ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লোয়াভাই

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৬ অক্টোবর ২০১৭

লোয়াভাই

নিতান্তই কচি খুকি, হাত-পা নেড়ে, আধো-বুলিতে রবীন্দ্রনাথকে কী বলেছিল, বলতে চেয়েছিল, বোঝেননি। লেখেন, ‘তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।’ চ-ীদাসের ‘খুড়োর যখন অল্প বয়স বছরখানেক হবে/উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষণ অট্টরবে।/আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে।/খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চমকে গেল লোকে।’ (সুকুমার রায়)। একজনকে জানি, বয়স ৪০ পেরিয়েছে, দুই কন্যার জননী। তার ছোট কন্যা বড়কে ‘আপা’ নয়, ‘পা’ সম্বোধন করেন। শিশু, আধোবুলির বয়সে হয়ত ‘আ’ উচ্চারণে জড়তা ছিল, জড়তা কাটিয়ে, বড় হয়েও ছোটবেলার ভালবাসার, আদুরে ডাকই প্রিয় রশীদ হায়দারের প্রথম কন্যা হেমা, হায়দার বংশে পয়লা, তার সেজ চাচাকে ‘খোকন ছেলে’ বলে ডাকেন। হেমা যখন আধো বুলির, ওরই মামা, একমাত্র মামা, বলেছিলেন ওঁকে, ‘এই খোকন কী তোমার ছেলে? তোমার খোকন ছেলের কাঁধে পিঠে চড়ে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াও।’ হেমার কানে ‘খোকন ছেলে’ সেঁধে যায়। ওই যে সাঁধল, ৬৭ বছরের বুড়োকে ‘খোকন ছেলে’ বলেন। হেমার ছোট জ্ঞাতিগুষ্টির সম্বোধন ‘খোকন ছেলে।’ হোক তা চাচাত, ফুপাত ভাইবোন। বাংলার পারিবারিক নাম ও সম্বোধন, আদর, ভালবাসা, প্রিয়তায় যে সাংস্কৃতিক ঘরানা, মূলে সামাজিকতাও। এই সমাজের আদল ঘরোয়া, পারস্পরিক স্নেহবন্ধনে আপন। এখানে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্ন নেই। বঙ্কিম হয়ে যায় ‘বঙ্গ’। নজরুল ‘নজ্যে।’ রহিমা খাতুন মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীন শেখের প্রথম ছেলে জিয়া হায়দার, ডাকনাম রোউফ। দ্বিতীয় ছেলে রশীদ হায়দার, ডাকনাম দুলাল। তৃতীয় ছেলে মাকিদ হায়দার, ডাকনাম রোকন। ‘বড়ভাই’, ‘রোউফভাই,’ ‘মেজভাই’ ‘দুলালভাই’, ‘সেজভাই’, ‘রোকনভাই’ না বলে কেন ‘সোনাভাই’ (জিয়া হায়দার), ‘দাদুভাই’ (রশীদ হায়দার), ‘লোয়াভাই’ (মাকিদ হায়দার) বলি ছোটরা, কেন? ব্যাখ্যা আছে। কথিত, বালকবেলায় জমিদারপুত্র রোউফের (জিয়া হায়দার) গলায় সোনার মালা (চেন) থাকত। সোনারমালা দেখে রোউফের অনুজা ঝরনা নাকি ‘সোনাভাই’ বলতেন। সেই থেকে অনুজ অনুজার সম্বোধন সোনাভাই। দুলাল (রশীদ হায়দার) কেন ‘দাদুভাই?’ ঝরনা আপার কথা : ‘দুলালের স্বভাবগাম্ভীর্যে ‘দাদু-দাদু’ ভাব ছিল।’ হয়ে গেলেন ‘দাদুভাই।’ রোকনের (মাকিদ হায়দার) বেলায় কী? আবার ঝরনা আপার কথা, ‘দাঁত গজানো পরেই, লোহা পেলে, তা পেরেক হোক, চাকু হোক, হাতুড়ি হোক, কামড়াত।’ লোহার কেচ্ছা থেকে ‘লোয়াভাই’, ছোটদের কাছে। মাকিদ ওরফে রোকন তথা লোয়াভাইয়ের আজ ৭০তম জন্মদিন, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ভূমিষ্ঠ, পাবনার দোহারপাড়ায়, রহিমা খাতুনÑ মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীন শেখের ৬ নম্বর সন্তান। চেহারাসুরতে মন্দ নন মাকিদ, বাংলাদেশের সিনেমায় নাচনকুদন করতে পারতেন, একজন পরিচালক অফারও করেছিলেন, ‘ঢালিউডের চৌহদ্দিতে যাননি। ইচ্ছে ছিল পেলে বা ম্যারাডোনা হওয়ার, বরাতে জোর ছিল না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা শহরে রেশনের দোকান দিয়েছিলেন, রেশনের চাল-চিনি-তেল মুক্তিযোদ্ধাদের সাপ্লাই দিতেন গোপনে, যুদ্ধশেষে, স্বাধীনতার পরে ব্যবসায়ী হতে পারতেন, সব ছেড়েছুড়ে কবিতাই আরাধ্য। গল্পও লিখেছেন, বইও আছে, পাঠকপ্রিয়, কিন্তু, ‘কবি’ উপাধিই পছন্দ। মাকিদ হায়দার কেন নিজের কিস্্সা তথা আত্মজীবনী লেখেন না, অজানা। অসাধারণ তাঁর অতীতকথা। কৈশোরে, গোঁফ গজানোর আগে ভয়ানক একরোখা, দুষ্টকুলের শিরোমণি, মারপিটে মস্তান, রাতবিরেতে পাড়া টে টে, ৪০ হাত সুপারি গাছ থেকে পড়ে হাড্ডিগুড্ডি ভাঙে না, অজ্ঞানও নয়, দিব্যি সুস্থ, খোকনকে, এক থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘গা একটু ব্যথা করতেছে, যা ডাব পাড়ে (পেড়ে) লিয়ে আয়।’ বাপ তাকে তেজ্যপুত্র করার হুমকি দেন, আদালতেও যান, বাপকে বলেন, ‘করে দেখুক, ঠ্যালা বুঝাবিনি। বাড়ি পোড়ায়ে দেব।’ বাপের বোধহয় তেজ্যপুত্র করার শখ মিটে যায়। মাকিদ ওঁর আত্মজীবনী লিখবেন। অনুজ লিখতে পারে না। মাকিদ বড় চাকরি করেছেন, আমলা-টামলা গোছের কাছে, সরকারী চাকরি, অথচ মেজাজ কবির। কাব্যমনই তাঁর জীবনচরিত। মাকিদের কবিতা নিয়ে সমালোচক দল বেশি কথা কন না। মাকিদ অবশ্য ধারও ধারেন না। লেখেন ফ্রি ভার্স। ফ্রি ভার্স বলতে সঠিক যা বোঝায়, তাও নয়। বিদেশী ফ্রি ভার্স লেখক, বাংলার সমর সেন বা অরুণ মিত্রেরও অনুসারী নন, একবারেই নিজস্বতা, শব্দ-ছন্দের কারিকুরি, মারপ্যাঁচ নিয়েও মাথা খামচান না, ওঁর লেখা স্বতঃস্ফূর্ত, বিপত্তি অনেকের। কিন্তু মানতেই হবে, আর পাঁচজন ভিন্ন, আলাদা। এখানেই তিনি একক। দেশ-সমাজ-পারিপার্শ্বিক মাকিদের কবিতায়, গদ্যের আদলে, গল্পের কথকতায় যে বয়ান, সখন রাজনীতিমাখা। নিজের ডাকনাম রোকনকে ‘রোকনালি’ চিহ্নিত করে কখনও ব্যঙ্গ, কখনও তীব্র শ্লেষে দেশের চলমান পরিস্থিতি, মলিনতার চিত্র ‘আঁকেন, সময়কালকে প্রকাশ, বিস্তার করেন। এই প্রকাশ, বিস্তারে দেশমাটির জলহাওয়া সংলগ্ন। ভয়ঙ্কর উত্তেজনা নেই কবিতায়, অথচ বোধের গভীর, বলা ভাল, চিত্তবিক্ষোভের উৎক্ষেপণ। কিছু কবিতায় অভিজ্ঞতার টানাপোড়েনেরও রোমাঞ্চর লক্ষণও নানা বিন্যাসে রেখাঙ্কিত। চিত্ররেখা, বিচিত্রতর বৃত্তান্তের সম্মিলনই তার কবিতা। কবিকে ৭০ জন্মদিনে শুভেচ্ছা বিনতি। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ বার্লিন, জার্মানি
×