ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা জট ২

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার বন্ধ, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নেই

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৭ অক্টোবর ২০১৭

মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার বন্ধ, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নেই

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার শেখ মোঃ আব্দুল মজিদ ওরফে মজিদ মওলানাসহ ছয় রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষী হামিদা খাতুন বলেন, পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা আমাদের বাড়িতে আসে। ভয়ে আমি ও আমার ছোট ভাই,চাচি জমিলা খাতুন ও দাদি আমার চাচি জমিলা খাতুনের ঘরে আশ্রয় নেই। পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকাররা আমার চাচি জমিলা খাতুন ওরফে নায়েবের মাকে চৌকির নিচ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে। তারা জমিলা খাতুনের কাপড়চোপড় টানাহেঁচড়া করে খুলে ফেললে তিনি কান্নাকাটি করতে থাকেন। তখন ঐ রাজাকাররা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং তিন পাকিস্তানী সৈন্য চাচিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এটা শুধু হামিদা খাতুনই নন এমন অনেক সাক্ষী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ,গণহত্যা ,ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা দিয়েছেন। শুধু এ মামলাই নয় ইতোমধ্যে ২৮ টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আপীল বিভাগে ৭টি মামলার চূড়ান্ত নিষ্প্িত্ত হয়েছে। আর আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ১৭টি মামলা। সাতটি রায়ের মধ্যে ৬টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগ চূড়ান্ত রিভিউয়ের রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদ- বহাল রেখেছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বর্তমানে চেয়ারম্যান না থাকার কারণে ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, শীঘ্রই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হবে। ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে আবার গতি আসবে। বন্ধ হওয়া মামলাগুলোর বিচার কাজ শুরু হবে। উল্লেখ্য, ১৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ারুল হকের মৃত্যুর পর থেকে বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার পর থেকে প্রায় ১০ সাক্ষীকে ঢাকা থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। চেয়ারম্যানের মৃত্যুতে ট্রাইব্যুনালের কাজ না চলায় বিচারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। আমরা চাই ট্রাইব্যুনাল দ্রুত পুনর্গঠন করে বিচারকাজ আবারও শুরু হোক। বিচার দ্রুত হওয়াটাই বিচারপ্রার্থীদের দাবি। এ দাবির কারণেই দুটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল। এখন মামলার যে জট বৃদ্ধি হচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের মতামত হলো, আবার দুটো ট্রাইব্যুনাল সক্রিয় করা হোক। মামলার বিচারকাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা হোক- এটাই সবার চাওয়া। বিভিন্ন দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেই শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়নি; বিশে^র বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধে এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তারও আগে অটোম্যান যুগে আর্মেনিয়াতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর, ভিয়েতনাম যুদ্ধে খোদ আমেরিকার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। ৮০’র দশকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কম্বোডিয়াতে খেমারুজরা নারকীয় নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। আর্জেন্টিনা, রুয়ান্ডা, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও সাবেক যুগোশ্লাভিয়াতে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, লিবিয়াসহ বেশকিছু দেশেও মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে । ১৯৯৮ সালে রোম সংবিধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আদালতটি ২০০২ থেকে কার্যকর আছে। এই আদালত ছাড়া আরও দুই ধরনের আদালতের মাধ্যমে, যথা অভ্যন্তরীণ আদালত, (যেমন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) এবং বিশেষ আন্তর্জাতিক আদালত, (যেমন আইসিটিওয়াই এবং আইসিটিআর), আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হয়ে থাকে। পাশাপাশি, জার্মানি এবং রুয়ান্ডার জেলা আদালতগুলোতেও বিশেষ আদালত আছে যারা এসব অপরাধীর বিচার করে থাকে। বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করছে। শীঘ্রই ট্রাইব্যুনালে গতি আসবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০লাখ মানুষ শহীদ হয়। ইজ্জত হারায় ৪ লাখ মা- বোন। নির্যাতনের মুখে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলা বাড়ার কারণে ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তীতে মামলা কমে আসায় ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর দুটি ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৩৩টি মামলায় ১৩৫ আসামির মামলা রয়েছে ট্রাইব্যুনালে। তদন্ত সংস্থা ৫৯৪টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ২১০ জনের বিরুদ্ধে ৭৬টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ৫৩ টি মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। আরও ২৬টি মামলার তদন্ত করছে। বর্তমানে তদন্ত সংস্থায় আরও ৩৫০২ জনের বিরুদ্ধে ৬৪৩টি অভিযোগ পড়ে আছে। এই সময়ে তদন্ত ধীর গতিতে চললেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাফল্য বেশি। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর বলেছেন, এই সাত বছরে অর্জন বলতে গেলে অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো সাফল্য অর্জন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছি যে,গণহত্যা যুদ্ধাপরাধ ,মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অদম্য সাহসী ও আপোসহীন। তবে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুদন্ড, আমৃত্যুদন্ড ও তদন্তাধীন এমন মামলায় ৭৫ জনের তো আসামি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচারপ্রার্থী ও ভিকটিমগণ এ বিষয়ে হতাশ। আইন প্রয়োগকারী বাহিনী এ বিষয়ে আরও সতর্ক হলে সন্তুষ্ট হওয়া যেত। সমান আইনী সুবিধা ভোগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের যে বিচার চ্ছে তা সারা বিশ্বে মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে যে সুযোগ-সুবিধা নেই তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রয়েছে। এখানে আসামি ও সরকার পক্ষকে সমান সুযোগ দেয়া হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় সব পক্ষ সমান আইনী সুবিধা ভোগ করছেন। এ কারণে এই ট্রাইব্যুনাল সারাবিশ্বে যেমন সমাদৃত হয়েছে তেমনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ ছাড়াও রয়েছে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার ও অধিকারের উৎস, অভিযোগ সম্পর্কে জানার অধিকার, আইনজীবী নিয়োগের অধিকার, দ্রুত বিচার এবং উন্মুক্ত শুনানি, প্রাক বিচার পর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার, জামিনে মুক্তি, ডিসক্লোজার অব ডকুমেন্টস এবং ডিফেন্স প্রস্তুতির জন্য সময়, অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার সর্বশেষ আপীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু জনকণ্ঠকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যা পৃথিবীর অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে নেই। এখানে সরকার ও আসামি পক্ষ সমান সুযোগ পাচ্ছেন। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জনকণ্ঠকে বলেন,বিশ্বের অনেক দেশেই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে রুয়ান্ডা, সাবেক যুগোশ্লাভিয়া, কম্বোডিয়া, সিয়েরালিয়ন, বসনিয়া, জার্মানি, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনা, পেরু, উরুগুয়ে, চিলি, প্যারাগুয়ে, মেক্সিকো, কানাডা, লিবিয়া, ফ্রান্স, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। এ সমস্ত ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতো কোনভাবেই স্বাধীন নয়। এমনকি নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালেও আসামি পক্ষের কোন আপীল করার সুযোগ ছিল না। সেদিক থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষ আপীলের সমান সুযোগ পাচ্ছেন। সূত্র মতে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের পর কতদিনের মধ্যে তার বিচার হতে হবে সে বিষয়টি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংশ্লিষ্ট আইনে কোন স্বীকৃতি নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অপরাধ সংঘটনের এমনকি কয়েক দশক পরও ঐসব অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আদৌ কর্তৃত্বশূন্য হবে না। এই কারণে এবং ঐসব অপরাধ সংঘটনের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট দায়বদ্ধতার ধারণাটি আন্তর্জাতিক আইনের অংশ হিসেবে ক্রমবর্র্ধমানভাবে স্বীকৃত হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, ষাটের দশকে ইন্দোনেশিয়ায় , ১৯৭১ এ বাংলাদেশে, সত্তরের দশকে কম্বোডিয়ায় এবং আশির দশকে ইরাকে সংঘটিত ঐসব গুরুতর অপরাধের তদন্ত চলছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধের বিচারও শুরু হয়েছে। এমনকি শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল বিদ্রোহ দমনে এলটিটি নেতা প্রভাকরন ও তার শিশু ছেলেসহ হাজার হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করে। জাতিসংঘ এই হত্যাকান্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে। যদিও শ্রীলঙ্কা সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না। হয়ত সরকার পরিবর্তন হলে সেখানেও এ হত্যাকান্ডের বিচার হতে পারে। স্মৃতিফলকগুলো দালিলিক সাক্ষ্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের হত্যা করা হয়েছিল, সেই বধ্যভূমি ও গণকবর আজও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ ৪২ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গণকবর, বধ্যভূমি ও সেখানকার স্মৃতিফলক দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে উঠে এসেছে। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন পক্ষ এ সমস্ত দলিল দিয়ে মানবতাবিরোধী মামলার অভিযোগ প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন। মামলায় হত্যা ও গণহত্যার প্রমাণের জন্য তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন বিভাগ বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থান তুলে ধরেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ সংরক্ষণের অভাবে বেশ কিছু বধ্যভূমি ধংসের পথে। দেশের ৯৯ ভাগ বধ্যভূমিই গ্রামে।বেশিরভাগ বধ্যভূমিই ব্যক্তিগত জমির ওপর। প্রথম পর্যায়ে তিন হাজার বধ্যভূমি শনাক্ত হলেও ক্রমাগত তা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদেশীরা মন্তব্য করেছেন,একাত্তরে যে হত্যাকান্ড হয়েছে তা নাৎসি গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বীভৎস। ইতোমধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুলনার চুকনগরে একটি বধ্যভূমির আর্কাইভ করা হয়েছে। একাত্তরের পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর,আলশামস কিভাবে হত্যা ,গণহত্যা,ধর্ষণ, নির্যাতন করেছিল তা মানবতাবিরোধী অপরাধের আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এসে সাক্ষীদের জবানবন্দীতে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মৌখিক সাক্ষী ছাড়াও এ সমস্ত মামলায় দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে দেশের বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানগুলো উঠে এসেছে। পাশাপাশি অনেক বধ্যভূমি ও গণকবরে যে ফলক আছে তাও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর বধ্যভূমি সংরক্ষণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়। আমরা এ বিষয়ে ক্রমাগত বলে আসছি। বাধ্য হয়ে খুলনার চুকনগরে ব্যক্তিগতভাবে আর্কাইভ করেছি। প্রথম পর্যায়ে তিন হাজারের মতো বধ্যভূমি শনাক্ত করা হয়েছিল। বেশিরভাগ বধ্যভূমিই ব্যক্তিগত জমির ওপর। ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ৯৯ ভাগ বধ্যভূমি গ্রামে। আমরা বধ্যভূমি নিয়ে কথা বলতে আমাকে ও মুনতাসীর মামুনকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। যেখানে বধ্যভূমি ছিল সেখানে আজ বেগুন ক্ষেত। কৃষক বলে আমরা শুনেছি এখানে বধ্যভূমি ছিল। প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা জনকণ্ঠকে বলেছেন, মামলা প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্র পক্ষের। যখন কোন গণহত্যা হত্যা হচ্ছে তখন এটি প্রমাণের জন্য যেমন সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য প্রয়োজন। তেমনি দালিলিক সাক্ষ্য ও ছবি প্রয়োজন। সে কারণে দেখা যাচ্ছে মামলাগুলোতে তদন্তকালীন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ তারা যে সমস্ত জায়গায় গণহত্যা, হত্যা সংঘটিত হয়েছে সেখানকার বধ্যভূমির ছবি এবং বধ্যভূমির ফলক সেগুলো কিন্ত নিয়ে আসছে। প্রসি্িকউশন পক্ষ থেকে আমরা সাক্ষীদের বক্তব্যের সঙ্গে নিদর্শনপত্র হিসেবে সে সমস্ত দালিলিক প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করছি। আইনেই আছে ছবিসহ অন্যান্য দালিলিক প্রমাণ আইনের আওতায় গ্রহণযোগ্য। ট্রাইব্যুনাল সেগুলো বিবেচনার ক্ষমতায় রাখে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, এ যাবৎ গণকবর ও গণহত্যার স্পট আবিষ্কৃত হয়েছে ৯২০টি। ৮৮টি নদী ও ব্রিজের ওপর হত্যা-নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আসামিদের গণহত্যা-হত্যার চিহ্ন হয়ে উঠে এসেছে এ সমস্ত গণকবর আর বধ্যভূমিতে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আজও এ সমস্ত বধ্যভূমি ও গণকবর দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের সঠিক ইতিহাস শেখার জন্য এ সমস্ত বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজন। রেহাই পায়নি শিশু-মহিলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগী নারীগণ জবানবন্দী দিয়েছেন। তাদেরকে ক্যামেরা ট্রায়ালে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তিতর্কে প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি তার সম্পত্তি থেকে (ভিকটিম) ধর্ষিতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪লাখ মা- বোন নির্যাতিত হয়েছিলেন। কয়েক সাক্ষীর মাধ্যমে সেদিনের নিষ্ঠুর চিত্র উঠে এসেছে। প্রসিকিউশন পক্ষ আশা করছে, যদিও এখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদ- আসেনি। হত্যা,গণহত্যার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। যে মহিলা ধর্ষিত হয়ে বেঁচে আছে সেই নারীকে প্রতি মুহূর্তে হত্যা করছে এই সমাজ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার,আলবদর আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি ছোট্ট পুতুল খেলার ৫ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধাও। এই নারী নির্যাতন যুদ্ধাপরাধের একটি অংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সমস্ত যোদ্ধা খেতাব পেয়েছেন নির্যাতিত নারীরা তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সুন্দরী নারী ও মেয়েদেরকে আর্মিরা ক্যাম্পে আটক রেখে সারা শরীর কামড়ে রক্তাক্ত করেছে। আর্মিদের ইচ্ছে মতো কাজ না করায় তাদের বেয়নেট দিয়ে স্তন কেটেছে। যৌনাঙ্গে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। মেয়ের সামনে মাকে, বাবার সামনে মেয়েকে, মাকে ধর্ষণ করেছে হানাদার পাকবাহিনী। তারা মানুষ না। মানুষরূপী জংলী প্রাণী। পুরুষদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু কোন মহিলাকে সরাসরি হত্যা করেনি। মহিলাদের নির্যাতন করার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ক্যাম্পে আটক রাখা হয়েছে যৌনদাসী হিসেবে। এমনি ৪লাখেরও বেশি মা-বোনের নির্যাতিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নারী প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, একাত্তরের ৪ লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছিল বলে বলা হচ্ছে। আসলে এর সংখ্যা আরও বেশি হবে। তিনি বলেন বেশ কয়েক নারী তথ্য দিয়েছেন। যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাঙ্গামাটির ঝর্না দাশ, মীরা রানী বড়ুয়া,নাটোরের জোহরা বেগম,শরিয়তপুরের মিনতি বালা পোদ্দার, রমলা দে,মধুবালা দে, বানু বিবি,ঝনা বালা দে, তরুণী দেবী,অনন্তবালা পাল, পটুয়াখালীর পিজীতা রায়, শ্রীজিতা রায়, মৌমিতা রানী বালা, রাজশাহীর সুরজান,শোভা, বরগুনার পুতুল রানী বিশ্বাস, মল্লিকা গাঙ্গূলী,অনিমা গাঙ্গুলি, আমিনা খাতুন,ঝালকাঠির শ্যামলি পাল, আশারানী ম-ল,মাগুরার শ্যামলী রানী, দিনাজপুরের আসমা খাতুন, পিরোজপুরের নাজমা বেগম, সুরুচি রানী সাহা,ঝালকাঠির সাবিতা রানী সাহা, ঢাকার হনুফা, মুন্সিগঞ্জের কাঞ্চন মালা, সিলেটের ছায়ারুন, রাঙ্গামাটির রাশিদা দেবী চাকমা,নুরজাহান বেগম, ফরিদপুরের বিউটি বেগম, বরগুনার জমিলার মা, স্মৃতি রানী ঘোষ, হরিদাশী ঘোষ,ঝালকাঠির শোভা রানী দাশ , টাঙ্গাইলের রওশন আরা, ভানু বেগম,নরসিংদীর কনা রানী দাশ, শরীফা খাতুন, বুলি বেগম,জ্যোৎস্না বেগম, নোয়াখালীর হাসিনা বেগম, ঠাকুর গায়ের চানমনি সাখিনা, কুড়িগ্রামের রঙিলার মা, রাজশাহীর পারুল বেগম, সাতক্ষীরার রইসন, নারায়ণগঞ্জের লক্ষী রাণী পাল ।
×