ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দালাল চক্রের মাধ্যমে সাগর পথে ইউরোপ গেছে ৯৩ হাজার

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৭ অক্টোবর ২০১৭

দালাল চক্রের মাধ্যমে সাগর পথে ইউরোপ গেছে ৯৩ হাজার

ফিরোজ মান্না ॥ দালাল চক্রের মাধ্যমে সাগর পথে অবৈধভাবে বাংলাদেশের ৯৩ হাজারের বেশি লোক ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের তুলনায় এই তালিকা অনেক বড়। অবৈধদের ফেরত আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। অবৈধ অভিবাসী সমস্যা নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে তারা। ইইউয়ের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করা সংগঠন ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি (সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট) দিয়েই সাত হাজার ৮৯৯ জন বাংলাদেশী ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঠিক কত সংখ্যক বাংলাদেশী আছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এপ্রিলে ঢাকায় সফরকারী ইইউ প্রতিনিধি দল ইউরোপে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ বাংলাদেশী ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এই বছরের ছয় মাস ধরলে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধে দেশে আইন হয়েছে। একই সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। কিন্তু এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ কতটা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পুলিশের তথ্য আনুযায়ী, মানবপাচারের সাড়ে ৩ হাজার মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জনের যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছে। এটা কোন বড় ধরনের শাস্তির মধ্যে পড়েনি। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্ত অনেক সময় পুলিশ প্রতিবেদন সঠিকভাবে আসে না। সে ক্ষেত্রে আদালতের কিছুই করার থাকে না। ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন মনে রাখতে হবে মানবাধিকার রক্ষা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এখানে রাষ্ট্রকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে। মানবপাচারে দেশে-বিদেশে বড় বড় স্বার্থগোষ্ঠী অনেক ক্ষমতাধর। এদের টার্গেট করে মূল হোতাদের খুঁজে বের করা উচিত এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অতিরিক্ত টাকা খরচ করে কেউ গেলে সেই টাকা তুলতে গিয়ে কর্মীরা অনিয়মিত হয়ে যান। পাশাপাশি তিনি মানবপাচার রোধে স্বারষ্ট্র, পররাষ্ট্র, বিমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মানবপাচার রোধে আমাদের মূলত চারটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এগুলো হচ্ছেÑ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা আনয়ন, সচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা, মামলা হলে সেটার সঠিক আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের সমন্বয় সাধন। গত জুলাই মাসের শুরুতে অবৈধ পথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টায় তুরস্কে গিয়ে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশী আটকা পড়েছেন। ইউরোপের এই চিত্রের পাশাপাশি সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়া এবং সেখানকার গণকবরের কথা চিন্তা করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। মালয়েশিয়াও সম্প্রতি অবৈধ বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। অভিযানের প্রস্তুতি চলছে সৌদি আরবেও। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত আট বছরে চার লাখ বাংলাদেশী বৈধ কাগজপত্র না থাকায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ বছর মানবপাচার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। এই প্রতিবেদনে দেশগুলোকে তিনটি স্তর বা টায়ারে ভাগ করা হয়। গত পাঁচ বছর বাংলাদেশকে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে (টায়ার-টু)। এবার এক ধাপ নামিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্তরের ‘নজরদারিতে থাকা দেশের তালিকায় (টায়ার-টু ওয়াচ লিস্ট)’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে সৌদি আরব, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও হংকংসহ ৪৫টি দেশ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে তখন এই চিত্র উদ্বেগজনক।
×