ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং জিএসপি পুনর্বহাল নিয়েও আলোচনা হবে

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীঘ্রই অংশীদারিত্ব সংলাপ ॥ এবার রোহিঙ্গা সঙ্কট দ্রুত সমাধানের বিষয় প্রাধান্য পাবে

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৮ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীঘ্রই অংশীদারিত্ব সংলাপ ॥ এবার রোহিঙ্গা সঙ্কট দ্রুত সমাধানের বিষয় প্রাধান্য পাবে

‍এম শাহজাহান ॥ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য ষষ্ঠ অংশীদারিত্ব সংলাপে এবার রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত সমাধানের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সংলাপে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া নিয়েও আলোচনা হবে। স্থগিত জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে বাংলাদেশের পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরা হবে সংলাপে। একই সঙ্গে টেকনোলজি ট্রান্সফার, ডিজিটাল ইকনোমি, বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগ চাইবে বাংলাদেশ। ষষ্ঠ অংশীদারিত্ব সংলাপে অংশ নিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে কার্যপত্র তৈরি করা হচ্ছে। শীঘ্রই রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ষষ্ঠবারের মতো অংশীদারি সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে পঞ্চম সংলাপ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং এক্ষেত্রে কি ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন সে বিষয়েও সংলাপ করা হবে। জানা গেছে, ষষ্ঠ অংশীদারি সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার-সেক্রেটারি বা ওই পর্যায়ের শীর্ষ কোন কর্মকর্তা। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাণিজ্য, বিদ্যুত ও জ্বালানি, শ্রম ও জনশক্তি, স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এই সংলাপে অংশ নেবেন। এদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও এবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন করে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়াসহ তাদের দেখভাল করছে সরকার। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নতুন চাপ তৈরি হয়েছে। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল দেশের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইনে সেফ জোন করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চেয়েছে বাংলাদেশ। অংশীদারি সংলাপেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়া হবে। যদিও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। টিফকা কার্যকর করার তাগিদ দু’দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি’ (টিকফা) করা হলেও কার্যত এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখনও কোন সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়নি। তৈরি পোশাকের ন্যায্যমূল্য, শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা এবং জিএসপি পুনর্বহালের মতো বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। এ কারণে এবারের সংলাপে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, এনার্জি কো-অপারেশন, জলবায়ু তহবিল এবং শুল্ক ও কোটামুক্ত পোশাক রফতানির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারিত্ব সংলাপকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হচ্ছে। কারণ এই সংলাপের সফলতার ওপর দেশের রফতানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও জ্বালানি খাতের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সেভাবেই সংলাপে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ষষ্ঠ অংশীদারিত্ব সংলাপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরো বিষয়টি দেখভাল করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যেহেতু সংলাপে বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয় রয়েছে তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিনিধি সংলাপে যোগ দিচ্ছে। তিনি বলেন, অংশীদারিত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্ক ও কোটামুক্ত পোশাক রফতানির সুবিধা চাওয়া হবে। তিনি বলেন, আমাদের এই দাবি পুরনো, তবে এটা কিভাবে বাস্তবায়ন ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও বাড়ানো যায় সংলাপে সে চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, এবারের সংলাপে রোহিঙ্গা সঙ্কট ও সমস্যা সমাধানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়া হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় প্রচলিত মার্কেট হচ্ছে ইইউভুক্ত দেশ। যেখানে পোশাক রফতানি হচ্ছে ৫৮ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। এই দেশটিতে ২৬-২৭ ভাগ পোশাক রফতানি হয়। এছাড়া কানাডায় রফতানি হচ্ছে মাত্র ৪-৫ শতাংশ পোশাক । কিন্তু এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধায় পোশাক রফতানির সুযোগ পাচ্ছে না। তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট। কারণ, দেশটি পোশাক নিচ্ছে বলেই বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও এককভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক আমদানিকারক দেশ। এ প্রসঙ্গে এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জনকণ্ঠকে বলেন, আগে প্রয়োজন দুই দেশের সমঝোতা, তবেই অংশীদারিত্ব সংলাপ সার্থক হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশই টিকফা বাস্তবায়নে যথেষ্ট আন্তরিক। তবে আশা করছি, এবারের সংলাপের পরই এ চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগোবে। আলোচনা ছাড়া যেমন ব্যবসা করা যায় না তেমনি সমঝোতা ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়ন হয় না। তিনি বলেন, এ চুক্তি বাস্তবায়ন হলেই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সংলাপে জিএসপি সুবিধা নিয়ে আলোচনা হবে জিএসপি সুবিধার বাইরেও পোশাক রফতানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। জিএসপি সুবিধার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, এই সুবিধা না নিয়েই কিভাবে রফতানি বাড়ানো যায় সে লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে সরকার। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বেড়েছে অনেক। আশা করছি, বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে রফতানি আরও বাড়বে। প্লাস্টিক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত জিএসপি স্থগিত হওয়ায় সরাসরি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্লাস্টিক শিল্পখাত। কারণ প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যেত। এ প্রসঙ্গে প্লাস্টিক শিল্পখাতের উদ্যোক্তা ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, জিএসপি স্থগিত হওয়ায় সরাসরি প্লাস্টিক শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে-মার্কিন বিনিয়োগ চীন-জাপানের পর অর্থনীতির পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চান। এক্ষেত্রে বিদ্যুত ও জ্বালানি, গ্যাস উত্তোলন, জাহাজ নির্মাণ, রিসাইক্লিং, রাসায়নিক সার, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধশিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটজাত পণ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, পর্যটন, চিকিৎসা উপকরণ ও টেলিযোগাযোগ খাত নিয়ে মার্কিন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ মাত্র সাড়ে চার শ’ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার; যা সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাত ছাড়াও বেশকিছু খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
×