ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

পার্বতী দেবদাস ও চন্দ্রমুখীর শরৎচন্দ্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ অক্টোবর ২০১৭

পার্বতী দেবদাস ও চন্দ্রমুখীর শরৎচন্দ্র

শরৎচন্দ্র বিশ শতকেই বাঙালীর হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলেন। কিশোর থেকে বৃদ্ধ- সব বয়সী মানুষের কাছে তাদের নিজস্ব পরিম-লকে যেন খুঁজে পেয়েছিলেন। শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে শরৎচন্দ্র ধরা পড়েছিলেন কৈশোরেই। বলেছেন তিনি, ‘কিশোর বয়সে শরৎচন্দ্রের অনেক লেখা পড়ে আমাদের চোখ সজল হতো। আমরা কাঁদতামও। দেখলাম শরৎচন্দ্র ক্ষমতা রাখেন বার্ধ্যক্যে পৌঁছানো পাঠকদেরও অভিভূত করতে। কারণ মনস্তত্ত্বে¡র খবর তিনি রাখতেন। যেমন তার কাল্পনিক মানুষদের, তেমনি তার পাঠকদেরও। নিজের আবেগকে তিনি অনায়াসে সংক্রমিত করে দেন পাঠকের মধ্যে। একজন শিল্পীর জন্য সেই ক্ষমতাটা সামান্য নয়। কিন্তু কেবল আবেগের ওপর প্রভাবই যে পড়ে, তা নয়। প্রভাব পড়ে চিন্তাধারার ওপরেও। সেই প্রভাবটা সূক্ষ্মতাই বলে অবান্তর নয়।’ আসলে পাঠকমাত্রই শরৎচন্দ্রের লেখা পাঠ করে আনন্দ যেমন পেয়েছেন, তেমনি প্রভাবিতও হয়েছেন, কখনও অজান্তেই। সেই প্রভাবকে যে অতিক্রম করতে পেরেছেন সব সময়, তা নয়। আর তাই এখনও সতেজ হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র সেকালের সমাজের অর্গল ভেঙ্গে একালের সমাজেও বাঙালী পাঠক মাত্রেরই কাছে কিংবা চলচ্চিত্রের যারা দর্শক, তাদের দৃশ্যময়তায় আজও অমলিন পারু ও তার দেবুদা এবং চন্দ্রমুখী। মান-অভিমান, বিরহ-দহন, ভালবাসা-ঘৃণা সব মিলিয়ে এক জাদুর মতো তারা হৃদয়ের এ কূল ও কূল দু’কূল প্লাবিত করে এই একুশ শতকেও। ভুল বুঝা আর ভুলের বোঝার ভেতর দিয়ে পাড়ি দিয়ে আসা মানুষগুলো বইয়ের পাতা থেকে, সিনেমার সেলুলয়েড থেকে যখন পাঠক দর্শকের হৃদয় অলিন্দ পেরিয়ে গভীর গহনে ঠাঁই নেয়, তখন এক ধরনের দ্যোতনা তৈরি হয়। সেই দ্যোতনার মধ্যে জাগতিক সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না, বাঁচা-মরা, আনন্দ বেদনাগুলো থরথর করে কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে ভূ-কম্পনের মতো সশব্দে ফেটে ওঠে কখনও সখনও। দোষে-গুণে বেড়ে ওঠা মানব চরিত্রের নানাদিক পল্লবিত হয়ে উঠেছে শক্তিশালী হাতে। এই এক জাদুময়তা। সমকালের কোলাহল ছাড়িয়ে, ভাবীকালের স্বরূপ পেরিয়ে আরও দূরদিগন্তে যাবার পথ নিজেই প্রশস্ত করে নিয়েছে লেখকের সৃষ্ট চরিত্রেরা। ‘হৃদয় চিরিয়া যদি দেখাতে পারিতাম’ বলে একালের বাংলা গানে যে আর্তি জেগে ওঠে, সেকালেই তিনি তা দেখিয়েছেন, সেই হৃদয়ের কী দাম। অবশ্য কড়ি দিয়ে কেনার মতো নয়। ঐশ্বর্য তার মহামূল্যবান। দাম দিয়ে যা যায় না কেনা। উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে লেখক বস্তুজগত আর মানসজগতকে দেখেছেন অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হয়েই যেন। সুদর্শন নয়, আটপৌঢ়ে বাঙালী চেহারার মানুষটি চারপাশের জীবন জগতকে, মানব চরিত্রকে অবলোকন করেছেন বহিরঙ্গ থেকে শুধু নয়, অন্তরঙ্গ থেকেই। বিস্ময়করভাবে তুলে আনতে পারেন ঝিনুকের ভেতর থেকে মুক্তো। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে খনি তৈরি করে সেখান থেকে হীরা পান্না চুন্নিসহ মূল্যবান পাথর খ- অনায়াসে হাতের মুঠোয় তুলে এনে বিচ্ছুরিত করতে পারেন চারপাশের দিগন্ত। অসামান্য এক কথাসাহিত্যিক তিনি। এক শ’ চল্লিশ বছরের আগেও জন্মেছিলেন বৃহত্তর বঙ্গে। তারপর কেটেছে জীবন, সাহিত্যের প্রতি নিবেদনে। অতুলনীয় গদ্যভাষা তিনি আয়ত্ত করে নিতে পেরেছিলেন অনায়াসে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগতকে, নারীর জীবন জিজ্ঞাসাকে ধারণ করতে পেরেছিলেন নিজস্ব সৃষ্টির বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। গল্পকে তিনি অবলীলায় বর্ণনা করে যেতে পারতেন, পাঠকের হৃদয় মস্তিষ্কের কোষে কোষে তা অনুরণিত হতো। সমকালে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল তীব্র। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল পাঠকেরই মানস জগতে নিজস্ব সৃষ্টিকে তুলে দিয়েছেন অপরূপ ব্যঞ্জনায়। নিরন্তর লিখে গেছেন। বাহুল্যবর্জিত তার কাহিনী কোন সাদামাটা গল্প গাথায় আকীর্ণ হয়নি। মানব মনের অভ্যন্তরে থাকা গুপ্ত বাসনাগুলো চমৎকারভাবে আহরণ করে কালো অক্ষরে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তুলেছেন। পাঠক মাত্রই তাতে নিবিষ্ট হতে বাধ্য। কোথায় থামতে হবে, যেতে হবে কতটুকু পথ, সবই ছিল তার নখদর্পণে। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিশ শতকের বাঙালী যুবা, নারী, পুরুষসহ সব বয়সীর কাছে যার অবস্থান অতুলনীয়। সেই রেশ এখনও অম্লান, শরৎচন্দ্রের ষাটতম জন্মদিনের সংবর্ধনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হাজির হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘জ্যোতিষী অসীম আকাশে ডুব মেরে সন্ধান করে বের করেন নানা জগত, নানা রশ্মিসমবায়ে গড়া, নানা কক্ষপথে নানা বেগে আবর্তিত। শরৎচন্দ্রের দৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালীর হৃদয় রহস্যে। সুখে-দুঃখে মিলনে বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয় দিয়েছেন বাঙালী যাতে আপনাকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে। তার প্রমাণ পাই তার অফুরান আনন্দে। যেমন অন্তরের সঙ্গে তারা খুশি হয়েছে এমন আর কারও লেখায় তারা হয়নি। অন্য লেখকরা অনেক প্রশংসা পেয়েছে কিন্তু সর্বজনীন হৃদয়ের এমন আতিথ্য পায়নি। এ বিস্ময়ের চমক নয়, এ প্রীতি। অনায়াসে যে প্রচুর সফলতা তিনি পেয়েছেন, তাতে তিনি আমাদের ঈর্ষাভাজন।’ রবীন্দ্রনাথ দূরদর্শী বলেই টের পেয়েছিলেন, শরৎচন্দ্র শতাব্দী পেরিয়েও ঈর্ষণীয় অবস্থানে থেকে যাবেন। শরৎ কাহিনী সমকালকে ছাড়িয়ে ভাবীকালের মধ্যেও বিশাল অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। তা পারারই কথা। মানব-মানবীর মনের গহনে, চিন্তার গভীরে তিনি প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তাদের অন্তরের গভীর চেতনাকে ধারণ করেই। রবীন্দ্রনাথেরও হয়ত উপলব্ধি ঘটেছিল যে, শরৎচন্দ্র বাঙালীর হৃদয় নন্দন বলে প্রজাপতির মতো পাখা মেলে উড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শরৎচন্দ্র দেখেছেন তার সৃষ্ট চরিত্রদের যেমন, ‘কিন্তু কোনক্রমেই স্থির করিতে পারিতে ছিল না যে, তাহার আশা কতখানি এবং নিরাশা কতখানি। তবে একটা কথা এই যে, মানুষ এমনি দুঃসময়ের মাঝে আশা-নিরাশার কূল-কিনারা যখন দেখিতে পায় না, তখন দুর্বল মনে বড় ভয়ে ভয়ে আশার দিকটাই চাপিয়া ধরিয়া থাকে। যেটা হইলে তাহার মঙ্গল, সেইটাই আশা করে। ইচ্ছার বা অনিচ্ছার সেই দিকপানেই নিতান্ত উৎসুক নয়নে চাহিয়া দেখিতে চাহে।’ শরৎচন্দ্র কিশোরী ও নারীর বোধ এবং বোধের গভীরে বসবাস করা আশা-নিরাশার দোলাচলকে গভীর মনোনিবেশ সহকারে উপলব্ধি শুধু নয়, তার বাস্তব প্রতিফলনও দেখিয়েছেন কাহিনীতে। আশা ফুরিয়ে গেলেই মানবমনে হতাশা তৈরি হয়। দীর্ঘদিন ধরে কাছের মানুষের উপেক্ষা মানসিক অবসাদ তৈরি করে। তার ওপরে যদি বুঝা যায়, অবসাদ মুক্ত হওয়ার আশা ক্ষীণ, তখন হতাশা বেশি করে গ্রাস করে। মানসিক চাপ বাড়ে। জীবনের প্রতি বিরক্তি তৈরি হয়। দেবদাস বা পারুর ক্ষেত্রে সেই অবসাদের ভাবভঙ্গি প্রকটিত হয়নি বলেই বিফলতার এপার-ওপারে কী দাঁড়ায়, তা তাদের বোধে জাগেনি।শরৎচন্দ্র মধ্যবিত্ত বাঙালীর জীবনধারা, যা তার সময়ের একটি প্রবাহমান ধারা, তাকে ঘিরেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। লেখকের নিজস্ব চিন্তার ভেতর দিয়ে নিজস্ব ভাবনা ধারার একটি পরিকাঠামো গ্রহণ করেছেন। মধ্যবিত্তের মানসিক ভুবনে তিনি নতুন করে কোন চিন্তা বা মতাদর্শকে দাঁড় করাননি। বরং বহমান মতাদর্শকে অন্তঃস্থিত অবস্থান হতে তুলে এনেছেন। আর এই তুলে আনার সময় যেখানে যা পেয়েছেন, সবই থলেতে ভরেছেন। কিন্তু তা থেকে সৃষ্টির সময় যাছাই-বাছাই করে নিয়েছেন মানব-মানবীর ভাবনা-ধারার গভীরতাকে। শরৎচন্দ্র বিশ শতকেই বাঙালীর হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলেন। কিশোর থেকে বৃদ্ধ- সব বয়সী মানুষের কাছে তাদের নিজস্ব পরিম-লকে যেন খুঁজে পেয়েছিলেন। শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে শরৎচন্দ্র ধরা পড়েছিলেন কৈশোরেই। বলেছেন তিনি, ‘কিশোর বয়সে শরৎচন্দ্রের অনেক লেখা পড়ে আমাদের চোখ সজল হতো। আমরা কাঁদতামও। দেখলাম শরৎচন্দ্র ক্ষমতা রাখেন বার্ধ্যক্যে পৌঁছানো পাঠকদেরও অভিভূত করতে। কারণ মনস্তত্ত্বে¡র খবর তিনি রাখতেন। যেমন তার কাল্পনিক মানুষদের, তেমনি তার পাঠকদেরও। নিজের আবেগকে তিনি অনায়াসে সংক্রমিত করে দেন পাঠকের মধ্যে। একজন শিল্পীর জন্য সেই ক্ষমতাটা সামান্য নয়। কিন্তু কেবল আবেগের ওপর প্রভাবই যে পড়ে, তা নয়। প্রভাব পড়ে চিন্তাধারার ওপরেও। সেই প্রভাবটা সূক্ষ্ম তাই বলে অবান্তর নয়।’ আসলে পাঠকমাত্রই শরৎচন্দ্রের লেখা পাঠ করে আনন্দ যেমন পেয়েছেন, তেমনি প্রভাবিতও হয়েছেন, কখনও অজান্তেই। সেই প্রভাবকে যে অতিক্রম করতে পেরেছেন সব সময়, তা নয়। আর তাই এখনও সতেজ হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র সেকালের সমাজের অর্গল ভেঙ্গে একালের সমাজেও। সমাজ ব্যবস্থা বদলেছে, কিন্তু মানবমনের রহস্যগুলো সেভাবে বদলায়নি। মনস্তাত্ত্বি¡ক জগতে বহুকিছুই নিরন্তর প্রবাহিত। আর সেই প্রবহমানতায় শরৎচন্দ্র এখনও এসে কড়া নাড়েন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী আজও নিপীড়িত। তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রও সঙ্কুুচিত। তথাপি নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেমের; ভালবাসার যে শিখা জ্বলে ওঠে, তা সীমানা মানেনি কোনকালেই। কিন্তু নারী যখন সংসারে এসে পৌঁছে, তখন বৈষম্যগুলো প্রকটিত হয়। সংসারের ঘানি টানা, সন্তান উৎপাদন, লালন পালন, পতিসেবা হাসিমুখে সব উৎপীড়ন সয়ে যাওয়ার মতো কাজ তাকে করে যেতে হয়, কারাবন্দীর শ্রমের মতোই। সামান্য ফুরসতও সেখানে মেলে না। ‘পতিই পরমগুরু’Ñএই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে নারীকে পথ চলতে হয়। সেই চলার পথটাকে খুব কাছ থেকেই দেখেছেন শরৎচন্দ্র। দেবদাস উপন্যাসে তিনি মানব চরিত্রের নানা দিককে ওলট পালট করে দেখেছেন। তার দেখার দৃষ্টি একান্তই নিজস্ব। লিখেছেন ‘সতর্ক এবং অভিজ্ঞ লোকদিগের স্বভাব এই যে, তাহারা চক্ষুর নিমিষে কোন দ্রব্যের দোষগুণ সম্বন্ধে দৃঢ় মতামত প্রকাশ করে নাÑ সবটুকু বিচার না করিয়া, সবটুকুর ধারণ করিয়া লয় না; দুটো দিক দেখিয়া চারদিকের কথা কহে না। কিন্তু আর এক রকমের লোক আছে যাহারা ঠিক ইহার উল্টা। কোন জিনিস বেশিক্ষণ ধরিয়া চিন্তা করার ধৈর্য ইহাদের নাই; কোন কিছু হাতে পড়িবামাত্র স্থির করিয়া ফেলে- ইহা ভাল কিংবা মন্দ; তলাইয়া দেখিবার পরিশ্রমটুকু ইহারা বিশ্বাসের জোরে চালাইয়া লয়। এ সকল লোক যে জগতে কাজ করিতে পারে না তাহা নহে, বরঞ্চ অনেক সময় বেশি কাজ করে। অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইলে ইহাদিগকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে দেখিতে পাওয়া যায়। আর না হইলে, অবনতির গভীর কন্দরে চিরদিনের জন্য শুইয়া পড়ে; আর উঠিতে পারে না; আর বসিতে পারে না, আর আলোকের পানে চাহিয়া দেখে না, নিশ্চল, মৃত জড়পি-ের মতো পড়িয়া থাকে। এই শ্রেণীর মানুষ দেবদাস।’ উপন্যাসের নায়ক চরিত্রের এই বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে সমকালীন সামন্ত সমাজের সকরুণ চেহারা। কী ভাবে মানুষকে তার জীবন জিজ্ঞাসার দিকগুলো থেকে সরিয়ে নানা ঘোরপ্যাঁচে আবদ্ধ করে ফেলে। দেবদাস দৃঢ় ঋজু চরিত্রের নয়। সমাজ, পরিবারের নানা বিশ্বাস, দ্বন্দ্ব তাকে কুরে কুরে খেয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব সত্তাকে বিকশিত করার ক্ষেত্র আর তৈরি হয়নি। বরং নায়িকা পারু বা পার্বতীর অভিমানগুলো বৃক্ষলতার মতো ছড়িয়ে পড়লেও তার দৃঢ়তা, ঋজুতা, সাহসিকতা প্রত্যাখ্যানের মতো মানসিকতা অন্যতর আবহ ও ব্যঞ্জনা তৈরি করে। তাই সে যখন রাত্রি গভীরে একাকী দেবদাসের ঘরে প্রবেশ করে লোকচক্ষুর সামনে দিয়েই এবং সাহসে ভর করে, তখন সমকালীন নারীর অবস্থান থেকে তাকে ভিন্নতরই মনে হয়। তাকে দেখে দেবদাস ভীত, সঙ্কুচিত হয়েছিল বৈকি জমিদার তনয় হওয়ার পরও। পার্বতীর এই গোপন প্রবেশে লজ্জাবোধ জেগেছিল দেবদাসের। যে কারণে সে ভীতচকিতের মতো বলে, ‘কিন্তু আমিই কি মুখ দেখাতে পারব’। জবাবে পার্বতী তেমনি অবিচলিত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘তুমি? কিন্তু তোমার কি দেবদা? একটুখানি মৌন থাকিয়া পুনরায় কহিল, তুমি পুরুষ মানুষ। আজ না হয় কাল তোমার কলঙ্কের কথা সবাই ভুলবে? দু’দিন পরে কেউ মনে রাখবে না। কবে কোন্ রাতে হতভাগিনী পার্বতী তোমার পায়ের ওপর মাথা রাখার জন্য সমস্ত তুচ্ছ করে এসেছিল।’ পার্বতী দেবদাসের পায়ের ওপর মাথা রেখে অবরুদ্ধস্বরে বলে উঠেছিল, ‘এইখানে একটু স্থান দাও, দেবদা।’ কিন্তু দেবদাস দৃঢ়চিত্তের অধিকারী ছিল না। তাই অবলীলায় সে রাতের কথা পরবর্তী সময়ে পারুকে মনে করিয়ে দিয়ে দেবদাস যা বলে, তা ভূমিকম্প বৈকি পারুর জন্য। কিন্তু পারুর দৃঢ়তা, ঋজুতা তাকে সেই কম্পনে কম্পিত হতে দেয়নি। দেবদাস পারুকে এক চিঠিতে লেখে, ‘তোমাকে আমি যে বড় ভালবাসিতাম, তাহা আমার কোনদিন মনে হয় নাই। আজও তোমার জন্য আমার অন্তরের মধ্যে নিরতিশয় ক্লেশ বোধ করিতেছে না। শুধু আমার বড় দুঃখ যে, তুমি আমার জন্য কষ্ট পাইবে। চেষ্টা করিয়া আমাকে ভুলিও এবং আন্তরিক আশীর্বাদ করি, তুমি সফল হও।’ পারু কী সে ক্ষেত্রে সফল হবে? সে তো তার সবকিছু তার দেবদার জন্য উৎসর্গ করে রেখেছে। সেই প্রাপ্তি যদি না ঘটে, তবে তার সাফল্য কোথায়, সফলতাই বা কীসের? বয়সী দ্বিজবর এবং সন্তানের পিতার সঙ্গে বিয়ে ও সংসার যাপনে পার্বতী বিন্দুমাত্র হতাশা, দুঃখ, ক্লেশের প্রকাশ ঘটায়নি। বরং এটাই যেন বাস্তবতা এবং তাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যে তাকে যেতে হবে, সেই বোধ তাড়িত হয়ে সে সংসারের কাজকর্মে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছিল। কিন্তু বিপরীতে পতিত মানবের পথে নিজেকে সমর্পিত করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় তো ছিল না দেবদাসের। নিজস্ব সত্তার বিকাশ ঘটাতে না পারা দেবদাস জীবন চক্রে ঘুরতে ঘুরতে বাঈজি পল্লীর চন্দ্রমুখীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। কিন্তু তার প্রতিও তার ভালবাসা জন্ম নেয়নি। বরং চন্দ্রমুখীর দেবদাসের প্রতি যে দুর্বলতা জমে উঠেছিল, তা দেবদাসকে জানানোর ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল না। দেবদাস দেউলিয়া হয়ে পড়লে চন্দ্রমুখীও সহায়তার হাত বাড়িয়ে ছিল। চন্দ্রমুখী মদ্যপ দেবদাসকে বলেছিল, ‘তোমাকে সত্যি বলছি, তুমি দুঃখ পেলে আমারও বড় বাজে। তা ছাড়া আমি বোধহয় অনেক কথাই জানি। মাঝে মাঝে নেশার ঘোরে তোমার মুখ থেকে অনেক কথাই শুনেছি। কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস হয় না যে, পার্বতী তোমাকে ঠকিয়েছে। বরঞ্চ মনে হয়, তুমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছ। দেবদাস, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়, এ সংসারে অনেক জিনিস দেখেছি। আমার কি মনে হয় জান? নিশ্চয় মনে হয়, তোমারই ভুল হয়েছে। মনে হয় চঞ্চল এবং অস্থিরচিত্ত বলে স্ত্রীলোকের যত অখ্যাতি; ততখানি অখ্যাতির তারা যোগ্য নয়। অখ্যাতি করতেও তোমরা, সুখ্যাতি করতেও তোমরা। তোমাদের যা বলবার অনায়াসে বল, কিন্তু তারা তা পারে না। নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে না। পারলেও তা সবাই বোঝে না’। চন্দ্রমুখী স্পষ্ট করেছিল যে দেবদাস আসলেই নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছে। চন্দ্রমুখীর কথাকে এখন দেবদাসের মনে হচ্ছে সত্য। কিন্তু নিজস্ব উপলব্ধি তাকে জীবন সম্পর্কে, ভালবাসা সম্পর্কে সম্যক বোধ তৈরি করতে দেয়নি। দুই নারীকে তুলমূল্য করে দেবদাস বুঝেছিল, পারু অভিমানী উদ্ধত আর চন্দ্রমুখী শান্ত সংযত। মুখ ফুটে বলেছিল, চন্দ্রমুখীকে সে ভালবাসে। তাই মৃত্যুর পরে যদি আবার মিলন হয় তখন সে চন্দ্রমুখী হতে দূরে থাকতে পারবে না। কিন্তু দেবদাস ক্রমশ উড়নচ-ীতে পরিণয় হয়েছিল। কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ গিয়েও তার মধ্যে শান্তি ও স্বস্তির কোন রূপ ধরা পড়েনি। পুরনো ভৃত্য ধর্মদাস তাকে রক্ষার জন্য চেষ্টা করেও বিফল হয়েছিল। সেই বিফলতা থেকে মুক্তির কোন উপায় ছিল না। অসুখ বিসুখ এসে তাকে ঘিরে ফেলেছিল। পার্বতীর শ্বশুরবাড়ির পাশে দেবদাস বৃক্ষের নিচে মৃত্যুকে বরণ করেছিল। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে পার্বতী ছুটে গিয়েছিল দেবদাসকে শেষবার দেখার জন্য। কিন্তু পথে মূর্ছা যায়। দেবদাসের এই মৃত্যু পার্বতীর পক্ষে মেনে নেয়া বড়ই কষ্টের, দুঃখের, বেদনার বৈকি। শরৎচন্দ্র অবশ্য উপন্যাসের শেষ অংশে লিখেছেন, ‘এখন এতদিনে পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না। সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না। শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে কেউ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মতো দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনও দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য; অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে; তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকর স্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুণাও স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ স্বয়ং স্রষ্টা শরৎচন্দ্র তার সৃষ্ট চরিত্রকে করুণ মৃত্যুর ভেতর ঠেলে দিয়ে তার জন্য অনুশোচনা করছেন আবার। এমনটা শরৎ চন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব। যদিও স্রষ্টা নিজেই তার এই কাহিনীকে বাতিল বলে মনে করতেন, এমনকি ভাবতেনও তা পাঠকের কাছে উপবেশনের উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু সেই জিনিসই যে মহার্ঘে পরিণত হবে শুধু নয়, শতবর্ষ ধরে তা জ্বলজ্বল করে জ্বলবে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। দেবদাস যে বিশেষণে পরিণত হবে, সে উপলব্ধিও হয়নি। হবার কথাও নয়। সৃষ্টির (১৯০০ সাল) সতেরো বছর পর যখন তা প্রকাশিত হলো (১৯১৭ সাল) দেখা গেল প্রোগ্রাসে গিলছে ভূ-ভারতের মানুষজন। শতবর্ষ পেরিয়ে এখনও তাই টাটকা সতেজ। এখনও পাঠকের চিত্তকে নাড়া দেয়। বাঙালীর সমাজ জীবনে দেবদাস এখনও আলোড়িত হয় চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটে। বাংলা ভাষার আর কোন কাহিনী বিভিন্ন ভাষায় এতো বেশি চলচ্চিত্রায়িত হয়নি বিশ ও একুশ শতকে। কোন কোন ভাষায় একাধিকবার। দেবদাস ট্র্যাজিক হিরো। তার ট্র্যজিডিই তাকে অমর করে রেখেছে। তাই রূপালি পর্দায় বারে বারে ফিরে আসে দেবদাসের প্রেম। পারু ও চন্দ্রমুখী এই দুই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে দেবদাসকে পাড়ি দিতে হয়েছে। মৃত্যুর আগে পারুর স্পর্শটুকু চেয়েছিল দেবদাস। কিন্তু সমাজ বাস্তবতা তাকে সে সুখ স্পর্শ দেয়নি। শরৎচন্দ্র ভাবেননি, এই উপন্যাস তিনি শতবর্ষ পাড়ি দিতে পারবেন। কিন্তু এটাই তাকে আজও নানাভাষী মানুষের কাছে অমর করে রেখেছে। এর চেয়ে অনেক শিল্পসম্মত উপন্যাস লিখেছেন তিনি। সে সব কিছুকে ছাপিয়ে এক দেবদাস পাঠক হৃদয় ছাড়িয়ে চলচ্চিত্র দর্শকের মস্তিস্ক ঠাঁই নিয়েছে। দেবদাসের জন্য পারু ও চন্দ্রমুখীর জন্য, এখনও অনেকে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন। শক্তিশালী হাত শরৎচন্দ্রের। কাহিনী বুণনের দক্ষতা তাকে সমকাল ছাড়িয়ে এই বর্তমানকালেও স্মর্তব্য করে রেখেছে। পার্বতী, দেবদাস, চন্দ্রমুখীর নির্মাতা হিসেবে শরৎচন্দ্র হয়ত আরও শতবর্ষে ধাবিত হবেন ভাবীকালের পাঠক ও চলচ্চিত্র দর্শকের হৃদয় মথিত করে। এখানেই শরৎচন্দ্রের সফলতা।
×