ ছাড়া ছাত্র রাজনীতি যে প্রাণহীন, গত দু’দশকের পরিস্থিতি সে কথাই বলে। দেশে ছাত্র রাজনীতি বিদ্যমান রয়েছে অথচ সে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা চাওয়া হচ্ছে না। যদি ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা না থাকত, তবে ছাত্র সংসদেরও প্রয়োজন হতো না। গত তিন দশকে ছাত্র রাজনীতির চারিত্রিক ও গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। সামরিক জান্তা শাসকরা ছাত্র সমাজকে নিয়ন্ত্রিত রাখার জন্য নানা কলাকৌশল অবলম্বন করেছে। ডাকসুর নির্বাচিত এক জিএস তো বিরাশি সালে জান্তা শাসকের সঙ্গে ভিড়ে মন্ত্রী হয়েছিল। তাকে সেদিন ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর ও আশির দশকে ছাত্র রাজনীতি যে অবস্থানে ছিল, আজকে আর তা নেই। সে সময় ছাত্রনেতারা যে সম্মান পেতেন, এখন তারা আর সেই সম্মান অর্জন করতে পারেন না। ছাত্র রাজনীতিকেও জনগণ সহজ ও ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে বলে মনে হয় না বরং ছাত্র রাজনীতির প্রতি একটা বীতশ্রদ্ধভাব দেখা যায়। তরুণ ও মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিবিমুখ। সেই স্থান দখল করে নিয়েছে মেধাহীন, চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, লুটেররা চেতনাধারীরা, যারা ছাত্র রাজনীতিকে অর্থ আয়ের সুগম এক পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। একালের ছাত্রনেতারা লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া দেয়, দামী গাড়ি হাঁকায়, হেলিকপ্টার ও বিমানে চড়ে জেলা সফরে যায়। ‘অর্থই কেবলম’ মন্ত্র তারা আওড়ায়। সন্ত্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ অনেক ছাত্রনেতা, কেউ কেউ চোরাচালানি বা অন্যের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে পরিচিত। আদর্শহীন, চরিত্রহীন, অর্থলোভী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ, অর্ধশিক্ষিত, সর্বোপরি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারকরা যখন নেতৃত্বে সমাসীন হয়, তখন কলুষিত হতে বাধ্য ছাত্র রাজনীতি এবং শিক্ষাঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন সাধারণ ছাত্রদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ বন্ধ থাকার কারণেই ছাত্র রাজনীতি বর্তমান সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখন দেশে শতাধিক সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারীগুলোতে তো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ। ফলে সেখানে গোপনে গোপনে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দেয়। এসব শিক্ষার্থী সুকুমার বৃত্তি চর্চা থেকে দূরে দূরে অবস্থান করছে। রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য আবদুল হামিদ গত মার্চে ক্যাম্পাসে এসে বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন দিতেই হবে। এ নির্বাচন না হলে ভবিষ্যত নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই ভাষ্য প্রতিপালন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসেননি। ডাকসু সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, সেগুলো অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন ও তার স্বাধীন তৎপরতা শুধু একটি অধিকারের বিষয়ই নয়, তা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ ও দেশ গড়ার জন্য অপরিহার্য শর্তও। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর আশাবাদ জেগেছিল যে, নির্বাচন হবে। কিন্তু বাস্তবে তা সুদূর পরাহত। রেজা এনায়েত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন পায়নি। ভেবেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংসদ নির্বাচন পাবে। তাতে শুধু ভোটদান নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও স্বপ্ন ছিল। তার অগ্রজ ১৯৮০ সালে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিএস পদে ৪৭ ভোটে হেরেছিল। সেসব জানার পর তার মনে হতো, সেও ডাকসু নির্বাচন করবে এবং অগ্রজের পরাজয়ের শোধ নেবে বিজয়ী হয়ে। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সেও জড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতিও ছিল। নিয়মিত ছাত্র হলেও সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পায়নি। কিন্তু এখনও স্বপ্ন দেখে ডাকসু নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারলেও ভোট তো দিতে পারবে। রাজনীতির বন্ধ দরজাগুলো খুলে যাবে। সমাজ জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শিক্ষা নিয়ে প্রাগ্রসর সমাজ গঠন করতে পারবে। তার মতো আরও অনেকের স্বপ্ন ডাকসু নির্বাচন যেন করে। বর্তমান অসহিষ্ণু পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন করা অসম্ভব নয় বলে অনেকে ভাবে। ছাত্র সংসদের নির্বাচন মানে উৎসব। এই উৎসবের আয়োজন হলে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হবে। সংঘাত-সংঘর্ষ পরিহার হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও মনে করেন, ছাত্র সংগঠনগুলো চাইলে নির্বাচন দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজন শুধু সুন্দর পরিবেশ-পরিস্থিতির। নির্বাচনের জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ছাত্রসংগঠনগুলো যদি ঠিক থাকে, তারা যদি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে, তাহলে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন কঠিন নয়। বর্তমানের বাস্তবতায় এ নির্বাচন কোন দুরূহ বিষয় নয়। ছাত্রসংগঠনগুলো এ নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে দ্বিধাগ্রস্তপ্রায়। এমনিতে ডাকসু নির্বাচন খুব ব্যয়বহুল। গত শতকের শেষদিকে যেখানে ছিল ১১টি হল আর ছাত্রসংখ্যা ২২ হাজারের মতো, সেখানে এখন কুড়িটির বেশি হল এবং তিন ডজনের মতো বিভাগ। অনুষদ বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। সেখানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। ঊনসত্তর সাল পর্যন্ত পদ্ধতি ছিল, বিভিন্ন হল ছাত্র সংসদে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে বাছাই করে ডাকসুর নেতা নির্বাচন। ১৯৭০ সালে প্রথম সরাসরি নির্বাচন হয়। দেখা গেছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে সামরিক জান্তা শাসক আমলে ডাকসু ও কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে নির্বাচন হয়। কিন্তু তিহাত্তরের নির্বাচনের ভোটগণনার আগেই ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়ে যায়। এর পর ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১; ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে নির্বাচন হয়। আমাদের সময় যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাদের সৌভাগ্য যে, তারা পর পর তিনটি ডাকসু নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পেরেছে। আমি দুটি নির্বাচনে প্রার্থী হই। ’৭৯ সালে ডাকসুর সদস্য ও ’৮০ সালে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলাম। একই সঙ্গে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ছিলাম। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ডাকসুর মুখপত্র ‘ছাত্রবার্তা’, পহেলা বৈশাখ, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে সাময়িকী প্রকাশ করেছি। সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল ডাকসুর সাহিত্য সপ্তাহ। চার মাস প্রস্তুতি নিয়ে আয়োজন করেছিলাম। ডাকসু আমাদের সময় ছাত্রদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ছিল। ’৭৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতিকালে উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে ছাত্র শিবিরের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের কারণে তা আর ধোপে টেকেনি। আমাদের সময় ক্যাম্পাসে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়ায় জাগরণ ঘটেছিল। আজ সে সব শুধুই স্মৃতি। এ প্রজন্মের ছাত্ররা এ সব কিছু থেকে বঞ্চিত বলেই তাদের মেধা মনন ও সুকুমার বৃত্তিগুলো পুষ্ট হতে পারছে না। ডাকসুসহ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন বর্তমান বাস্তবতায় কেবলই সুদূর পরাহত মনে হয়। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন বহাল থাকা সঙ্গত নয়।
×