ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চমৎকার ফিরে দেখা

হাতের লেখা, আলোকচিত্র পুস্তক ও স্মৃতি নিদর্শনে শওকত ওসমান

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৮ অক্টোবর ২০১৭

হাতের লেখা, আলোকচিত্র পুস্তক ও স্মৃতি নিদর্শনে শওকত ওসমান

মোরসালিন মিজান ॥ ‘এতরাতে কে হাসছে আমার মহলের দেয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয় না। এর উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ-দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে-বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে-এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন- আমার হিংসা হয়, মশরুর।’ ক্রীতদাসের মুখে অনাবিল এই হাসি দিয়েছিলেন শওকত ওসমান। আরব্য কাহিনী থেকে রচনা করেছিলেন অমর সাহিত্য। ‘জননী’র স্রষ্টাকে পাঠক আজকাল ভুলেই থাকেন। আরও কত শত সৃষ্টি! অথচ ক্ষণজন্মা কথাসাহিত্যিক বলা চলে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে একটু খুঁজে নেয়ার চেষ্টা হলো শনিবার। এদিন লেখকের বই পুস্তক হাতে লেখা চিঠি পত্র পোশাক আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করে জাতীয় জাদুঘর। যৎসামান্য আয়োজন। তবে চমৎকার ফিরে দেখা। জাদুঘরের লবির একাংশে আয়োজন করা হয়েছে প্রদর্শনী। এখানে বেশকিছু আলোকচিত্র। বিভিন্ন সময়ে ক্যামেরাবন্দী শওকত ওসমান। ছবিগুলো দেখতে দেখতে তাঁর সেই সময়টিকে দেখা হয়ে যায়। মাঝখানে কয়েকটি গ্ল্যাস শোকেস। একাধিক শোকেসে গ্রন্থ সম্ভার। উল্লেখযোগ্য বই দিয়ে সাজানো। শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস ‘জননী।’ বিপুলভাবে সমাধৃত উপন্যাসের একটি কপি রাখা আছে এখানে। বইয়ের খোলা পাতা থেকে জানা যাচ্ছে, এটি প্রকাশ করেছিল ঢাকা বুকস। পাশেই ‘জননী’র উর্দু সংসস্করণ। অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ‘সিলেক্টেড স্টোরিজ’, নির্বাচিত গল্প’, ‘রাজা উপাখ্যান’ ও শেখের সম্বরা।’ প্রদর্শনীতে আছে শওকত ওসমানের লেখা পা-ুলিপি। বিদেশী নাট্য কাহিনী অবলম্বেনে তিনি লিখেছিলেন ‘কর্ণভস্ম।’ পা-ুলিপিটি রাখা আছে গ্ল্যাস শোকেসে। অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক বলা যেতে পারে লেখকের নিজের হাতে লেখা চিঠিপত্রগুলোকে। স্পষ্ট সুন্দর হস্তাক্ষর। এতকাল পর পড়তে গিয়ে দারুণ একটা অনুভূতি হয়। চিঠিগুলো মূলত নিজের পরিবারের সদস্যদের লেখা। প্রয়োজনীয় কথা বার্তা হলেও, পত্র সাহিত্যের স্বাদ। নানা বিষয় ওঠে এসেছে এসব পত্রে। নিজের পরিবারের প্রতি সন্তানদের প্রতি তাঁর যে ভালবাসা, যে দায় বোধ, ছোট ছোট বলা থেকে বেশ অনুমান করা যায়। চিঠি পাঠে ধারণা পাওয়া যায় তাঁর রুচি সম্পর্কে। পুত্র জাঁ-নেসার ওসমানকে তিনি লিখছেন, ‘বই পাঠাচ্ছি। প্রচ্ছদ যেন সিনেমা পোস্টার। রুচিতে মেলে না। এরা করে বসেছে...।’ অর্থাৎ নিজের বইয়ের প্রচ্ছদটি কী হবে তা নিয়েও নিজস্ব ভাবনা ছিল শওকত ওসমানের। প্রদর্শনীতে আছে প্রয়াত লেখকের ব্যবহার করা নানা সামগ্রী। কলম চশমা ইত্যাদি স্মৃতি চিহ্ন হয়ে আছে। জীবদ্দশায় যেসব পোশাক পরিধান করতেন, সেগুলোও রাখা আছে। কিছু পোশাক ভীষণ চেনা। জীবদ্দশায় তাঁকে এসব পোশাকে নিয়মিতই দেখা গেছে। গোল গলা পাঞ্জাবিগুলো দেখে শওকত ওসমানের অবয়বটা দিব্যি কল্পনা করা যায়। সব মিলিয়ে মন্দ নয়। এদিন প্রদর্শনীর উদ্বোধন ছাড়াও, শওকত ওসমানের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনার আয়োজন করা হয়। সুফিয়া কামাল মিলনয়াতনে আয়োজিত আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক আন্দালীব রাশদী। অনেক বড় প্রবন্ধ লিখে এনেছিলেন বটে, লম্বা সময় ধরে পাঠ করার সুযোগ ছিল না। চৌম্বক অংশ তুলে ধরেন তিনি। বলেন, প্রয়াত লেখদের আমরা তেমন স্মরণ করি না। মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যে ভুলে যাই। শওকত ওসমানের বেলায়ও এ কথা সত্য। অথচ অত্যন্ত বড় মাপের লেখক ছিলেন তিনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, শওকত ওসমানকে হুট করে পড়ে ফেলা যায় না। এ জন্য পাঠকের একটা পূর্ব প্রস্তুতি দরকার হয়। প্রয়াত লেখকের ‘জননী’ উপন্যাসটির নানা দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, একসময় এটি পাঠ্য ছিল। এখন নেই। এটি দুর্ভাগ্যজনক। উপন্যাসটিকে উচ্চ মাধ্যমিকে পাঠ্য করার দাবি জানান তিনি। ঢাকার নাট্য মঞ্চকেও আলোকিত করেছিলেন। সে কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মলিয়ারের ৫টি নাটক অনুবাদ করেছিলেন শওকত ওসমান। ‘ডাক্তার আব্দুল্লাহর কারখানা’, ‘পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ’, ‘সন্তানের স্বীকারোক্তি’ নিয়মিত মঞ্চস্থ হতো। একেবারে সমকালীন প্রসঙ্গের অবতারনা করে তিনি বলেন, এই যে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্রোত বাংলাদেশে ঢুকছে, এটা যে হতে পারে তা শওকত ওসমান বহু আগেই বলে গিয়েছেন। আমরা বাংলাদেশকে তো মুসলমানের দেশ হিসেবেই প্রচার করি। তাহলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা অন্য দেশে যাবে কেন? মূল প্রবন্ধ পাঠের পর এর ওপর আলোচনা শুরু হয়। বক্তারা বলেন, শওকত ওসমান ছিলেন বড় মাপের সাহিত্য স্রষ্টা। তিনি আরবি ফার্সি উর্দু শব্দ ব্যবহার করে বাংলা ভাষার মধ্যে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছিলেন। মৌলবী সাহেবরা তার অনেক সমালোচনা করতেন। তাদের অভিযোগ ছিল, শওকত ওসমান ইসলাম সম্পর্কে কী সব বলেন টলেন। কিন্তু তারা জানেন না যে, ইসলাম সম্পর্কে শওকত ওসমানের ছিল অগাধ পা-িত্য। এ কালের কোন মুন্সি মৌলানা তার সঙ্গে বিতর্কে পেরে উঠতেন না বলে জানান তিনি। তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী আগামীকাল সোমবার পর্যন্ত চলবে।
×