ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যেভাবে নজরুল চর্চা করেছেন আবদুল কাদির

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ অক্টোবর ২০১৭

যেভাবে নজরুল চর্চা করেছেন আবদুল কাদির

সমালোচকের কর্তব্য নির্দেশ করে ঝ.অ. ঝপড়ঃ ষধসবং লিখেছেন- “The critic may be literary propagandist eager to push the best that there is in the literature either for the sake of literature, for the sake of humanity or both”. উপর্যুক্ত ডিসকোর্সের অনুগামী হয়ে আবদুল কাদিরের মন্তব্য ছিল এরকম ‘একথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই যে, নজরুল-সাহিত্য বিচারের ব্যাপারে আমি এই মহত্ত্বর বৃত্তিই আমার সামান্য শক্তি আনুসারে অবলম্বন করেছি।’ ছান্দসিক কবি আবদুল কাদিরের মৌলিক সাহিত্যকৃর্তীর মধ্যে রয়েছে দুটি কাব্যÑ ‘দিলরুবা’ ও ‘উত্তর বসন্ত’ এবং ছন্দ বিষয় অত্যন্ত মূল্যবান পাঠ ‘ছন্দ সমীক্ষা’ কিন্তু এই রচনার্কীতি ও বিভিন্ন লেখকদের রচনাবলী সংকলন ও সম্পাদনার মধ্যে যে কীর্তি তাঁকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে তা হলো পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী সংকলন ও সম্পাদনা এবং অর্ধ-শতাব্দিকালব্যাপী নজরুল চর্চা। ১৯২৭ সালে ‘সাহিত্যে কৃত্রিমতা’ শিরোনামের একটি নিবন্ধের মধ্যে দিয়ে তাঁর নজরুল চর্চার সূচনা ঘটে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভার পরিচায়নে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নিরলস। দেশ বিভাগ পূর্ববর্তীকালে তাঁর সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘জয়তী’ এবং দেশ বিভাগ পরবর্তীকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত তাঁর সম্পাদিত ‘মাহে নও’ পত্রিকায় নজরুল চর্চার যে নিরবচ্ছিন্ন সাধনা তিনি চালিয়েছেন তা নজরুলের সাহিত্যকীর্তির মূল্যায়নে ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। আবদুল কাদিরের নজরুল চর্চার স্বরূপ সন্ধানে এখানে মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহর কিছু মন্তব্য তুলে দেয়া যাক– “নজরুল জীবনের এবং কবির সাহিত্যকর্মের তথ্য উপাত্ত অনুসন্ধান সংগ্রহ ও সম্পাদনা এবং নজরুল জীবনী রচনায় তাঁর ভূমিকা ও অবদান ঐতিহাসিক। একাধারে কবি, সাহিত্য-সমালোচক, ছান্দসিক ও গবেষক হওয়ার দরুন এবং নজরুলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও স্নেহ লাভের সৌভাগ্য ধন্য হওয়ার কারণেও আবদুল কাদিরের নজরুল গবেষণা এবং নজরুল সাহিত্য সমালোচনা হতে পেরেছে তথ্য নির্ভর, উপস্থাপনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী এবং বহুভঙ্গিম ও নানা মাত্রিক ।...। তাঁর সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনা-সম্ভার’ ‘নজরুল পরিচিতি’ ও কয়েক খণ্ডে নজরুল রচনাবলী প্রকাশিত না হলে একালের নজরুল গবেষক ও নজরুল সাহিত্য সমালোচকদের নজরুর চর্চা ও নজরুল প্রতিভার মূল্যায়নের পথ রুদ্ধ হয়েই থাকত। নজরুল গবেষক ও নজরুল সাহিত্য সমালোচনা ও কবির প্রতিভা ও অবদানের নানামুখী নবমূল্যায়ন যে একালে সম্ভব হচ্ছে তার মূলে আবদুল কাদিরের সম্পাদিত ‘নজরুল রচনা সম্ভার’, ‘নজরুল পরিচিতি’ ও ‘নজরুল রচনাবলী’ এবং পঞ্চাশ বছরের পরিধিতে লেখা তাঁর বহুসংখ্যক প্রবন্ধ নিবন্ধের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য।” ক্ষুদ্র আকৃতি হলেও তিনিই প্রথম নজরুল জীবনীর লিপিকার। শাহাবুদ্দীন আহমেদ এর মতে– “প্রথম সুসম্পাদিত ‘নজরুল রচনা-সম্ভার’ ও পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’র প্রথম সংকলক ও সম্পাদক কবি আবদুল কাদির। বলা বাহুল্য আবদুল কাদির কর্তৃক বিপুল তথ্যপঞ্জী ও পরিচয়পঞ্জী সমৃদ্ধ ‘নজরুল রচনাবলী’ প্রকাশিত হওয়ার ফলেই উভয় বঙ্গে নজরুল চর্চার ক্রমবিকাশ বৃদ্ধি পয়েছে এবং নজরুল প্রতিভার প্রকৃত ব্যাপকতা, বৈচিত্র্য, গভীরতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে সকল বাঙালী পাঠক অবহিত হওয়ার সুযোগ পান।” সংকলন ও স্বরলিপিগ্রন্থ ব্যতিরেকে নজরুলের মোট ৫৯টি গ্রন্থ বাজারে বেরিয়েছে। এই সন্ধান গ্রন্থগুলির তালিকাসহ তুলে ধরে তিনি উপস্থাপন করেছিলেন, যার মধ্যে – (ক) কাব্য ও গীতিগ্রন্থ ৩৮টি। (খ) প্রবন্ধগ্রন্থ ৫টি। (গ) উপন্যাস ৩টি। (ঘ) গল্পগ্রন্থ ৩টি। (ঙ) নাটক ৪টি এবং (চ) ছড়া ও শিশু পাঠ্য ৬টি। বিপুল প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কাজী নজরুল ইসলাম স্বভাবে অস্থির ও অনেকাংশেই বিশৃঙ্খল ছিলেন যদিও এর পিছনে অনেক যুক্তি তর্ক রয়েছে, অবশ্য আমরা কিন্তু প্রতিভার সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলতার কোন বিরোধ বা অস্পৃশ্যতা আছে এমন বলতে চাই না। সে যাই হোক কবি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অকস্মাৎ নিস্কর্ম ও নির্বাক হয়েছেন এবং তিনি তাঁর এ বিপুল পরিমাণ সাহিত্য ও সঙ্গীত কর্মকে সংরক্ষণ ও সুবিন্যাস্ত করে যেতে পারেননি। কবি আবদুল কাদির অত্যন্ত যতœ ও সাধনার সঙ্গে নজরুলের এই বিপুল সাহিত্যকর্মকে সুবিন্যস্তভাবে, নতুন করে ‘সম্পূর্ণ নজরুল’কে উপস্থাপন করেছেন। এজন্য তিনি নজরুলপ্রেমী, সাহিত্যবোদ্ধা এবং সুধিজন কর্তৃক চিরদিন অভিনন্দিত হবেন। নজরুল সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে আবদুল কাদিরের মূল্যায়ন ও মন্তব্য ছিল খুব স্পষ্ট এবং বস্তুনিষ্ঠ, তিনি ‘নজরুল প্রতিভার স্বরূপ’ শিরোনামের রচনায় নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় মহাকবি’ বলে ঘোষণা করেন। সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ এ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রচনাটির সামান্য পাঠ –‘‘এ দেশের মানুষেরা ১৮২১ সাল থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল হতে মুক্তি লাভের জন্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে গেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর বয়স আশি পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে লেখেন : ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। (সভ্যতার সঙ্কট) এরূপ কান্ত কোমল ললিত আশা প্রকাশ ছাড়া তিনি কোনদিন দেশের রাজনৈতিক পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেননি। কিন্তু নজরুল অকুতোভয়ে দেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি চেয়ে অনেক কালোত্তীর্ণ কবিতা, গান ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন; তাঁর সাহিত্যে- তাঁর কালের, তাঁর দেশের সমগ্র হৃদয়ের ভাবনা বেদনা কল্পনা বহুকাক্সিক্ষত রূপ লাভ করেছে, সে জন্যই তিনি জাতীয় মহাকবি এবং খুব ন্যায্যভাবেই সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। নজরুলের অসামান্য প্রতিভাকে প্রথমদিকে যে অল্প কয়েকজন শিল্পবোদ্ধা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আবদুল কাদির তাঁদের অন্যতম। তিনি মনে করতেন, সৌন্দর্য কাব্যশিল্পের অপবিহার্য সত্তা হলেও বিষয়াতিরিক্ত কাব্য অসার। যেহেতু নজরুল সাহিত্যে বিষয় ও সৌন্দর্য অবিমিশ্র সত্তা অতএব উভয়ের পর্যালোচনাতেই হবে সত্যিকারের নজরুল মূল্যায়ন। তাই তিনি শিল্প, বাস্তবতা, জীবন বিশ্লেষণ, বিষয় প্রসঙ্গ, সৌন্দর্যবাদ, ছন্দ-অলংকার এবং শব্দ প্রয়োগসহ সার্বিকভাবে নজরুল মূল্যায়নে প্রয়াসী হয়েছেন। নিবন্ধের এ পর্যায়ে ‘আবদুল কাদিরের ‘নজরুল চর্চার স্বরূপ’ সন্ধানেÑ নজরুল সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রবন্ধে ও পত্রে তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ, যৌক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ মন্তব্য ও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন তার কতিপয় পাঠ উপস্থাপন করছি– (ক) কাজী নজরুল ইসলাম স্বরাজ্য দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং দারুণভাবে পরাজিত হয়েছেন; কবির নির্বাচনকালীন ওই সময়ের সঙ্গী ছিলেন আবদুল কাদির। ‘কবি জয়দেবপুরে চলছেন নির্বাচনের তদবির করতে কিন্তু তাঁর মনের অঙ্গন থেকে তখন সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে গেছে বাস্তব সংসারের সকল দ্বন্দ্ব দ্বেষ সংক্ষোভ সংঘর্ষ, শুধু বাজছে দিগন্ত-প্লাবী সৌন্দর্যের একটানা সুর-মূর্ছনা। সেই সৌন্দর্যের সূত্রে তিনি গেঁথে চললেন শ্লোকের পর শ্লোক। ‘জয়দেবপুর পথে’ শিরোনামের একটি কবিতা রচিত হলো তখন, পরে কবিতাটি কবি ‘চাঁদনি রাতে’ নাম দিয়ে ঠাঁই দেন ‘সিন্দু হিল্লোল’ কাব্যে কিন্তু প্রথমে লিখা ওই ‘জয়দেবপুর পথে’ কবিতা থেকে ছয়টি পঙ্ক্তি বাদ দেয়া হয় যা আমরা খুঁজে পাই আবদুল কাদিরের ‘নজরুল সান্নিধ্যে’ শীর্ষনামের রচনায় ‘ছুটিতেছে গড়ি, ছায়াবাজিসম কত কথা ওঠে মনে। দিশাহারা-সম ছোটে ক্ষ্যাপা মন জলে থলে নভে মনে। এলোকেশে মোর জড়ায়ে চরণ কোন বিরহিনী কাঁদে যত প্রিয়হারা আমারে যেন গো বাহু বন্ধনে বাঁধে। নিখিল বিরহী ফরিয়াদ করে আমার বুকের মাঝে আকাশে বাতাসে তাদেরি মিলন তাদেরি বিরহ বাজে।’ (খ) ‘নজরুলের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তাতে তিনি মহাকবি না হলেও মহৎ কবি হতে পারতেন। দুদৈর্ববশত সে দাবিও তিনি পুরোপুরি পালন করে যেতে পারেন নি’। হীরেন্দ্রনাথের এমন বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আবদুল কাদির তাঁর ‘নজরুল প্রতিভার স্বরূপ’ রচনায় শাহাবুদ্দীন আহমেদ– এর ভাষ্যে রবীন্দ্রনাথের একটি ঐতিহাসিক মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, যা এখানে পাঠযোগ্যÑ ‘কাব্যটি তখনই মহাকব্যের পর্যায়ে উন্নীত হয় যখন তার বীণাতন্দ্রীতে অনুরণিত হয়ে ওঠে মহাজাতির মহাবেদনার গান। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সন্ধ্যা’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘জিঞ্জির’ এইসব কাব্যগ্রন্থ মহাজাতির মহাবেদনার মহাদুঃখের আর্তকণ্ঠের মহাসঙ্গীত। একটি জাতির একটি যুগের মৃত্যুপীড়িত কণ্ঠের ভাষা রূপায়িত হয়ে উঠেছে ঐসব কাব্যে...” (গ) ‘রবীন্দ্র নজরুল সম্পর্ক’ শীর্ষনামের নিবন্ধে আমরা দেখি ১৩৩৭ সালে নজরুল, শ্রীঅবনী রায়, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী, শ্রীপ্রবোধ গুহ প্রভৃতি দার্জিলিংয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে গেলে রবীন্দ্রনাথ স্নেহের সুরে নজরুলকে বলেন, ‘ইতালীতে এক দ্বীপের মাঝখানে বাস করেন দ্যনুনজিও; তিনি তোমার চাইতেও পাগল’। এধনৎরষব ফ’ধহহঁহুরড় (১৮৬৩Ñ১৯৩৮) রচনা করেন নজরুলেরই মতো উদ্দীপনাময়ী কবিতা। তিনি ছিলেন নজরুলের মতো কর্মিষ্ঠ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে যে হৃদ্যের সম্পর্ক ছিল তা ব্যাপক তথ্য ও ঘটনার আলোকে তিনি রচনাটিতে তুলে ধরেছেন। (ঘ) ‘নজরুলের কাব্যলোক’ শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি নজরুলের কাব্য প্রবণতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি বাংলা ভাষায় সর্বপেক্ষা অধিক সংখ্যক বৈপ্লবিক কবিতা রচনা করিয়াছেন। এই জীবনবাদী কবির রচনায় বিপ্লব সৃষ্টির আকাক্সক্ষাও প্রকাশ পাইয়াছে ‘আমি যুগে যুগে আসিয়াছি পুন:মহাবিপ্লব হেতু/এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’ রচনাটির শেষ দিকে আমরা তাঁর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করি, ‘প্রধানত নারীপ্রেমের প্রেরণা হইতেই তাঁহার বিদ্রোহ ভাবের জন্ম; তাই পরিণামে সেই দৈব-প্রতিভার প্রকাশ হইয়াছে প্রেমের কবিতায় ও সঙ্গীত রচনায়’। (ঙ) ‘অগ্নিগিরি’ গল্পটিকে নজরুলের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি– ‘নজরুলের ছোটগল্প’ নামের রচনায় লিখেন ‘নায়ক সবুর আখন্দ শান্ত গোবেচারী এক ছাত্র। পাড়ার রুস্তমের দল প্রত্যহ তাকে অন্যায়ভাবে অনর্থক জ্বালাতন করে। একদা নায়িকা নূরজাহানের ভর্ৎসনায় শান্ত সবুর হয়ে উঠল অশান্ত মৌনী পাহাড়, হয়ে উঠল অগ্নিগিরি। প্রেমের বিদ্যুৎ স্পর্শে সবুরের মধ্যে জেগে উঠল দৃপ্ত পৌরুষ। এই গল্পটির আরম্ভ হাসির দীপ্তিতে আর সমাপ্তি অশ্রুর কুয়াশায়। মনে হয়, এইটিই নজরুলের শ্রেষ্ঠ গল্প’। (চ) ‘যুগ-কবি নজরুল’ রচনায় আবদুল কাদিরের বক্তব্য– ‘নজরুল যুগ-প্রতিভু। বাংলা সাহিত্যে এরূপ যুগ-প্রতিনিধি আর আসেননি। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই থেকে নজরুল মস্তিষ্কের অবশীর্ণতা রোগে ভুগছেন। অতঃপর এই উপমহাদেশে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বাংলা কাব্যে তার প্রতিফলন কতখানি দেখা গেছে? এই একটি দিক বিচার করলেই বুঝা যাবে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের দানের বিশেষত্ব।... কালের প্রভাব এড়িয়ে কোন মহৎ প্রতিভাই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে পারে না। আনন্দের কথা যে, নজরুল সাহিত্যে কালের স্পর্শ সুগোচর অথচ শিল্পগুণে তা কালোত্তীর্ণ।’ (ছ) ‘নজরুলের কবিতার ছন্দ-পরিচয়’ নামের রচনায় তিনি গদ্য ও পদ্য ছন্দের মধ্যে পার্থক্য ও সামর্থ্য-অসামর্থ্য সম্পর্কে শুরুতেই দারুণ এক ডিসকোর্স তুলে দেন– ‘শেলী তাঁহার ‘ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’-তে প্লোটো, রুশো প্রভৃতির কয়েক খানা গদ্যগ্রন্থকেও কাব্য-আখ্যায় আখ্যায়িত করিয়াছেন। গদ্যেও কল্পনার লীলা ভাবের স্পন্দন ও ধ্বনি তরঙ্গ থাকিতে পারে, তবে যে গদ্য পদ্যকাবের গুণকে যতখানি আয়ত্ত করিয়াছে সে গদ্য ততখানি কাব্য-পদবাচ্য। যেহেতু গদ্যছন্দ কোনো ধ্বনিগত নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন নয়, অতঃএব গদ্য ভঙ্গিতে হিল্লোল-সৃষ্টি অথবা ভাষার সংযত প্রকাশ শ্রেষ্ঠ প্রতিভারও অনেকখানি আয়াসসাধ্য বই কি’। রচনাটির শেষ দিকে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মাত্রবৃত্তে ছয় মাত্রার চালে সর্বাধিক সংখ্যক কবিতা সংরচিত হয়েছে। এই ছন্দে মুক্তক রচনার রীতি প্রবর্তন করেন নজরুল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যে এই রীতির প্রথম কবিতা। কয়েক পঙ্ক্তি – ‘বল বীর বল উন্নত মম শির। শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।’ (জ) ‘নজরুল সাহিত্য বিচার’ প্রবন্ধে দেখা যায়, বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রগতি’তে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’কে বলা হয় তাঁর প্রথম কবিতা। এমন ভ্রান্ত একটি মন্তব্যকে বর্জন ও অপসারিত করতে আবদুল কাদির ‘নজরুল সাহিত্য বিচার’ প্রবন্ধে সন, তারিখ ও সাময়িকীর নামসহ দেখিয়েছেন ‘বিদ্রোহী প্রকাশের পূর্বে নজরুলে আরও প্রায় অর্ধশত কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নজরুলে প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’। (ঝ) নজরুল সংক্রান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা ‘নজরুল সান্নিধ্যে’ শিরোনামের রচনাটিতে আবদুল কাদির নজরুলের অসুস্থতারম্ভ সম্পর্কে একটি বিরল ও দু¯প্রাপ্য তথ্য প্রদান করেন– “১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে নজরুল সম্পাদিত নবযুগে আমি বার্তা সম্পাদক রূপে যোগ দেই। নবযুগে নজরুলের বহু মূল্যবান কবিতা বের হয়, তাতে তাঁর স্বাক্ষরিত একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘আমার সুন্দর’। এই প্রবন্ধটির কঠোর প্রতিবাদ করে কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘সুন্দরম’ নামে সুদীর্ঘ সমালোচনা প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কলকাতা রেডিও অফিস গানের প্রোগ্রাম করতে গেলে লেখাটি কবির চোখে পড়ে; তারই পরে তথায় স্ট্রোক হয়ে তিনি পরিশেষে মস্তিষ্কের অবশীর্ণতা রোগে আক্রান্ত হন। সেই ১০ জুলাই এরপর নবযুগ অফিসে তাঁর সহচার্য আমাদের আর লাভ হয়নি।” (ঞ) কবি আবদুল কাদির ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধুবর কমরেড মুজফফ্র আহমদের জামাতা। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফফ্র আহমদের লেখা ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ নামের সুবিখ্যাত পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। আবদুল কাদির ছিলেন নজরুলের একনিষ্ঠ অনুরাগী এবং নজরুল বিষয়ে গভীর-সন্ধানী বোদ্ধা। তিনি গ্রন্থটিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ত্রুটি পেয়ে যান এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই এক বিস্তৃত পত্রের মাধ্যমে সেসব তথ্যের সত্যতা উল্লেখপূর্বক একটি পত্র পাঠান তাঁর শ্বশুর মুজফফ্র আহমদকে। নজরুল সংক্রান্ত আলোচনা তর্ক ও তথ্যের প্রেক্ষিতে এমনই সতর্ক ও অতন্দ্র ছিল আবদুল কাদিরের চর্চা। আজ এত বছরের চর্চা-পরিচর্যা ও কালপরিক্রমার অবসানে নজরুল সম্পর্কে আমরা যে সিদ্ধান্তে এসেছি, সেরকম মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ আবদুল কদির করেছিলেন আরও সাতাশি বছর আগেই। ১৯২৯ সালে ‘কাজী নজরুল-সংবর্ধনা’ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে যে কয়জন কবি বাংলা-সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভূত হইয়াছেন, তাহাদের আর সকলের কবিতার চাইতে নজরুলের কবিতাতেই অধিকতরভাবে পাওয়া যায় একটা তাজা প্রাণের সুনিবিড় স্পর্শ –যাহা কবিতার বড় জিনিস!’ কাজী নজরুল ইসলাম বিহারীলালসহ রবীন্দ্রযুগের গীতি-কবিতার সঙ্গে তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার সংযোগ স্থাপনের তথা সেতুবন্ধনের নন্দিত কারিগর। নজরুল বাংলা ভাষাকে উচ্ছ্বল করেছেন, এ ভাষার যে প্রবল প্রাণশক্তি ও শাণিত বাক্মহিমা রয়েছে যেটা প্রতিষ্ঠা করেছেন নজরুল। তাঁর ভাষা-প্রবণতাই তিরিশোত্তর কবিদের আরও জীবনঘনিষ্ঠ, মনোময় ও গতিশীল ভাষা নির্মাণে ভূমিকা পালন করে। বিদ্রোহী কবিকে আজ আমরা যে সার্বিক ও তথ্যনিষ্ঠভাবে পেয়েছি তার পুরোভাগে রয়েছে কবি আবদুল কাদিরের ব্যাপক অবদান। নজরুলকে তিনি ভালবেসেছেন অনুগামী হিসেবে নয় বরং একজন মহৎ কবির গুণ ও সৃজনে মুগ্ধ-সম্মোহিত হয়ে আর সেই প্রীতিবোধই তাঁকে মৃত্যুঅবধি নজরুল চর্চায় নিয়োজিত রেখেছে। রচনাবলী সম্পাদনা ছাড়াও আবদুল কাদির রচিত নজরুল বিষয়ক গবেষণা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও পত্রাবলীর সংখ্যা অর্ধশতাধিক। শীর্ষে আরোহণ করতে যেমন ডালপালা অতিক্রম করতে হয়, তেমনি নজরুল প্রতিভার স্বরূপ নিরূপণে এবং নজরুলকে সম্পূর্ণভাবে উদ্ভাবনে আবদুল কাদিরের গবেষণা, সম্পাদনা, মূল্যায়ন ও মন্তব্য-সন্ধান আকাক্সক্ষীদের অপরিহার্য পাঠ।
×