ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

-সেলিনা হোসেন

লেখালেখির প্রেরণা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৬ অক্টোবর ২০১৭

লেখালেখির প্রেরণা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম

সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকরি থেকে অবসর নেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ভ্রমণ তার নেশা। মোট উপন্যাসের সংখ্যা ২১টি, গল্প গ্রন্থ ৭টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৪টি। কবিতার বই: বর্ণমালার গল্প। ১৪ জুন ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয়া এই লেখকের বোধ আর অভিব্যক্তি অনুসন্ধান করতে কথা বলেন - হাসান সাইদুল কেমন আছেন? খুব ভাল আছি তোমরা কেমন আছ? বর্তমান ব্যস্ততা কেমন? ব্যস্ততার কথা বলা যাবে না। কাজ আর কাজ। (আমার মেয়ের নামে) ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন ওখানে সময় দিতে হয়। প্রতিদিন অনুষ্ঠান তো থাকেই। এই আর কি? নতুন কি বই পাবে পাঠক? আগামী বইমেলার জন্য লিখছি ‘সাতই মার্চের বিকেল’ নামে একটি বই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা কে কীভাবে নিয়েছিল সে বিষয়ে লিখছি। এখনও লেখা শেষ হয়নি। আশা করছি বইমেলায় পাঠকদের হাতে হাতে যাবে। আপনার প্রতিষ্ঠিত ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের কি অবস্থা? খুব ভাল। ওখানে সময় দেয়া হয়। এটা একটা জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে দরিদ্র নিপীড়িত নারীদের জন্য। আমার মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে এটা আমি প্রতিষ্ঠা করি। যতদিন বেঁচে থাকি জনসেবামূলক কাজ করে যেতে চাই। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার অনুভূতি? এ কত যে আনন্দের কত যে সুখের আমি বলে বুঝাতে পারব না। আমি আমার লেখার যে রয়েলিটি পাই সব টাকাই আমি মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেই। মানুষ যখন আমার সামান্য কাজে সামান্য সহানুভূতি পেয়ে খুুশি হয় তখন নিজেকে খুব সুখি মানুষ মনে হয়। আমাদের সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা? বাংলাদেশের সূচনা থেকে এ পর্যন্ত যে সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে সেটাকে আমি অনেক ভালই বলব। এখানকার লেখকরা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা বিশ্বের সমসাময়িক চর্চাকে ধরতে পারছেন। আমি সামগ্রিকভাবে ভাল মনে করি। শিল্প-সংস্কৃতির অনেক মাধ্যমেও বেশ ভাল কাজ হচ্ছে। এখানে অনেক শিল্পসম্মত এবং উন্নতমানের নাটক তৈরি হচ্ছে। মঞ্চায়ন বা ফর্মের দিকেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখানকার লেখকরা বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তারা পিছিয়ে নেই। তবে এটি ঠিক, শিল্পের গুণগতমান বিচার করবে সময়। মানুষের জন্য কিছু করার আকাক্সক্ষা কীভাবে তৈরি হলো? আমি ছোটবেলায় বাবার কাছে কাছে থাকতাম। কার সঙ্গে কোন বিষয়ে কথা বললে আমি বাবার পাশেই বসে থাকতাম। সন্ধ্যাবেলায় অফিস শেষে বাড়ির সামনে হারিকেন জ্বালিয়ে আব্বাকে ঘিরে বসত গ্রামবাসী। অনেকেই নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার কথা নিয়েও আব্বার কাছে আসতেন। একদিন এক বুড়ো মা এসে আব্বাকে বললেন, ‘আমার ছেলে আমাকে ভাত দেয় না।’ বাবা রেগে গিয়ে ছেলেকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। ছেলে আসার পর কয়েকজনকে বললেন, ‘ওর পেটে একটি কাঁঠাল বেঁধে দিয়ে ঘোরাও পুরো গ্রামে। দেখুক ভার বইতে কী কষ্ট।’ এই যে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, মানুষের সঙ্কট, এগুলো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এগুলো আমাকে ভাবিয়েছে, শিখিয়েছে। কিন্তু আমি যখন বড় হয়ে মার্কস এ্যাঙ্গেলের বই পড়লাম তখন আমার মনে হয়েছে, নাহ বাবা কাজটা ঠিক করেননি। ওই ছেলেটি বলেছিল, ‘আমারই তো ভাত জোটে না, আমি মাকে কী করে চালাব।’ ওর একটা বাচ্চা ছিল। ওর মনে হয়েছে, মায়ের চেয়ে আমার এই শিশুটিকে খাওয়ানো বেশি জরুরি। এই সম্পর্কগুলো আমি বাবার পায়ের কাছে বসে আবিষ্কার করতে পেরেছি। আমাদের বাড়ির পাশে এক মাঝি ছিল। মা যখন বিভিন্ন উৎসবে সেমাই রান্না করত। খিচুড়ি রান্না করত আমি কলা পাতায় প্যাঁচিয়ে ওই মাঝিকে দিতাম মাঝি খুব করে খেত আর কি যে খুশি হতো আল্লাহ! এই যে অল্পতে খুশি এটা আমি মাঝি থেকে জেনেছি। ঐযে ছোটবেলার সঞ্চয়। আমার সোনালি শৈশব থেকে পাওয়া মানুষের গল্প থেকে মনে হয়েছে আমার লিখতে হবে। না লিখতে পারলে আমি বাঁচব না। আমি মানুষের জন্য কিছু করবই। আমার কাজের আমার লেখার যত প্রেরণা তা প্রথমে আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। বাসায় শুধু রবীন্দ্রনাথের ছবি... একজন জমিদার কী করে এতো বৈচিত্র্যময় হতে পারে। গরিব মানুষের প্রতি তার যে মায়া। তা আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ে জেনেছি। তার জ্ঞানের যে পরিধি কী বলব! ছিন্নপত্র পড়লে বুঝতে পারবেন। হরিচরণ দাস তার জমিজমার দেখভাল করতেন। তাকে চিঠি লিখেছেন, ‘যাদের ফসল নষ্ট হয়েছে তাদের সবার খাজনা মাফ। চিঠিতে লিখেছেন, ‘প্রবল বন্যায় ভেসে গেছে, নদীতে গ্রামের বধূরা বাচ্চাদের গোসল করাচ্ছে। পাশে গাছের ডালে একটি সাপ লিকলিক করছে। তিনি ফিরে এসে চিঠিটা শেষ করলেন এভাবে যে, মানুষের জীবনে দুর্যোগ তিনটি। এক. প্রকৃতি, দুই. রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তিন. শাস্ত্র বা ধর্ম। ধর্মের কারণে আজ সমাজে এই শ্রেণী বিন্যাস। এই তিনটা জিনিস পড়ার পরে আমি মনে করেছি, আমার আর জ্ঞানের দরকার নেই, জ্ঞানের জন্য আমার আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমি তো রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিছু বুঝি না। যদিও আমি তেমন করে বলি না। তাহলে তো অনেক কিছু হয়ে যাবে। কলেজ জীবনের কিছু স্মৃতি আমি গিটার বাজিয়েছি, নাচ করেছি। আমাকে ছাড়া কলেজে কোন অনুষ্ঠান হবে ভাবতেই পারতাম না। জীবনের প্রেমের অভিজ্ঞতা এগুলো তো ছিলই। অনেকেই আমার প্রেমে পড়েছে। আমাকে চিঠি দিয়েছে কতজনে। আমি তো সব সময় পড়াশোনা-লেখালেখি নিয়ে পড়ে থাকতাম। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। তো দলের একজন আমাকে একদিন একটি চিঠি দিয়েছিল। আমি চিঠিটা ছিঁড়ে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কারো প্রেমে পড়া—— ইচ্ছে ছিল না। কখনও ভাবিনি কারও প্রমে পড়ব। কিন্তু চাকরি জীবনে একদিন আমার মেয়ে ফারিয়া লারা যখন ছোট একদিন (আমার এক সহকর্মী) আনোয়ারের কোলে ওঠে তাকে বাবা বলে ডাকল। আনোয়ার কি যে খুশি হলো। আনোয়ার তারপর থেকে লারাকে মেয়ের মতো দেখতে আদর করত। আমার মেয়েটেকে সে নিজের মেয়ে ভাবত। সে জন্য সে আমার প্রতি ঝুঁকে গেল। তার পরের বিষয়টা তো সকেলই জানে। আজও আমরা এক সঙ্গে। ফারিয়া লারা যখন দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন আনোয়ার যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিজের সন্তান না হলেও অন্যের সন্তানের প্রতি আনোয়ারের যে কি টান তা আমি আনোয়ার কাছ থেকে দেখেছি জেনেছি। সন্তানের টানে আমি আনোয়ারের প্রেমে সাড়া দিয়েছিলাম। ধর্ষণ নিয়ে কিছু বলুন আমারও ভীষণ অবাক লাগে একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে। তনু, বনানীর দুই তরুণী, ছোট শিশু। ইদানিং গণধর্ষণ যেন বাড়ছেই।?এগুলো যতটা হৃদয়বিদারক, ঠিক ততটাই বিস্ময়করও। মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় এতটাই হয়েছে যে, একটি শিশুকেও ওরা ছাড়ছে না। রূপার ঘটনায় পত্রিকায় পড়েছি, একসঙ্গে মামা-ভাগ্নেও ছিল। এখন যা হচ্ছে, সেটাকে মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া আর কী বলব। বিচার না হওয়া ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যখন জাতিকে ডুবিয়ে রাখে, তখন উত্তরণের আর পথ পাওয়া যায় না। আমরা তো আসলে সবকিছুই নিজেদের ক্ষমতার জায়গা থেকে দেখি। পুরুষ সব সময়ই নিজেকে নারীর চেয়ে ক্ষমতাধর মনে করে। এই ক্ষমতা ফলাতে গিয়েই তো নারীর ওপর সব রকম জোর খাটানোর চেষ্টা করে। ধর্ষক ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে করে এদের সাহস আরও বেড়ে যাচ্ছে। তবে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার এটা বন্ধ করতে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত বিচার আইনে কঠিন শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। প্রথম লেখা প্রকাশের অনুভূতি? লেখালেখি জীবনের প্রথম আনন্দের বিষয় হলো ১৯৬৪ সালে রাজশাহী ডিভিশনের একটা সাহিত্য সংঘ, একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। তখন আমি একটা গল্প জমা দিয়েছিলাম যেটি আমার জীবনের প্রথম লেখা গল্প। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে গল্পটা অনেক খুঁজাখুজি করেও আমি পাইনি। গল্পটার নামটাও আমার মনে পড়ছে না। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ তুমিও ভাল থেক
×