ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর পাল্টে যাচ্ছে এলাকার দৃশ্যপট

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৭ অক্টোবর ২০১৭

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর পাল্টে যাচ্ছে এলাকার দৃশ্যপট

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর পাল্টে যাচ্ছে এখানকার দৃশ্যপট। স্প্যানটির পাশে এখন আর ‘তিয়ান ই হাউ’ জাহাজটি নেই। ৩৬শ’ টন ক্ষমতার ক্রেনের সঙ্গে স্প্যানটি বাঁধা ছিল প্রথম দিন। বেয়ারিংয়ের সঙ্গে ৩২ শ’ টন ওজনের স্প্যানের প্রয়োজনীয় নাটবোল্ট স্থাপনের পরই ক্রেনবাহী জাহাজটি সরিয়ে কিছুটা দূরে নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে। এখন স্প্যানটি (সুপার স্ট্রাকচার) খুঁটির সঙ্গে ভর করে যথাযথভাবে বসে আছে। তাই এখন সেতুর অবয়বটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হচ্ছে। নিজ চোখে এই দৃশ্য দেখতে নানাস্থান থেকে আসছে কৌতূহলী মানুষ। বিদায়ী শরতে পদ্মা এখন শান্ত। পাশের বিশাল চরের কাশবন। নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলার ছোটাছুটি। আর ব্যস্ততম পদ্মায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাঙালীর বীরত্ব গাথা পদ্মা সেতু। সেটি দেখে যে কত আনন্দ উপভোগ করছে মানুষ তা লিখে বোঝানো যাবে না। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ফেরি পারাপারের সময় সকলের চোখ এই সেতুর দিকে। শুধু সেতু নয় সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞে ভারি ভারি নানা যন্ত্রপাতি এবং হরেক রকম ব্যবস্থা চোখে পড়ে। আর রাতে এই কাজের দৃশ্য দেখতে আরও অন্য রকম। পদ্মায় বিশেষ এই ঝিলিক এখন বাঙালীর হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত এই পথে যাওয়ার স্মৃতি আর নানা বিষয় তুলে ধরে লিখেছেন- ‘১৯৭১ সালে অনেক বাধা অতিক্রম করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে- আমরা নিজের জন্য নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারি। দেশকে এমন একটি গৌরবের স্থান উপহার প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।’ এখানে আসা মানুষের উচ্ছ্বাস অনেক বেশি। ঢাকার বনানী থেকে আসা মামুন মিয়া বলেন, বাঙালীরা কি করতে পারে তা দেখালেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন। আর রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তার বুদ্ধিমত্তায় বাঙালীদের অবস্থান তুলে ধরেছেন উচ্চ আসনে। বারিধারা থেকে আসা ¯œাতকের ছাত্রী সুমি আক্তার বলেন, নারীরাও দেখাল কি করতে পারে। এমন বুদ্ধিমতী ও সাহসী রাষ্ট্রপ্রধান থাকলে জাতির অগ্রগতি অবধারিত। এদিকে প্রথম এই স্প্যান স্থাপন নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এই স্প্যানটির দু’পাশে আরও স্প্যানযুক্ত হবে। এর পরই চূড়ান্তভাবে ওয়েল্ডিং করে তারপর সব নাট লাগিয়ে দেয়া হবে। ৩৮ ও ৩৯ নম্বর খুঁটির সঙ্গে ৭বি নম্বর স্প্যান স্থাপনের কথা রয়েছে। তবে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে খুঁটি তোলার কাজ কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। পদ্মায় এখন পাইল ড্রাইভ চলছে সমানে। দুটি হ্যামারই পাইল বসাচ্ছে। মাওয়া প্রান্তের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও জাজিরা প্রান্তের ৩৬ নম্বর পিয়ারে হরদম চলছে পাইল ড্রাইভ। শুক্রবার ২৪শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি পাইল ড্রাইভ করছিল ৩৬ নম্বর পিয়ারে। আর ১৯শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি পাইল বসাচ্ছে ১৪ নম্বর পিয়ারে। নদীতে ২৪০টি পাইলের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭৭টি পাইল বসেছে। তবে এরমধ্যে ৫৭টি পাইল সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ২০টি পাইলের বটম সেকশন হয়েছে। তীরেরও অনেক পাইল বসে গেছে। এখন এগুলোর খুঁটি উপরে ওঠাতে রড বাঁধা এবং কংক্রিটিং প্রয়োজন, সেজন্য প্রয়োজন প্রচুর শ্রমিক। আরেকটি হ্যামার ডিসেম্বরে এই বহরে যোগ দিচ্ছে। তাই পাইল স্থাপনের গতি আরও বাড়বে। কিন্তু এখানে শ্রমিকের অভাব রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, মাওয়া প্রান্ত, জাজিরা প্রান্ত এবং নদীর কাজে এখন দেড় হাজার শ্রমিক প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত শ্রমিক নেই। মূল সেতুতে এখন প্রায় ৪ শ’ শ্রমিক কাজ করছে। এই প্রসঙ্গে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানান, মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি এখানে চাহিদা অনুযায়ী মজুরি কম দেয়ার কারণে শ্রমিক সঙ্কট চলছে। শ্রমিকদের এখানে প্রায় ৯ হাজার টাকা বেতন এবং একবেলা খাবার দেয়া হচ্ছিল। তাই এই কম বেতনে শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী কম। অনেকে কিছুদিন কাজ করলেও পরে চলে যাচ্ছে। আবার নতুন শ্রমিক নিয়ে কাজের সেট করতে সময় অপচয় হচ্ছে। কারণ যে শ্রমিক এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে তারা চলে যাওয়াই সমস্যা। দায়িত্বশীল সূত্রটি জানায়, ৩৯ নম্বর পিয়ারের কাজ দ্রুত হচ্ছিল। খুঁটিটি উপরে ওঠানোর জন্য কংক্রিটিং করার কথা ছিল আরও দু’সপ্তাহ আগে। কিন্তু শ্রমিক চলে যাওয়ায় তা ঢালাই করা সম্ভব হয়নি। এই সূত্রটি জানায়, মোঃ আজাদ নামের শ্রমিক এসেছিলেন বগুড়া থেকে। তার সঙ্গে আরও বেশ কিছু শ্রমিক ছিল। নদীতে রোদের মধ্যে কঠোর পরিশ্রম কিন্তু মজুরি কম হওয়ায় চলে গেছেন। তারপরও সেতুর গতি এগিয়ে নিতে সব রকম চেষ্টাই চলছে। এখন নদীতে মূল সেতুর সঙ্গে অন্যান্য কাজেও গতি পেয়েছে। সংযোগ সেতুর কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। জাজিরা প্রান্তে ১৯৩ পাইলের ১৯০টিই স্থাপন হয়ে গেছে। বাকি মাত্র ৩টি। ২/৪ দিনের মধ্যেই জাজিরা প্রান্তের এই সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) পাইল স্থাপন সম্পন্ন হচ্ছে। তাই পুরো সেট চলে আসছে মাওয়া প্রান্তে। মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সেতুর পাইল বসবে ১৭২টি। ডিজাইন চূড়ান্ত করতে বিলম্বের কারণে মাওয়ায় সংযোগ সেতুর কাজ শুরু হয় বিলম্বে। সম্প্রতি শুরু হওয়া মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সেতুর পাইল বসেছে এ পর্যন্ত ৯টি। নদীতে মূল সেতুর মোট ২৪০টি পাইলের মধ্যে ৭৭টি পাইল বসেছে। যার মধ্যে ৫৭টি পাইল বসেছে পুরোপুরি। বাকি ২০টির পাইল বসেছে বটম সেকশনে। এছাড়াও দু’পারের দুটি ট্রান্সজিশন পিয়ারের ৩২টির মধ্যে ১৬টি স্থাপন হয়েছে। অর্থাৎ জাজিরা প্রান্তে ৪২ নম্বর পিয়ারের ট্রান্সজিশন পিলারের ১৬টি পাইল বসে গেছে। এখন বাকি মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর ট্রান্সজিশন পিয়ারের ১৬টি পাইল। এটির কাজ এখনও শুরু হয়নি। ডিজাইন চূড়ান্ত হচ্ছে শ্রীঘ্রই। এদিকে বাকি ১৪টি পিয়ারের ডিজাইন নিয়ে কাজ করছে ব্রিটেনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘কাউই’। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই ডিজাইন চূড়ান্ত করার কথা ছিল। শীঘ্রই এই ডিজাইন পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এদিকে এই ডিজানের কাজে লন্ডনে অবস্থান করছেন পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদের। আগামী ১২ অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। প্রথম স্প্যানটি স্থাপনের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্যান্য স্প্যানও ওঠানো শুরু হবে। এখন ৩৭ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত ছয়টি পিয়ার সম্পন্ন হওয়ার পর্যায়ে। ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিয়ারের কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। ৩৮ পিয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দু’ পিয়ার ধরে আরও দুটি স্প্যান বসবে শীঘ্রই। স্প্যানের মাঝ বরাবর নিচের লেনে চলবে ট্রেন। উপরে কংক্রিটের চার লেনের সড়কে চলবে গাড়ি। তাই এই স্প্যানের ওপর রাস্তা এবং নিচে ট্রেন লাইন স্থাপন করা হবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় সাড়ে ৪৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দুটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিয়ার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে দুটি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এছাড়া দু’পারের সংযোগ সেতুসহ সেতুটি ৯ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
×