ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠাগার থেকে ঘরে ঘরে বই পড়ার আন্দোলন

সোহাগের আলোর ভুবন

প্রকাশিত: ০৩:১৫, ৭ অক্টোবর ২০১৭

সোহাগের আলোর ভুবন

‘এসো পড়ি-দেশ গড়ি’ এই স্লোগান সামনে রেখে ১৯৯৭ সালের পহেলা জানুয়ারি মাত্র ১৮টি বই নিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে যে পাঠশালার সূচনা হয়েছিল-দীর্ঘ ২০ বছরে বেড়েছে তার পরিধি। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার নামের এ জ্ঞানভান্ডারে চার হাজারের বেশি বই এখন। অজানা তথ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইতিহাস, ঐতিহ্য সবকিছুর খোঁজ মেলে এখন এ পাঠাগারে। নানা কারণে কাক্সিক্ষত পাঠক বাড়ছে না। তবে বসে নেই এর উদ্যোক্তা। সোহাগ আলী নামের এই উদ্যোক্তা এখন মানুষকে বইমুখী করতে হাতে নিয়েছেন নানান কর্মসূচী। এতে সাড়াও মিলছে। পাঠাগারের পাশাপাশি এখন পাঠকের বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। না, কোন টাকার বিনিময়ে নয়, সম্পূর্ণ ফ্রি বই এখন পাঠক ইচ্ছা করলেই ঘরে বসে পাচ্ছেন। ‘পলান সরকার বই পড়া আন্দোলন’ নামের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি। এ ছাড়াও ফ্রি পত্রিকা পাঠকদের জন্য নিজস্ব উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় গড়ে তুলেছেন পত্রিকা কর্ণার। সেখানেও ফ্রি পত্রিকা পড়তে পারেন মানুষ। তরুণ এ উদ্যোক্তা সোহাগ আলী নগরীর তেরখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা। স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে আলোকচিত্রীর পাশাপাশি মানুষকে বইমুখী করার প্রয়াস চালাচ্ছেন তিনি। সোহাগ আলী জানান, বই মানুষকে আলোকিত করে। বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। এ চিন্তাভাবনা থেকে প্রথমে কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার স্থাপন করেন নিজ বাড়ির একটি কক্ষে। এখন তিনি ‘পলান সরকার বই পড়া আন্দোলনে’ যুক্ত হয়ে বই বিলাচ্ছেন পাঠকদের ঘরে ঘরে। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজেও চলছে তার এ কার্যক্রম। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী একজনকে সপ্তাহে তিনটি করে বইয়ের যোগান দেয়া হয়। সাতদিন পর সে বই ফেরত দিয়ে নতুন বই নেন পাঠক। ছোট একটি মোবাইল মেসেজ করেই পাঠক হাতে পাচ্ছেন চাহিদা অনুযায়ী বই। এ প্রক্রিয়ায় এখন তার পাঠকের সংখ্যা তিন শ’ হয়েছে গত ৬ মাসেই। তিনি জানান, নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় মানুষ এখন লাইব্রেরিমুখী হচ্ছেন না। অনেকের বই পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সময়ের সঙ্গে মেলাতে না পেরে পাঠাগারে আসতে পারছেন না। এ কারণে পাঠকের হাতেই বই পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এসব পাঠকের মধ্যে কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী ও শিশু কিশোররা রয়েছেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তাদের উপযোগী বই দেয়া হয়। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন মনীষীর জীবনী, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, সাধারণ জ্ঞান ও পাঠ্যবই। সোহাগ আলী জানান, ২০১৫ সালের শুরুতে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি করেছিলেন তিনি। ভ্যানগাড়িতে করে শহরের মোড়ে মোড়ে বই পৌঁছানোর ইচ্ছে ছিল তার। কিছুদিন এ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালান তিনি। তবে অর্থনৈতিক দৈন্যর মুখে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। পরে পলান সরকার বইপড়া আন্দোলন শুরু করেন তিনি। এ অন্দোলনের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে রাজশাহী নগরী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা পবার হড়গ্রাম ইউনিয়নে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সোহাগ আলী জানান, ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হলেও পাঠাগার তৈরির অদম্য ইচ্ছা থেকে পিছুটান ছিল না, এখনও নেই, সমান উদ্যোগ আছে তার। নিজের বলতে তেমন কিছু নেই। নিজের ইচ্ছা ও আগ্রহের কাছে হার মানেননি সোহাগ। প্রায় ২০ বছর ধরে অল্প অল্প করে সেই পাঠাগারে বই কিনে এখন পরিণত হয়েছে সমৃদ্ধ তথ্য ভা-ারে। কেউ আগ্রহী হয়ে কিছু কিছু বই উপহার দিয়েছেন। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন দুটি জাতীয় ও ৩টি আঞ্চলিক পত্রিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে পাঠ্য তালিকায়। এ ছাড়াও দেশী ও বিদেশী ৫টি মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকা রাখা হয়েছে পাঠাগারটিতে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার নামের এ জ্ঞান ভা-ারের পাশাপাশি পাঠকরা এখন ঘরে বসে জ্ঞান আহরণ করে নিজেকে যোগ্য করে তুলছেন। যার পেছনের নায়ক সোহাগ আলী। জ্ঞান বিতরনের সদা প্রচেষ্ট যুবক সোহাগ আলী জানান, বই পাড়া আন্দোলন ও পাঠাগারের কারণে ওই এলাকার সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। মানুষ ভাল-মন্দ বুঝতে শিখেছে। চেতনাগত দিক থেকেও মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছে। সোহাগ জানান, প্রতিদিন সকালে পাঠকের মোবাইল/ ফেসবুকের মেসেজপ্রাপ্তির পর বই পৌঁছে দেয়া হয়। আর বিকেলে পাঠাগারেই বই দেয়া হয়। আবার ফেরতও নেয়া হয়। পাশাপাশি পাঠাগারও চালু রাখা হয়। এ পাঠাগারে বাংলাদেশের ৫ জন বিখ্যাত ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়েছে ৫টি গ্যালারি। এগুলো হলো কবি রবীন্দ্র গ্যালারি, নজরুল গ্যালারি, বেগম রোকেয়া গ্যালারি, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঈীর গ্যালারি, লালন শাহ গ্যালারি ও মুহাম্মদ ইজহারুল হক গ্যালারি। এসব গ্যালারিতে রয়েছে শিশু-কিশোর ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য আলোকচিত্র। দুর্লভ আলেকচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে ফিরে দেখা ১৯৭১ গ্যালারি। এখানে রয়েছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৩ মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চের গণহত্যা, পাকিস্তানীদের হত্যাও নির্যাতনের চিত্র, মুক্তিযুদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ ও বিজয় উল্লাসসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ছবি। এ ছাড়া পাঠাগার সংলগ্ন দরিদ্র অসহায় ছিন্নমূল পিছিয়ে পড়া শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি সেখানে প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে প্রতিদিন সকালে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলে। এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজশাহী কাইছার মেমোরিয়াল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাসিক ৫০০টাকা অনুদান দিয়ে থাকেন। সেই ক্ষুদ্র আয়ে চলে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারে সাধারণ পাঠকদের জন্য রয়েছে কম্পিউটার কর্নার। এ কর্নারে একজন পাঠক বিনামূল্যে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন। বিভিন্ন জাতের দেশীয় ফল ও ক্যাকটাসের গাছসহ কৃষি বিষয়ক বই এবং পত্রিকাও রয়েছে এখানে। পাঠাগারে ছোট একটি র‌্যাকে শুরু হয়েছে মিনি সংগ্রহশালার কার্যক্রম। মুদ্রা, দেশ-বিদেশের ডাকটিকেট, গ্রামবাংলার এতিহ্যবাহী জিনিসপত্র, কাসা-পিতল, ক্যামেরাসহ বেশকিছু পুরনো বিষয় স্থান পেয়েছে এ মিনি সংগ্রহশালায়। নানা কার্যক্রমও পরিচালিত হয় এ পাঠাগারে। কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগারের উদ্যোগে প্রতিবছর দু’বার স্কুল/কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বইপড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশে রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পাঠাগারের উদ্যেক্তা সোহাগ আলী জানান, কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার সাহিত্য চর্চাও নতুন লেখক সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠাগার কার্যালয়ে নবীন-প্রবীণ লেখকদের নিয়ে সাহিত্যআড্ডা ‘আমরা করব জয়’ অনুষ্ঠিত হয়। পাঠাগার থেকে সাহিত্য কাগজ অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও পাঠাগার থেকে প্রকাশিত হয়েছে কিশোর সংবাদ, তমাল, অনুভবসহ আরও কয়েকটি প্রকাশনা। ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর দেশ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, সংগঠক, শিল্পীকে গুণীজন সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করে থাকে। পাঠকসেবার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কিশোর পাঠাগার বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচীর পালন করে থাকে। প্রতিবছর অসহায় শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাধ্যমতো শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে আসছে। ২০০১ সাল থেকে বৃক্ষরোপণ, তামাক বিরোধী কর্মসূচী পালন করে আসছেন তিনি। গত বছর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০ হাজার গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। সোহাগ জানান, আগামী ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের বইমুখী করার লক্ষ্যে ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলভিত্তিক বইপড়া প্রতিযোগিতা শুরুর উদ্যোগ নিয়েছেন। সোহাগ আলী জানান, বতমানে পাঠাগার ও বিভিন্ন কর্মসূচী চালাতে অর্থনেতিকভাবে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। শুধু আর্থিক সংকটের কারণে এসব কার্যক্রম পরিচালনা অনেকটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে
×