ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাবলো নেরুদা ॥ সাম্যবাদী এক কবি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৬ অক্টোবর ২০১৭

পাবলো নেরুদা ॥ সাম্যবাদী এক কবি

‘আমি কোন বই পড়ে কবিতা লিখতে শিখিনি। কাউকে শেখাতেও পারব না। কেবল আমার নিজ পথ চলার কাহিনী নিয়ে আমি কবিতা লিখি। তাতে আমি মাটির গন্ধ পাই, আত্মার উৎসারণ অনুভব করি। আমি বিশ^াস করি, মানুষ তার ছায়ার সঙ্গে, আচরণের সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে আটকে আছে। মানুষের যে সমাজবদ্ধতার চেতনা, তা সম্ভব হয়েছে স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একসঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টায়। কবিকে সবার দিকে হাত বাড়াতে হলে সবার সঙ্গে মিশতে হবে, ঘাম ঝরাতে হবে, রুটি বানানোর প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়তে হবে। ভাল কবিতা লিখতে হলে অবশ্যই অসাধারণ মানুষ হতে হবে, যা এতদিন আমরা হইনি, নিজেদের ইশ^র ভেবে এসেছি।’ নোবেল পুরস্কার ভাষণে কবিতার দায়বদ্ধতা সম্পর্কে এ কথাগুলো বলেছিলেন নেফাতালি রিকোর্ডো রিয়েস বাসোয়ালতো বা পাবলো নেরুদা। লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির পাররাল শহরে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। মাস ছিল জুলাই আর তারিখ ছিল ১২। বাবা ছিলেন একজন রেলশ্রমিক। মা ছিলেন শিক্ষয়িত্রী। জন্মের দু’মাসের মধ্যে মা মারা যান। বাবাও বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। পাবলো নেরুদা তার ছদ্ম নাম। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যখন তার বয়স ১৩ বছর তখন থেকে তিনি এ ছদ্ম নামেই লিখতে শুরু করেন। নেরুদা লাতিন কবিতা ও সাহিত্যকে বিশ^বাসীর কাছে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। স্যুররিয়ালিজস্ট থেকে কমিউনিস্ট কবির নোবেল জয়, এ যেন এক অবিস্মরণীয় অর্জন। এ নিয়ে কুৎসিও মালাপার্তি বলেছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই কিন্তু আমি যদি চিলির কবি হতাম তাহলে পাবলো নেরুদার মতো একজন কবি হতাম।’ এ উক্তি থেকেই বোঝা যায় নেরুদার রাজনৈতিক আদর্শ তার কবিতার আত্মার কোন ঘাটতি ঘটায়নি। তিনি একাধারে মহান কবি এবং নিপীড়িত মানুষের একজন ভাল বন্ধু ছিলেন। যা পৃথিবীতে অনেকটা অপ্রতুল। মুক্তি সংগ্রামের একজন শৈল্পিক রূপকার এবং স্প্যানিশ কাব্যে এক নতুন সৌন্দর্য সচকিত বাঁকের উন্মেষ ঘটান। যে সময়ে নেরুদার কাব্যচর্চার হাতেখড়ি সেই সময়ে লাতিন আমেরিকা মহাদেশ উত্তাল ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে টালমাটাল। স্যুররিয়ালিজম, দাদাবাদ ও কিউবিজমের উত্তেজনায় অস্থির। পরবর্তী সময়ে যখন লাতিন আমেরিকা মহাদেশ ধীরে ধীরে আটকে পড়ছিল আমেরিকান পুঁজিতে, ঠিক তখনই বোদলেয়ার, র্যাঁবো, ভেলেনের ভক্ত নবীন স্যুররিয়ালিস্ট পাবলো নেরুদার একুশটি কবিতা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ, ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান’ (১৯২৪) প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে স্প্যানিয় কাব্য-সাহিত্যে এক নতুন ধারা তৈরি করে। খনি-শ্রমিকদের নেতা ও কবিতা এই দুটি সত্তায় নেরুদা প্রবল আবেগময় ছিলেন। কারখানার শ্রমিকদের তিনি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। তিনি বলতেন, ‘আমার কর্মের পুরস্কার হচ্ছে, আমার জীবনের সেই সব পবিত্র মুহূর্ত, যখন একটি লোক কয়লা-কালো গহ্বর থেকে, শোরার খাদ থেকে ও তামার খনি থেকে উঠে এসে, আসলে বলা উচিত, যেন নরকের গর্ত থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে এক একটি মানুষ, হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে যাদের মুখের চেহারা বিকৃত, ধুলোয় খরখরে লাল চোখ, আমাকে দেখে শুষ্ক প্রান্তরের মতোই চৌচির শক্ত হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে ঝকঝকে চোখে উৎসাহের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘আমি তোমাকে চিনি ভাই!’ এটাই আমার কবিতার শ্রেষ্ঠ অর্জন।’ নেরুদা শুধু কাব্যকৃতিতে সমৃদ্ধ ছিলেন না। ছিলেন না শুধু চিলির খনি-শ্রমিকদের বন্ধু। তিনি সারা বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষেরও অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। বিচিত্র কর্মময় জীবনের এই কবি জনমানসের কবি বলে বহুল স্বীকৃতও ছিলেন। শ্রমিকের ভাষা, সাধারণ মানুষের ভাষা তার জীবন ও সাহিত্যের একটি অংশ। সরকারী চাকরি করেছিলেন, তবে জনগণের সরকার কায়েম হবার পর। রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্যারিসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। চিলির অবিস্মরণীয় নেতা ‘কমরেড প্রেসিডেন্ট’ সালভেদর আলেন্দে ছিলেন তারই একান্ত বন্ধু এবং সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে চিলিতে। সামরিক উর্দিধারী পিনোশের নেতৃত্বে সালভেদর আলেন্দে নিহত হন ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সামরিক এক নায়ক পিনোশেকে সমর্থন ও সহায়তা দেয় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সালভেদর আলেন্দে নিহত হওয়ার পর চিলিতে তখন আলেন্দে পরিবারের কেউই বসবাস করার জন্য নিরাপদ ছিল না। বন্ধুর মৃত্যুতে নেরুদা ভেঙ্গে পড়েন এবং তার সান্তিয়াগোর বাসায় গৃহবন্দী হন। এ ঘটনার ১২ দিন পর নেরুদা মারা যান। তার মৃত্যুর পর সবচেয়ে করুণ যে ঘটনাটি ঘটেছিল, তখনকার স্বৈরাচারী পিনোশে কবির শেষকৃত্যের অনুমতি দেননি। তিনি সান্ধ্য আইন জারি করেন। লাখ লাখ মানুষ সেই আইন উপক্ষো করে রাস্তায় নেমে এসে কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়। সেটি ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চিলির জনতার প্রথম বিক্ষোভ।
×