ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ৭ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে

সাম্প্রতিককালে দেশ-বিদেশের সকল প্রকার সংবাদ মাধ্যমের খবরের শিরোনাম রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের টিভিতে খবরের পাশাপাশি ‘টক শো’ অনুষ্ঠানটি বিশেষ উপভোগ্য। যেসব ব্যক্তিত্ব সচরাচর জনসম্মুখে কালেভদ্রেও নিজেদের উপস্থাপন করার সুযোগ পাননি তাদের অনেকেই বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে জনগণের সামনে হাজির হন। সমস্যা সমাধানে যে যা পারেন বলে যাচ্ছেন। নিজেদের ‘পন্ডিত্য’ প্রকাশ করার এ যেন এক মহাসুযোগ। এ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চান না। ২১.৯.২০১৭ তারিখে কোন এক চ্যানেলে ‘টক শো’ নামক ‘শো’টি সকালে বসে দেখছিলাম। ভদ্রলোক বর্তমান সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করলেন। তিনি জানান, ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সাহেব নাকি মিয়ানমারকে বলেছিলেন ‘তোমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত নাও নইলে ওদের হাতে আমরা অস্ত্র তুলে দেব।’ ভদ্রলোক ‘টক’শোতে টক করতে গিয়ে বর্তমান সরকার প্রধানের দোষ খুঁজতে গিয়ে বলেন, জিয়াউর রহমান সাহেবের মতো নাকি ঐ রকম কথা বলতে হবে। ঐ ‘টক শো’ ওয়ালা ‘পন্ডিত’ বন্ধুটির উদ্দেশ্যে তখন বলতে ইচ্ছে করছিল-ভাই এই-২০১৭ সালে যদি জিয়াউর রহমান সাহেব বা বেগম খালেদা জিয়া সরকারপ্রধান থাকতেন তখন কী তারা বলতে পারতেন ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত নাও নইলে ওদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব।’ জিয়াউর রহমান সাহেব এমন কথা বলেছিলেন কিনা জানি না, তবে বলেও যদি থাকেন ঐ ‘টক শো’ ওয়ালা বন্ধুটির স্মরণে রাখা উচিত ছিল ১৯৭৮ আর ২০১৭ সাল এক নয়। তবে কাউকে খুশী করতে গিয়ে যদি তিনি এ তথ্য প্রকাশ করে থাকেন তাহলে অন্য কথা! মিয়ানমার বর্বর সেনাবাহিনীর অমানবিক কর্মকা-ে আগে থেকেই চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। এরই মধ্যে একদিনে আরও সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন বলে নানা তথ্য থেকে জানা যায়। পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে যে সমস্ত চিত্র দেখা যায় তাতে কোন মানুষেরই মন স্থির থাকতে পারে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যেভাবে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে বলে অনেক ধর্ষিতা নারী এর বর্ণনা দিয়েছেন তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। আর ক্যাম্পগুলোতে যেভাবে গাদাগাদি করে শরণার্থীরা অবস্থান করছে তাও অকল্পনীয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলির মুখে প্রাণ বাঁচাতে নিজেদের দেশ ত্যাগ করে আসতে তারা বাধ্য হয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত যেমন বাংলাদেশের রয়েছে তেমনি রয়েছে ভারত-চীনের সঙ্গেও। কিন্তু রোহিঙ্গারা সেদিকে যেতে পারেনিন। এই লাখ লাখ শরণার্থী যখন বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে শুধু প্রাণটি নিয়ে পালিয়ে আসছে তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি মাতৃস্নেহে সিক্ত হয়ে এগিয়ে না আসতেন তখন কি অবস্থা হতো, মানবতার কি ধরনের অবমাননা হতো তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। শুনেছি মিয়ানমারের মন্ত্রী-আমলা-সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিসহ সবাই নাকি মহামতী বুদ্ধের অনুসারী। তাদের কাছে যে কোন জীব হত্যা মহাপাপ। একটি পিপীলিকাও যদি তাদের পায়ের নিচে পড়ে তাহলেও নাকি তাদের প্রাণ কাঁদে। এটা তাদের ধর্মের অনুশাসন। যদি তাই হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কি জীব নয়? পিপীলিকার চেয়েও কী অধম। এ কোন ধর্ম? বৌদ্ধ ধর্মের কর্তাব্যক্তিগণ কী উনাদের সেনাবাহিনীর প্রধানসহ ধর্ষণকারীদের কর্ন কুহরে বুদ্ধের বাণী একটিবার পৌঁছে দেবেন! এদিকে বাংলাদেশ ষোলো কোটি মানুষের চাপে এমনিতেই জর্জরিত। এর ওপর প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গার চাপ কিভাবে সহ্য করবে সেটাই চিন্তার বিষয়। কিন্তু মানবিকতার চেয়ে তো বড় কিছু নেই। তাই নিজেদের জনগণের চাপের কথা চিন্তা করেও মানবিক কারণে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ক’দিন তা সম্ভব? মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা সেদেশে যত তাড়াতাড়ি ফিরে যায় ততই মঙ্গল। এ প্রসঙ্গে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্ব সম্প্রদায়ের বক্তব্যের কিছু কিছু শিরোনাম প্রণিধানযোগ্য। যেমনÑ রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রশংসা করে ইইউ পার্লামেন্টে প্রস্তাব। ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসায় কমনওয়েলথ’ ‘শেখ হাসিনা-ডোনাল্ড ট্রাম্প আলোচনায় রোহিঙ্গা, বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের’, ‘রোহিঙ্গাদের সহায়তার পৌনে ৩ কোটি ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্র’, ‘সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের জন্য দেড় কোটি ডলার সহায়তা দিল।’ এখন প্রশ্ন হলো এসব প্রশংসা আর আর্থিক সহায়তায়ই কী সমস্যার সমাধান মিলবে? ‘রোহিঙ্গা সমস্যায় আপনাদের সঙ্গে আছি, পাশে আছি’ এসব কী ইতিবাচক কিছু। এসব প্রশংসা করা, পাশে থাকা,’ ‘কোটি ডলার দেয়া’ এগুলো তো শুধুই কথার ফুলঝুড়ি। কেউ তো আসল সমাধানের কথা বলেননি। বাংলাদেশে আসা নয় কোটি (প্রায়) রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে কবে, কিভাবে পাঠানো হবে সেকথা তো কেউ জোর দিয়ে বলেননি। শুধু ‘প্রশংসা’ আর ‘পাশে থাকা’ কি কাজের কাজ হবে। যারা এসব কথা বলেন তাদের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে বলছি এসব নির্যাতিত দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের আপনাদের দেশসহ পৃথিবীর সব দেশে আশ্রয় দিন। আমরাও প্রাণ খুলে আপনাদের প্রশংসা করব। তবে সব কথার শেষ কথা হলো আমরা আপনাদের প্রদত্ত সাহায্য (রোহিঙ্গাদের জন্য), প্রশংসা, পাশে থাকার আশ্বাস সব কিছুই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করব কিন্তু এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান এর জন্য রোহিঙ্গাদের স্বসম্মানে তাদের ফেলে আসা বসতভিটায় ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন। এবং তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্য বলেনÑ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান বন্ধ করুন। এ আহ্বানের পর কিন্তু সেনা অভিযান বন্ধ করা হয়নি। এমনটি যেন না হয়। যেমনটি বলেছেন আমাদের সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাÑ‘মিয়ানমারকে স্পষ্ট জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে।’ মোট কথা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতেই হবে। নইলে এ অঞ্চলে অশান্তির অবসান হবে না। তবে সুচির ‘যাচাই-বাছাই’ প্রকল্পটি সুষ্ঠু সমাধানের ইঙ্গিত বহন করে না। এক দূরভিসন্ধিরই ইঙ্গিত মাত্র। নতুন পুরানে মিলে প্রায় সাড়ে নয় লাখ রোহিঙ্গার ‘যাচাই বাছাই’ তো বিশ্ব মিডিয়াতেই রয়েছে। ‘আন্তর্জাতিক নজরদারি নিয়ে ভীত নয় সরকার’ সুচির এ বক্তব্য ‘যাচাই বাছাইকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তবে দেশের রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি তোলার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিা রোহিঙ্গাদের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়েছেন। এবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে সবাইকে বলতে হবেÑসুচি সরকারকে অতিদ্রুত তার দেশে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গের শিরোনাম : ‘রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশের সতর্কতা, চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি’। (জনকণ্ঠ ১৭.৯.২০১৭) খবরে বলা হয়Ñ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থে শরণার্থী শিবির ব্যতীত রোহিঙ্গাদের বসবাস পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে খবর এসেছে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে কয়েকজনকে ধরে শিবিরে পাঠানো হয়েছে। এমনি অবস্থায় পুলিশের সতর্কতাকে কারও পক্ষে অমূলক ভাবা সমীচীন নয়। এর প্রভাব যে আরও গভীরে ২২.৯.২০১৭ তারিখের দৈনিক জনকণ্ঠের শিরোনাম-‘আইএসআইর নীলনক্সায় রোহিঙ্গা ইস্যু তৈরি, ষড়যন্ত্রের অংশ, পাকি ব্রিগেডিয়ার আশফাকের লন্ডন কানেকশন খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা‘ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। খবরে আরও বলা হয় ‘পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা নীলনক্সা অনুযায়ী মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুটি তৈরি করেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে যোগাযোগ করছে তারা। বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকারকে পরিবর্তন করতে চায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তবে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে যে, আইএসআইএর টার্গেট কিন্তু শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তাদের টার্গেট মুক্তিযুদ্ধস্নাত বাংলাদেশ। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান কিন্তু গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। এটা, কিসের আলামত? এ প্রশ্নের উত্তর দেশের সর্ব মহলকেই খুঁজতে হবে। কারণ দেশটা সকলের। ২০.৯.২০১৭ তারিখের দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার একটি শিরোনামÑ‘রোহিঙ্গাদের পাশে অমর্ত্য সেনও। অমর্ত্য সেন কিন্তু শান্তিতে নোবেল পাননি। পেয়েছেন অর্থনীতিতে। মুহাম্মদ ইউনূসকে লিখা এক চিঠিতে অমর্ত্য সেন বলেছেন, তিনি সাধারণত যৌথ বিবৃতিতে তার নাম যোগ করেন না। কিন্তু বার্মায় রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা এত অসহনীয় এবং নজিরবিহীন বর্বরোচিত যে, আমি চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছি। এখন প্রশ্ন হলো শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি যেন কেমন মনে হয়। সু চি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের সরকারপ্রধান। তারই দেশের রাখাইন-এ তিনি শান্তির এ কোন ললিত বাণী শোনাচ্ছেন। একজন নারী হয়ে ধর্ষিতা নারীদের খবর কী তিনি রাখেন? ওরা রোহিঙ্গা না বাঙালী সেটা তো বড় কথা নয়। বড় কথা হলো ওরা নারী। তারই জাতের মানুষ। নারী। শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন কিসিঞ্জার সাহেবও। একাত্তরে যুদ্ধরত বাঙালীর বাংলাদেশে কোন শান্তির বাণী শুনিয়েছিলেন তিনি। সারা বিশ্ববাসীই তা জানেন। অবস্থাদৃষ্টে আজ মনে হয় শান্তিতেই যেন যত সব অশান্তি। কিসিঞ্জার সাহেব কি আজ রোহিঙ্গাদের শান্তির জন্য একটি কথাও বলেছেন? আর আমাদের গর্ব ড. ইউনূস। শুনেছি আমেরিকার ক্লিনটন পরিবার বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক। সেই সধুর সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি কী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন? রোহিঙ্গাদের শান্তির জন্য বিশ্ব ঘুরে জনমত সৃষ্টি করছেন? তিনিও শান্তির, সু চিও শান্তির দূত। দু’জনের মিলিত প্রচেষ্টায় মিয়ানমারে অশান্তির অবসান হোক এমন প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা
×