ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সালফিউরিক এসিডসহ ছয় শ’ লিটার তরল পদার্থ উদ্ধার ॥ গ্রেফতার ২

শেরপুরে জঙ্গীদের বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিকের গোডাউনের সন্ধান

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৮ অক্টোবর ২০১৭

শেরপুরে জঙ্গীদের বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিকের গোডাউনের সন্ধান

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর, ৭ অক্টোবর ॥ শেরপুরের নকলায় এবার জঙ্গীদের বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিকের গোডাউনের সন্ধান পাওয়া গেছে। গোডাউন থেকে নাইট্রিক এসিড, সালফিউরিক এসিড, ক্লোরোফর্ম ও ডাইক্লোমেথিনসহ বিস্ফোরক তৈরির প্রায় ছয় শ’ লিটার রাসায়নিক তরল পদার্থ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় শনিবার নকলা থানায় এসআই আব্দুস সাত্তার বাদী হয়ে গোডাউনের ভাড়াটে আবুল কাশেম (২২) ও ফয়েজ উদ্দিন (৩৩) এবং মালিক মিনারা বেগমসহ (৩২) অজ্ঞাত বেশ কয়েকজন জঙ্গীকে আসামি করে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় মিনারা বেগম ও ফয়েজ উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সকালে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি ও শেরপুরের পুলিশ সুপার রফিকুল হাসান গণিসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এরপরই ওই গোডাউনটি নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। এ ঘটনায় নকলাসহ শেরপুরে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। জানা যায়, সদ্য সমাপ্ত দুর্গাপূজায় শেরপুরের কেন্দ্রীয় নয়ানীবাড়ি মা ভবতারা মন্দিরসহ ৪টি মন্দিরে জঙ্গীরা নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ করছেÑ পুলিশ হেড কোয়ার্টারের এমন তথ্যে জেলা পুলিশ প্রশাসন বিভিন্নভাবে খুঁজতে থাকে এমন ঘাঁটি। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা বাজারের ‘তানিশা গার্মেন্টস এ্যান্ড সুজ’ নামে একটি তালাবদ্ধ দোকানে অভিযান চালিয়ে সেখানে জঙ্গীদের বিস্ফোরক তৈরির গোডাউনের সন্ধান পায় পুলিশ। ওই সময় ওই গোডাউনে তল্লাশি চালিয়ে ১৯ গ্যালন রাসায়নিক তরল পদার্থ উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক কেমিক্যালের মধ্যে রয়েছে ২শ’ লিটার নাইট্রিক এসিড, ১৬০ লিটার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ৬৫ লিটার সালফিউরিক এসিড+ টেট্রাহাইড্রো ফোরান, ১শ’ লিটার ক্লোরোফর্ম+ ডাইক্লোমিথেন, ৩৫ লিটার ডাইক্লোমিথেন, ৩৫ লিটার ক্লোরোফর্মসহ মোট ৫৯০ লিটার। ওইসব বিস্ফোরক কেমিক্যালের আনুমানিক মূল্য ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা হতে পারে। শুক্রবার ভোরে ওই দোকানঘরের মালিক স্থানীয় মৃত ছাইদুল ইসলাম বিপুলের স্ত্রী মিনারা বেগমকে আটক করে পুলিশ। এরপর ওইদিন উদ্ধারকৃত বিস্ফোরক কেমিক্যাল কি ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা ও বিস্ফোরণ ক্ষমতাসম্পন্ন তা নিশ্চিত করতে ঢাকা থেকে আগত ক্রাইম সিন বিভাগের ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি, সিআইডির ৭ সদস্যের একটি টিম সকাল থেকে ওই তরল পদার্থগুলো পরীক্ষা করে এবং রাতে সেগুলো বড় ধরনের নাশকতার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরির কাজে লাগত বলে পুলিশের কাছে রিপোর্ট হস্তান্তর করে। ওই রিপোর্টের পর রাতেই জেলা সদরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়গুলো স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের অবহিত করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম। ওইসময় তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ আগে গোয়েন্দা তথ্যে জানানো হয়েছিল, দুর্গাপূজায় জেলায় বড় ধরনের নাশকতার সৃষ্টি হতে পারে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে জেলার সর্বত্র গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। গোয়েন্দা রিপোর্ট ও পুলিশ হেডকোয়াটার্সের তথ্যের আলোকে ওই অভিযান পরিচালিত হয়। শনিবার দুপুরে নকলা এলাকা থেকে মামলার আসামি ফয়েজ উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া এজাহারনামীয় প্রধান আসামি আবুল কাশেমসহ অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তবে আবুল কাশেমের পরিবারের লোকজনের দাবি, বুধবার রাত ৯টার দিকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকে ৫-৬ জনের একটি দল কাশেমকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আর কেউ কাশেমের খোঁজ খবর জানে না। ওই বিষয়ে কাশেমের বড় বোন নকলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। শনিবার দুপুরে জঙ্গীদের ওই গোডাউনস্থল পরিদর্শন করেন ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি। ওইসময় তিনি বলেন, পুলিশের তৎপরতার কারণেই জঙ্গীরা এখন শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলকে নিরাপদ ঘাঁটি বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এতেও তারা পার পাবে না। পুলিশের সাইবার ক্যাবের মাধ্যমে সব ধরে ফেলা সম্ভব। এছাড়াও রয়েছে শক্তিশালী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। তিনি সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, উদ্ধারকৃত রাসায়নিক তরল পদার্থ দিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্য বা বোমা বানানো যেত, যা ব্যবহার করলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চন্দ্রকোনা বাজারের ‘তানিশা গার্মেন্টস এ্যান্ড সুজ’ নামে দোকানটি অধিকাংশ সময় দিনের বেলা বন্ধ থাকত। রাতে মাঝে-মধ্যেই সেটিতে ভাড়াটে আবুল কাশেমসহ কয়েকজনকে যাতায়াত করতে দেখা যেত। ঘরটির মালিক স্থানীয় মৃত ছাইদুল ইসলাম বিপুলের স্ত্রী মিনারা বেগম প্রায় ৮ মাস আগে পার্শ্ববর্তী চরমধুয়া গ্রামের ফয়েজ উদ্দিনের কাছে দোকান ঘরটি প্রতিমাসে ৬শ’ টাকায় ভাড়া দেন। কয়েক মাস পর ফয়েজ উদ্দিন ব্যবসায় লোকসান দেখে হুজুরীকান্দা গ্রামের মৃত ছাফিল উদ্দিনের ছেলে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ও চন্দ্রকোনা ব্রিজের কাছে ‘কাশেম মেডিক্যাল হল’ নামীয় একটি ওষুধ বিক্রির দোকানি আবুল কাশেমের কাছে ঘরটি ভাড়া দিয়ে দেয়। স্থানীয়দের ধারণা ছিল, কাশেম কলাহাটির ওই দোকান ঘরটি ওষুধের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করতে ভাড়া নিয়েছে, তাই হয়তো দিনের বেলা খোলার দরকার হয় না। শুধু রাতের বেলা খুলে পরের দিনের জন্য ওষুধ নিয়ে রাখত। এ ব্যাপারে শেরপুরের পুলিশ সুপার রফিকুল হাসান গণি বলেন, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সসহ গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং ওই রিপোর্টের আলোকে নজরদারি বাড়ানোর কারণেই জেলায় জঙ্গীদের একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। ওই ঘটনায় ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৪/৫/৬ ধারায় একটি নিয়মিত মামলা রেকর্ড হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই মামলায় ২ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং পলাতক থাকা প্রধান আসামি আবুল কাশেমসহ অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।
×