ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বই ॥ প্রযুক্তির দর্শন

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৬ অক্টোবর ২০১৭

বই ॥ প্রযুক্তির দর্শন

জ্ঞানের ইতিহাসের মতোই প্রযুক্তির ইতিহাস প্রাচীন। হোমো সেপিয়েন্স যেমন প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে তেমনি প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে সাইবর্গ। প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। বলা চলে প্রযুক্তি মানব সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ধু সভ্যতা, রোমান সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগে শিল্প সভ্যতা এবং শিল্প উত্তর সভ্যতা সবই প্রযুক্তি নির্ভর। প্রযুক্তির উন্নয়নের ওপর সভ্যতার গতি-প্রকৃতি ও বিকাশনির্ভর করে। মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণে প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া মানুষ এক মুহূর্ত কল্পনা করতে পারে না। বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, তথ্যবিজ্ঞান ও আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম সবই প্রযুক্তি নির্ভর। খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টির নিশ্চয়তা, জন্মশাসন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, আবহাওয়ার ওপর প্রভাব কোথায় নেই প্রযুক্তির ব্যবহার? জলে, স্থলে, আকাশে সবস্থানেই প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ আধিপত্য করছে। জেনেটিক প্রকৌশলবিদরা মানব জিনের পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নততর মানব সম্প্রদায় আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। এ প্রক্রিয়া সফল হলে মানুষ সম্পর্কে আমাদের ধারণার পরিবর্তন হবে। মানব সৃষ্টি সম্পর্কে আকাশী মতবাদের আর কোন কার্যকারিতা থাকবে না। জেনেটিক প্রকৌশলের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে মানুষ বহু রোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। এন্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী ওষুধ আমাদের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। উন্নত বীজ উৎপাদনের সাহায্যে অধিক ফলনশীল ফসল উৎপাদন, খরা ও বন্যা সহনীয় ধান উৎপাদনের সাহায্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিজ্ঞান প্রকৃতিকে জানতে চায়। কিন্তু প্রযুক্তি কেবল জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক বস্তুর পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। প্রযুক্তিকে ফলিত বিজ্ঞান বলা হয়। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহারিক উদ্দেশ্য পূরণের নিমিত্তে প্রযুক্তি কাজ করে। যেমন, নিউটনের গতি সম্পর্কিত তৃতীয় সূত্রকে কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন যানবাহন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ নতুন নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। অনেকে বলেন বর্তমান সভ্যতা হলো প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতা। অর্থাৎ প্রযুক্তির সভ্যতা। প্রযুক্তি এই গ্রহে বসবাসকারী মানুষে মানুষে দূরত্ব কমিয়েছে। প্রযুক্তি বিশ্বায়ন সম্ভব করেছে। বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বর্তমানে অন্তর্জালের আওয়াভুক্ত। এই অন্তর্জাল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে কাছাকাছি আনতে সক্ষম হয়েছে। ই-মেইল, ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব। আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলের খবর আমাদের দেশে পৌঁছতে এখন সময় লাগে না। এটাও সত্য যে প্রতিবেশীর খবরের চেয়ে দ্রুত আমরা দূর দূরান্তের খবর পাই। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা নির্মূলে প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। চাঁদে মানুষের অবতরণ, মঙ্গলে অভিযান, বিকল্প পৃথিবীর সন্ধান ইত্যাদি প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণকর দিক বলে শেষ করা সম্ভব নয়। মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ব্যবহার প্রাচীন হলেও প্রযুক্তির দর্শন শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান দার্শনিক আর্নস্ট ক্যাপ (১৮০৮-১৮৯৬)। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। প-িতদের এই ভাবনার মধ্য দিয়ে প্রযুক্তির দর্শন জ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমকালীন যুগে ফ্রেডরিক ডেসেয়ার, কার্ল জেসপার্স এবং ইউজেন ডিজেল প্রযুক্তির দার্শনিক দিকটি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। এ পর্যন্ত প্রযুক্তির দর্শন জার্মানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জ্যাক এলু, আলবার্ট বর্গম্যান, ডন ইডে, রোজার ফেলোস, এন্ড্র ফিনবার্গ, ডেভিড এম. কাপলান, সার্জিও সিসমন্ডো, কান্তিকা ওয়েলবার্স প্রমুখ প্রযুক্তির দর্শন বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশেও প্রযুক্তির দার্শনিক দিকটি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোঃ নূরুজ্জামান প্রযুক্তির দর্শন নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। অধ্যাপক নূরুজ্জামানের প্রযুক্তির দর্শন সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রযুক্তির দর্শনের প্রকৃতি ও পরিধি সম্পর্কে আলোচনায় প্রযুক্তি কী, প্রযুক্তির দর্শন কী, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ও অধিবিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যার বিভিন্ন শাখা প্রশাখার সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রযুক্তির সঙ্গে নীতিবিদ্যা, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়েও গ্রন্থটিতে আলোচনা রয়েছে। প্রযুক্তির দর্শনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : টেকনোসায়েন্স। মানুষ কখন কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে ইত্যাদি নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে প্রযুক্তির দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। অধ্যাপক নূরুজ্জামান দেখিয়েছেন, প্রাচীন গ্রিক দর্শনের মধ্যেই প্রযুক্তির দর্শন রয়েছে। প্লেটোকে তিনি প্রথম প্রযুক্তির দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরিস্টলের প্রাকৃতিক বস্তু ও মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট বস্তুর স্বরূপের আলোচনা এবং তার কার্যকারণ তত্ত্বের ব্যাখ্যার মধ্যে প্রযুক্তির দর্শনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মার্টেন ফ্রানসেস, গার্ট-জ্যা লকহরস্ট, ইবো ভান দ্য পোয়েল, এরিস্টটলকে একজন প্রযুক্তির দার্শনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে ফ্রান্সিস বেকনের পদ্ধতিতত্ত্বের আলোচনার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের দর্শনের শুরু হয়। বেকনের জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার মধ্যে প্রযুক্তির দর্শনের উপদান রয়েছে। বেকন বলেছেন, জ্ঞানই শক্তি। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে প্রযুক্তি ও অধিবিদ্যা, পঞ্চম অধ্যায়ে প্রাযুক্তিক নিয়ন্ত্রণবাদ, ষষ্ঠ অধ্যায়ে প্রযুক্তির জ্ঞানতত্ত্ব এবং সপ্তম অধ্যায়ে প্রযুক্তি ও নীতিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রযুক্তির দর্শন নিয়ে যারা অধিকতর অধ্যয়ন করতে চান তাদের জন্য প্রযুক্তির দর্শনের শেষে একটি গ্রন্থপঞ্জি রয়েছে। বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রযুুক্তির দর্শন গ্রন্থটি একটি অনন্য সংযোজন। আমাদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের দর্শনের সঙ্গে প্রযুক্তির দর্শন পঠিত হলে জ্ঞানের এই শাখাটি সম্পর্কে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক সবারই আগ্রহ কিছুটা বাড়বে। কখনও কখনও প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে অধিকতর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ও আনন্দ দেয়ার বিপরীতে প্রযুক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রযুক্তির লাগামহীন ব্যবহারের ফলে এই গ্রহটি মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং পৃথিবীর আয়ু কমে আসছে। পরমানুকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবন যেমন সহজ ও আরামদায়ক হয়েছে তেমনি পারমাণবিক বোমাও তৈরি হয়েছে। পরিসংখ্যান মতে এ পর্যন্ত মজুদ সমরাস্ত্র দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। প্রযুক্তি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের জীবনই শুধু ধ্বংস করেনি পৃথিবীকেও বিষাক্ত করেছে। যে প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে সেই প্রযুক্তিই মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, পারমাণবিক বিকিরণ এবং শিল্প বর্জ্যের ফলে পরিবেশের ক্ষতিসাধন ও গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি প্রযুক্তির অধিক ব্যবহারের ফলেই সম্ভব হয়েছে। প্রযুক্তিবিদরা নতুন নতুন প্রযুক্তির সৃষ্টি করছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবন যেমন সহজ হচ্ছে তেমনি কন্টকময়ও হচ্ছে। মানুষের ওপর প্রযুক্তির আধিপত্য নিয়ে দার্শনিকরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। দার্শনিকদের এসব কর্মকা- নিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে যে নতুন শাখার সৃষ্টি হয়েছে তাই প্রযুক্তির দর্শন। অধ্যাপক নূরুজ্জামান প্রযুক্তির দর্শন গ্রন্থটিতে প্রযুক্তির দার্শনিক দিক নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। প্রযুক্তির দর্শন গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় প্রযুক্তির দার্শনিক দিক সম্পর্কে জ্ঞান বিকাশে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। লেখক মাঝে মধ্যে কোটেশন ব্যবহার করে লেখার স্বাভাবিক গতি কিছুটা দুর্বল করেছেন। তারপরও বাংলা ভাষায় এটি একটি মৌলিক গ্রন্থ।
×