ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্প প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই বাছাই পর্যায়ে

দেশে লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার দক্ষ জনবলের অভাবে সম্ভব হচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৭ অক্টোবর ২০১৭

দেশে লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার দক্ষ জনবলের অভাবে সম্ভব হচ্ছে না

নিখিল মানখিন ॥ অর্থ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দেশে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, লিভার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে পাড়ি দিতেই হয়। বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সেন্টার গড়ে উঠলে প্রতিটি লিভার প্রতিস্থাপন ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে। যা দেশের বাইরে লাগে ৯০ লাখ থেকে আড়াই কোটি টাকা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক রোগীকে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে হয়। তবে লিভার প্রতিস্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। লিভার প্রতিস্থাপনে কয়েকবার সফলতার মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। বারডেম ও ল্যাবএইডের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ও খুব শীঘ্রই লিভার সংযোজন শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে। এভাবে দেশে একাধিক হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ লিভার সংযোজন কার্যক্রম শুরু হলে রোগীদের আর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে না এতে বিশাল অংকের টাকা ব্যয়ের পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক হয়রানি থেকে রোগীরা রেহাই পাবেন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সফল লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয় বারডেম হাসপাতালে। কিন্তু লিভার প্রতিস্থাপনে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত দেশে মাত্র তিনটি লিভার প্রতিস্থাপনের কাজ হয়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত সরকারী ও বেসরকারীভাবে কোন স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার নেই। লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করতে বারডেম হাসপাতাল ও ল্যাবএইড হাসপাতালকে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের উপকরণ ধার করে ব্যবহার করতে হয়েছে। লিভার প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা। নির্ভয়ে লিভার দান ও প্রতিস্থাপনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে লিভার বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর খুব কম দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের কাজ হয়। একদিকে রয়েছে ডোনারের অভাব, অন্যদিকে দরকার বিশাল অংকের টাকা। এমন অবস্থায় আমাদের মতো গরিব দেশে সফল লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত গর্বিত। সবাইকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বিশেজ্ঞরা বলেন, লিভার দান করার ক্ষেত্রে ভয়ের কিছুই নেই। কাউকে দান করলেও ৬ সপ্তাহের মধ্যে লিভার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। দেশে স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন করা হলে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয় কয়েকগুণ কমে আসবে। এমন কথা জানিয়ে লিভার প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে প্রায় ১৮শ’ থেকে ২২শ’ গ্রাম লিভার থাকে। এর দু’ তৃতীয়াংশ অন্যত্র ব্যবহৃত হতে পারে। স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার গড়ে উঠলে এ ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে। এ কাজ সম্পন্ন করতে সিঙ্গাপুরে আড়াই কোটি টাকা এবং ভারতে লাগে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। নানা কারণে লিভার রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে হেপাটাইটিস ভাইরাস হচ্ছে লিভারের প্রধান শত্রু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বের প্রায় ২শ’ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত, যা মোট জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশ। প্রতিবছর হেপাটাইটিসজনিত রোগে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই জানে না তারা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত। এভাবে নিজের অজান্তেই আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আর শরীরে থাকা ভাইরাসটি যে কোন সময় সক্রিয় হয়ে আক্রান্তকারীকে মেরে ফেলতে পারে বা তাকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে ফেলতে পারে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ, তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী এ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত কম। এমনকি স্বাস্থ্যকৌশল প্রণয়নকারী দফতরগুলোও এ ব্যাপারে উদাসীন। লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের জন্য প্রধানত দায়ী হেপাটাইটিস। রোগটি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার সামর্থ্য রাখে। পাঁচ ধরনের ভাইরাস হেপাটাইটিস রোগটির জন্য দায়ী। এগুলোকে ইংরেজী এ, বি, সি, ডি এবং ই দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে, যৌনবাহিত হয়ে বা আক্রান্তের শরীরে কোন তরলের সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচটি ভাইরাসের মধ্যে ‘বি’ ভাইরাসটি সবচেয়ে সাধারণ। ভাইরাসটি আক্রান্ত মায়ের শরীর থেকে নবজাতক বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে বাহিত হতে পারে। এছাড়া দূষিত সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকগ্রহণকারীদের মাঝে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ‘ই’ ভাইরাসটি সাধারণত দূষিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। ডব্লিউএইচও’র মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হেপাটাইটিস ছড়িয়ে পড়ার জন্য ‘ই’ ভাইরাসটি প্রধানত দায়ী। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতেও এর সংক্রমণ ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। ‘এ’ ও ‘বি’ ভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যায়। এটি ‘ডি’র সংক্রমণেও ব্যবহার করা যায়, আর ‘ই’ ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি হলেও এখনও সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। ‘সি’ ভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন এখনও তৈরি করা যায়নি। লিভার বিশেষজ্ঞরা জানান, লিভার রোগের চিকিৎসা দেশে এখনও খুব সীমিত। সরকারীভাবে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে লিভার রোগীদের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। বেসরকারীভাবে বারডেম হাসপাতালে লিভার সার্জারি বিভাগ চালু আছে। ১৯৯৯ সালে বারডেমে এ বিভাগ চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এখানে লিভার সংশ্লিষ্ট পিত্তনালি সংযোজন, প্যানক্রিয়াস রিসেকশনসহ অন্যান্য অপারেশন করা হয়। বর্তমানে এখানে আটজনের শক্তিশালী একটি দল কাজ করছে। এছাড়া প্রাইভেটভাবে কিছু হাসপাতালে লিভারের চিকিৎসা হলেও তা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও অভাব রয়েছে। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় লিভারের কোন রোগ ধরা পড়লে তা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেকের জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে। কারও হেপাটাইসিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাস থাকলে এবং সময়মতো তা প্রতিরোধ না করলে ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস বা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এ ধরনের রোগীদের শেষ চিকিৎসাই হচ্ছে লিভার প্রতিস্থাপন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয়, এ্যান্ড স্টেজ লিভার ডিজিজ। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে অনেক আগে থেকেই লিভার প্রতিস্থাপন হচ্ছে। আমাদের দেশেও লিভার প্রতিস্থাপন সম্ভব। তবে লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এখনও যে বাধাগুলো আমাদের রয়েছে তার মধ্যে প্রথমত হচ্ছে যন্ত্রপাতি। এ জন্য যেসব যন্ত্রপাতি লাগে সেগুলোর দাম কোটি কোটি টাকা। বারডেমে যে দুটি লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তার জন্য সিএমএইচ, হার্ট ফাউন্ডেশন, গ্যাস্ট্রোলিভার, পপুলার হাসপাতাল থেকে যন্ত্রপাতি আনতে হয়েছে। এ ধরনের একটি জটিল অপারেশনের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবলও প্রয়োজন। সেটারও অভাব রয়েছে। এ ধরনের জটিল অপারেশনের জন্য ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। সার্জন, লিভার বিশেষজ্ঞ, হেপাটোলজিস্ট, এ্যানেসথেসিয়াসহ কমপক্ষে ১৬ জনের একটি টিমের প্রয়োজন হয়। এটি ব্যয়সাপেক্ষ চিকিৎসাও বটে। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, যাদের এ ধরনের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আছে তারা দেশের বিশেষজ্ঞদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। অথচ যন্ত্রপাতি পেলে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে দেশেই এ চিকিৎসা করা সম্ভব। বারডেম হাসপাতালে স্বয়ংসম্পূর্ণ লিভার প্রতিস্থাপন কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে যাতে কাউকে আর এ ধরনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে না ছুটতে হয়। সারাবিশ্বে লিভার গ্রহীতার মৃত্যুঝুঁকি ১০ শতাংশ হলেও লিভার দাতার কোন মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। সুস্থ লোকের দেহ থেকে লিভারের কিছু অংশ কেটে নিয়ে সংযোজন করা হয়। সাধারণত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যেই দাতার লিভার আবার আগের মতো হয়ে যায়। এ ছাড়া লিভার রোগীদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে ১৯৯৯ সালে লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে। লিভার রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। লিভার রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই।
×