ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ৮ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান

প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সে দেশের সামরিক বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গৃহে অগ্নিসংযোগসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দায় সোচ্চার হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যদিও গত চার দশক ধরে বাংলাদেশ লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহন করছে এতকাল এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি। বিষয়টা ছিল মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক। মাঝে মাঝে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ইসলামী দেশগুলোর সংস্থা ওআইসি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা নির্যাতন ও মিয়ানমারের সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সমালোচনা করেছে, কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ, হত্যা ও সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি। ১৯৭৮ সাল থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আসছে। শরণার্থী ইতিহাসের কোন দেশ এত বেশি সময় এত সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়নি যা বাংলাদেশ দিয়েছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রায় তিন লক্ষ পাকিস্তানীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের পাকিস্তান ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও নেয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশকে শরণার্থীর এই বিপুল বোঝা বইতে হচ্ছে- এ নিয়ে বাংলাদেশকে সহানুভূতি জানাবার পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন কথাও বলেছে- কেন আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ আশ্রয় দিচ্ছে না। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। যারা এক সময় এ নিয়ে বাংলাদেশের সমালোচনা করেছে, তারা এখন প্রশংসা করছে। ২৫ আগস্ট (২০১৭) মিয়ানমারের সামরিক অবস্থানে ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (আরসা)-র জঙ্গী হামলা ও হত্যার পর থেকে সামরিক বাহিনীর নজিরবিহীন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও গৃহে অগ্নিসংযোগসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণে রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে, এক মাসে তার সংখ্যা পাঁচ লাখ অতিক্রম করেছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) পর্যন্ত বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ৩৬ হাজার। এর আগে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে দশ মাসে এসেছে ৮৭ হাজার শরণার্থী। ১৯৭৮ সাল থেকে যারা এসেছে তাদের সংখ্যা যোগ করলে (এই নিবন্ধ রচনার সময় পর্যন্ত) বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর মোট সংখ্যা নয় লাখেরও বেশি হবে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডি বাংলাদেশে এসে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কোথাও এত দ্রুততার সঙ্গে শরণার্থী সঙ্কট এমন প্রকট হয়নি।’ গত ২৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জাতিসংঘের হাইকমিশনার। তিনি বলেছেন, তারা নারকীয় সব ঘটনার বিবরণ দিয়েছে। এসব ঘটনা তাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং এর কারণে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি এতকাল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় বা দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে পশ্চিমা বিশ্ব এড়িয়ে যেতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা এখন আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর (২০১৭) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জাতিনিধনের বিবরণ তুলে ধরে এই মানবিক বিপর্যয়ের স্থায়ী সমাধানের জন্য যে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, বাংলাদেশে জামায়াত-বিএনপি গং তার সমালোচনা করলেও জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের মানুষ জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে স্মরণকালের নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রত্যক্ষ করেছে। এই বাঙালী জাতি বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জাতির পিতার হত্যাকা-, নিজ দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন প্রভৃতি যেমন প্রত্যক্ষ করেছে, একইভাবে জাতিগত বিরোধে সংঘাতের পরিবর্তে কীভাবে শান্তি স্থাপন করা যায় সে সব ঘটনাও কাছে থেকে দেখেছে। এসব সমস্যা ও সংঘাতের সঙ্গে বসবাস করা এবং একে মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের যতটা আছে, বিশ্বের খুব কম জাতিরই তা আছে। যে কারণে জনসংখ্যার বিপুল ভার এবং আর্থিক অসচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বলতে পারেন, নিজেরা আধবেলা খেয়ে দশ লক্ষ শরণার্থীকে খাওয়াব- বিশ্বের অন্য কোনও নেতা সেভাবে বলতে পারেন না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আর্থিক সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন- ভারত দরিদ্র দেশ, আমরা জানি দারিদ্র্যের সঙ্গে কীভাবে বাস করতে হয়। বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছি, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসাও দিচ্ছি। আমি চাই বাঙালী জাতির নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের পাকিস্তানকে বাধ্য করবার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উদ্যোগী হবেন। অত্যন্ত বৈরী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা করেছিলেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা-ই করছেন- সংঘাতের পথ এড়িয়ে শান্তির পথে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধীর সেই ভারত এখন ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে চাইছে না, তারা নাকি সবাই সন্ত্রাসী! গত এক মাসে টেলিভিশনের বিভিন্ন টক শো-এ এবং গোলটেবিল বৈঠকে জামায়াত-বিএনপির নেতারা এবং তাদের তল্পিবাহক পেশাজীবীরা তারস্বরে বলছেন, বাংলাদেশ কেন যুদ্ধ করে আরাকান দখল করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেখানে পুনর্বাসন করছে না। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্য রাখাইন রাজ্যে যে নিরাপদ বলয় গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, জামায়াত-বিএনপির জোট তা প্রত্যাখ্যান করেছে। হেফাজতে ইসলাম ঘোষণা দিয়েছে কক্সবাজারে তারা মহাসমাবেশ করবে। বাংলাদেশের মানুষদের বোঝাবার কোন দরকার নেই- মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কীভাবে রোহিঙ্গানিধন করছে। বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ এ ক্ষেত্রে এক পঙক্তিতে অবস্থান করছে। হেফাজতীরা যদি কিছু করতে চান তাহলে সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে বলুন উম্মাহর স্বার্থে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। ২০১৩ সালে মহাতা-বের পর শেখ হাসিনার সরকার হাজার হাজার আলেম হত্যা করেছেÑ এসব মিথ্যাচার করে হেফাজত নেতারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বহু অর্থ এনেছে। রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে চাইলে এই অর্থ তারা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিতে পারে। ঘোষিত মহাসমাবেশ করতে গিয়ে হেফাজতের যে টাকা খরচ হবে সেটা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দিলে দলের নেতাদের মিথ্যাচারের গুণাহর খাতা কিছুটা হাল্কা হতে পারে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে সেদিকে সবার কঠোর নজর রাখা দরকার। এবার দুর্গাপূজার প্রাক্কালে ‘জাতীয় পূজা উদযাপন পরিষদ’ বলেছে, পূজার জাঁকজমক যতটা সম্ভব কমিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। বিভিন্ন পূজাম-পে তারা দানবক্স রেখেছিলেন রোহিঙ্গাদের জন্য। তাদের এই ঘোষণা ও কার্যক্রম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জামায়াত-হেফাজতী মোল্লাদের মুখে এবার শুনিনি কোরবানি ঈদের আগে এমন কোন ঘোষণা দিতে। আমরা সব সময় রোহিঙ্গাদের কথা বলার সময় ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’ বলি। রোহিঙ্গারা একটি ভাষাভিত্তিক জাতি। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান হলেও এবারের সহিংসতা থেকে হিন্দু রোহিঙ্গারাও রেহাই পায়নি। গত এক মাসে পাঁচ শতাধিক হিন্দু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তারা ‘আরসা’র জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দ্বারাও আক্রান্ত হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলা বিডিনিউজ ২৪ ডটকম এর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘হিন্দু শরণার্থীদের অভিযোগ রোহিঙ্গা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে।’ ২৬ সেপ্টেম্বর রাখাইনে গণকবর আবিষ্কারের যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-এর শিরোনাম হচ্ছেÑ ‘রাখাইনে হিন্দুদের গণকবর : ২৮ হিন্দু নারী ও ছেলে শিশুর লাশ উদ্ধার।’ বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ সীমিত সাধ্য নিয়ে যেভাবে অসহায় নির্যাতিত শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ কথা ঠিক যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আরও কয়েকটি দেশ আশ্রয় দিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে তুরস্ক, জর্দান, লেবানন ও মিসর আশ্রয় দিয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ সিরীয় শরণার্থীকে। এর আগে বহু দেশ আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে এসব দেশে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য যেমন প্রচুর জমি আছে, তেমনি তাদের আর্থিক সঙ্গতিও বাংলাদেশের কয়েক গুণ বেশি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি তথাকথিত মুসলিম উন্মাহকে বুঝিয়ে দিয়েছে মানবতার প্রকৃত অর্থ কী। (চলবে)
×