ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে মহাবিপর্যয়ে রোহিঙ্গারা ॥ আরও জ্বালাও-পোড়াও

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ অক্টোবর ২০১৭

রাখাইনে মহাবিপর্যয়ে রোহিঙ্গারা ॥ আরও জ্বালাও-পোড়াও

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই ঘোলাটে রূপ নিচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ইস্যু। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার রাখাইন সন্ত্রাসীরা দমন-নিপীড়ন বন্ধ না করে দেশ ছাড়তে বলপ্রয়োগ শুরু করেছে। কয়েকদিন ধরে আরও জোরদার করা হয়েছে রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযান। রোহিঙ্গা বসতিগুলো ঘেরাও দিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে এখনও রাখাইনে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা এখন মহাবিপর্যয়ে। গত ২৪ আগস্ট রাত থেকে রাখাইন রাজ্যজুড়ে রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ দিনে অগণন রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু যেমন প্রাণ হারিয়েছে তেমনি প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে লাখে লাখে অনুপ্রবেশ করেছে। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এ সংখ্যা বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন ৯ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নির্বিচারে তা-ব ও গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে ৭ সহস্রাধিক। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে নৌকাডুবিতে এবং স্থলমাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে আরও দেড় শতাধিক। রাখাইন রাজ্য থেকে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে যখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। তখন এ সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও ইতোপূর্বে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা ১০ লাখ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে সহিংস পরিস্থিতি থামার কোন লক্ষণ নেই। গণহত্যার বদলে গণবিতাড়ন শুরু হয়েছে। ফলে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সকলেই এখন বাংলাদেশমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তও খোলা রাখা হয়েছে। এতে করে সহজেই রোহিঙ্গারা আসছে প্রতি রাতে হাজারে হাজারে। টেকনাফ সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সর্বশেষ বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে আরও ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে সেখানকার রাখাইনে রোহিঙ্গা বসতিগুলো এখন জনমানব শূন্য। ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে রাখাইন সন্ত্রাসীরা লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, সেদেশে আর একজন রোহিঙ্গাকেও থাকতে দেয়া হবে না। যেসব রোহিঙ্গা প্রাণভীতি নিয়ে সেখানে রয়ে গিয়েছিল তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ। ঘেরাও করে তাদের ওপর বলপ্রয়োগ করে এখন বের করে দেয়া হচ্ছে। ফলে তারাও এখন সীমান্তে পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসছে। অচিরেই রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য যে হতে যাচ্ছেÑ তা অনেকটা নিশ্চিত। বর্তমানে কোন মহলে কোন ধরনের সন্দেহের আর অবকাশ নেই যে, জান্তা সমর্থিত মিয়ানমার সরকারের প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী রাখাইনকে তারা রোহিঙ্গামুক্ত করার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারই বাস্তবায়ন ঘটে চলেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত, নির্যাতনের ঘটনাবলী দিনে দিনে জাতিসংঘসহ সারাবিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শক্তিশালী বহু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারের প্রতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার বিভিন্ন চিত্র। আহ্বান জানানো হয়েছে এ বর্বরতা থামাতে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান যে, মিয়ানমার সরকার এসবের কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। সর্বশেষ মিয়ানমার সরকারের পক্ষে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের এবং গণমাধ্যম কর্মীদের রোহিঙ্গা বসতির ধ্বংসস্তূপগুলোর পরিদর্শনে নেয়ার পর তাদের পক্ষ থেকেও যৌথ বিবৃতি এসেছে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত দমন-নিপীড়ন, নির্যাতনসহ নানা ঘটনাবলী নিয়ে। কিন্তু এতে যেন কিছুই যায় আসে না মিয়ানমার সরকারের। তারা তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে অটল অবস্থানে থেকে বেপরোয়া গতিতেই রোহিঙ্গা বিতাড়নে সকল অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেয়ার ঘোষণা দিলেও তা সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজি হিসেবেই প্রমাণিত হচ্ছে। ইতোপূর্বে যেমন লাখে লাখে এসেছে, এখন আসছে হাজারে হাজারে। ফলে রাখাইন রাজ্যে রয়ে যাওয়া অবশিষ্ট প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গাও দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে। কারণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্য ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা ফের রোহিঙ্গাদের ওপর তা-ব শুরু করেছে। এর আগে টানা প্রায় ২৫ দিন রোহিঙ্গা ঢল নামার পর কয়েকদিন অনুপ্রবেশ হ্রাস পেয়েছিল। এখন তা আবার বেড়ে গেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলেছে, বিশ্ব চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে বলা হয়েছিল, তাদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। কিন্তু নিরাপত্তার বদলে ঘরে ঘরে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। ৩ সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গাদের বসতিগুলোতে আগুন দেয়ার পর আবার নতুন করে আগুন দেয়া হচ্ছে। ফলে সেখানে আর প্রাণ নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই নতুন করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসতে হচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সদস্যরা আরও জানিয়েছে, যারা শত নির্যাতনের পরেও থাকতে চেয়েছিল তাদেরও আর রক্ষা হচ্ছে না। এখন হত্যার হার কমেছে সত্য কিন্তু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ॥ রাখাইন রাজ্যে সেনা ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের চলমান তা-বে সেখানকার সকল রোহিঙ্গা অচিরেই বাংলাদেশে চলে আসারসমূহ আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এখনও সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবশিষ্ট লোকজনকে তাড়িয়ে দিতে সরকারী বাহিনী ছাড়াও উঠেপড়ে লেগেছে স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসীরা। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি দ্বিগুণ নির্যাতন চালাচ্ছে রাখাইন যুবকরা। তারা রোহিঙ্গাদের বলছে, এটি রাখাইন স্টেট। এখানে রোহিঙ্গা নামে কেউ থাকতে পারবে না। আরও বলছে, ‘তোরা বাঙালী, তোদের দেশ বাংলাদেশ তোরা বাংলাদেশে চলে যা’। যেসব রোহিঙ্গা এতে গড়িমসি করতে তাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ফলে আর সেখানে টিকে থাকা সম্ভব নয় বলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সূত্রে বৃহস্পতিবার নিশ্চিত ধারণা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা গ্রাম একেবারে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে। ওসব গ্রামে শুধু রোহিঙ্গারাই বসবাস করত। সূত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল জোরদার রয়েছে। তবে হত্যা করা হচ্ছে এমন কোন খবর মিলছে না। কিন্তু শারীরিক বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে রাখাইন উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত হামলে পড়ছে। জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রেখেছে। সেনা সদস্যরা এ কাজে ইন্ধন যোগাচ্ছে। রাখাইনে বুচিদং এলাকার কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রাম খালি করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী নির্দেশ দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য রাখাইন সন্ত্রাসীরা হুমকির ওপর হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। গত ২ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর দফতরের মন্ত্রী তিন্ত সোয়ে ঢাকায় সফরকালে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয়ার পরবর্তী দিনগুলোতেও সেখানে রোহিঙ্গাদের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বৃহস্পতিবার ভোর রাত পর্যন্ত আরও ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে সাগর পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বুচিদং, নারাইংশং, রোইঙ্গাদং, চিন্দং, ওলাফে, কুইন্দাং, মগনা পাড়া রাজাবিড়া, দাব্রিওং, চ্যাংগ্রী পাড়াসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পল্লীতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও যুবতী এবং নারীদের ওপর ধর্ষণসহ অমানবিক বিভিন্ন ঘটনার জন্ম দিয়েছে সেখানকার সেনা ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা। বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিলেও নাগরিকত্ব আইনের মারপ্যাঁচ ও চুক্তির দোহাই তুলে দেশটির কর্তৃপক্ষ লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের দেশের বাসিন্দা নয় বলে দাবি করতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ লাখ লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গার তালিকা দিতে পারে মিয়ানমারকে। ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ঘোষণা অনুসারে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ওসব রোহিঙ্গার তালিকা ভেরিফিকেশনের নিয়ন্ত্রণ মিয়ানমারেরই হাতে। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে উলেখ রয়েছে, এ আইন কার্যকর হওয়ার আগে যাদের নাগরিকত্ব ছিল, তাদের নাগরিকত্ব বহাল থাকবে। তারা মিয়ানমারের নাগরিক বলে গণ্য হবে। তাদের কাছে রয়েছে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি)। আবার মিয়ানমারে ১৯৮৯ সালে নাগরিকত্ব নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া চালানোর সময় যারা নতুন শর্তাবলী পূরণ করতে পেরেছে, তাদের এনআরসির বদলে সিটিজেনশিপ স্ক্রুটিনি কার্ড (সিএসসি) দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সরকারীভাবে প্রচার করা হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়াদের এখন দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের নাগরিকত্বের (এনআরসি-সিএসসি) কাগজপত্র দেখাতে হবে। শুধু এ প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই ও প্রত্যাবাসন নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু সেখানকার সূত্রগুলো বলছে, যেখানে জীবনের ভয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পালিয়ে আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গার এনআরসি-সিএসসি বা কোন ধরনের কাগজপত্র নেই। যাদের আছে তা হাতেগোনা। এছাড়া দেশছাড়া করার আগে বহু রোহিঙ্গার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্ড কেড়ে নেয়া হয়েছে। গণকবর খুঁড়ে লাশ সরিয়ে নেয়া হচ্ছে দক্ষিণ রাখাইনে বুচিদংয়ের বিভিন্ন গণকবর থেকে রোহিঙ্গাদের গলিত মৃতদেহ সরিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। সিন্দিপ্রাং পাহাড়ী এলাকার গর্তে দেয়া ওসব মরদেহ সরিয়ে নিচ্ছে সেনা, বিজিপি ও রাখাইন যুবকরা। বিদেশী পর্যবেক্ষক দল যাতে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার আলামত খুঁজে না পায়, সে জন্য গণকবর থেকে লাশ সরিয়ে নিচ্ছে বলে ওপারের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে সেনাপ্রধান এদিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বৃহস্পতিবার দুপুরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। ত্রাণ সহায়তা প্রদান, নিবন্ধন কার্যক্রম, আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণসহ সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলী দেন। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শনে সেনাপ্রধানের এটি দ্বিতীয় সফর। এগিয়ে চলছে নিবন্ধন কাজ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ৩টি ক্যাম্পের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কাজ এগিয়ে চলছে। পাসপোর্ট অধিদফতর এ নিবন্ধন কাজ বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন ও এদের সব ধরনের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬৩ হাজার জন রোহিঙ্গা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছে বলে জানা গেছে। পর্যটন মৌসুমে ক্ষতির আশঙ্কা রোহিঙ্গার ঢল নামার কারণে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন পর্যটকরা। এর ফলে কক্সবাজারের পর্যটন খাতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চল রোহিঙ্গাদের নিয়ে ছেয়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় বহু পর্যটক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির আশঙ্কায় হোটেল-মোটেল বুকিং বাতিল করে চলেছে। ১ অক্টোবর থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এরপরও পর্যটকদের মাঝেও নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে। ফলে কক্সবাজারের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউসসহ আবাসিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতরা ইতোপূর্বেকার মতে আর্থিক সুবিধা করতে পারছে না। পরিস্থিতি দিন দিন অবনতিশীল। কারণ পর্যটকদের সংখ্যা কেবলই হ্রাস পাচ্ছে। এর পাশাপাশি পর্যটকরা যে সব বিপণি কেন্দ্র থেকে সাধারণত কেনাকাটা করে থাকে। সেসব বিপণি কেন্দ্রগুলোও অনেকটা খাঁ খাঁ করছে। তবে একেবারেই যে পর্যটক নেই তা নয়। কিন্তু তা অন্যান্য সময়ের তুলনায় একেবারেই কম। ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ ব্যাপক নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এখন থেকে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তাদের কাছে এ সংক্রান্তে পত্র দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণে এখন থেকে তাদের ওই নামেই আখ্যায়িত করা হবে। শরণার্থীর মর্যাদা দেয়া হবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব জানিয়েছেন, ওই ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ২১ দফা সম্বলিত সাইনবোর্ড নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজদেশে ফিরে যেতে রোহিঙ্গারা আশ্রিত ক্যাম্পে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছে। রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটি নামে একটি সংগঠন ২১ দফা দাবি দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে বিভিন্ন পয়েন্টে। উখিয়া কুতুপালং, বালুখালী, জামতলী, থাইনখালী ও টেকনাফ লেদা পয়েন্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় টাঙ্গানো শতাধিক সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজীতে ২১ দফা দাবি উলেখ করে বিশ্ব সম্প্রদায় ও মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা আছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার আগে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। রোহিঙ্গাদের বাধ্যতামূলক নাগরিক অধিকার প্রদান ও কোন শর্ত না দিয়ে ফিরিয়ে নেয়া। পুড়িয়ে দেয়া রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ মিয়ানমার কর্তৃক সরকারীভাবে দেয়া। রোহিঙ্গাদের সকল শিক্ষার অধিকার এবং বাড়িঘরের জমিজমা কোন শর্ত ছাড়া কাগজে-কলমে ফেরত দেয়া। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমির পুরনো নাম আরাকান এস্টেট করা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার এবং নিরাপত্তা প্রদান। আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা বিচারব্যবস্থা ও রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ প্রদান। মিয়ানমারে কারাবন্দী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও আরকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা কারাগার স্থাপন। রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা মুসলিম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, যে কোন এনজিও এবং দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের আরাকানে প্রবেশ করার অধিকার দেয়ার পাশাপাশি নিজস্ব টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে কোন বাধা না দেয়া। আরাকান প্রদেশের অস্ত্রধারী বৌদ্ধদের নিরস্ত্রীকরণ, রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও যুবকদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা ও ধর্ষণের বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে সম্পন্ন করা। রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি থানায় ও আইসির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন সদস্যদের মোতায়েন। রোহিঙ্গাদের মসজিদ মাদ্রাসা, মক্তব ও তাবলিগের মরকজসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা দেয়া। রোহিঙ্গাদের সকল সরকারী চাকরি দেয়া, পুরো আরাকানে ও বার্মার যে কোন জায়গায় রোহিঙ্গাদের চলাফেরা করার অধিকার দেয়া। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাসপোর্ট প্রদান ও বিদেশ গমনের সুযোগ দেয়া। কোন মামলা ছাড়া সেনা, পুলিশসহ কোন বাহিনী অনর্থক রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে তল্লাশির নামে প্রবেশ না করা, রোহিঙ্গা আলেম-ওলামাদের পাঞ্জাবি-পায়জামা টুপি পরনে ও ধর্মীয় কাজে বাধা না দেয়া ও গবাদিপশু, হাঁস, মুরগি পালনে কোন ক্ষতিপূরণ না নেয়া ইত্যাদি দাবি সংবলিত সাইনবোর্ড বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরের পয়েন্টে টাঙ্গানো হয়েছে। প্রশাসনিক ও পরিষেবা ইউনিট চালু কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পকে ২০টি ব্লকে বিভক্ত করা হচ্ছে। প্রত্যেক ব্লকের জন্য একটি প্রশাসনিক ও পরিষেবা ইউনিট ও একটি গোডাউন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর ফলে সকল ধরনের সেবা প্রদান সহজতর হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসন। কক্সবাজার সার্কিট হাউসে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় বিষয়ক প্রশাসনের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ইতোমধ্যে ৭০ হাজারের অধিক শেড নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মোট ১ লাখ ৫০ হাজার শেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা দেশী-বিদেশী এনজিওদের সহায়তায় দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। শেডগুলো সাময়িক সময়ের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে। কুতুপালং ক্যাম্পে নতুন ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট স্থাপিত হবে। কুতুপালং ক্যাম্পের বাইরে যেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা থাকছেন ক্রমান্বয়ে তা গুটিয়ে একই ক্যাম্পে সবাইকে রাখা হবে। ইতোমধ্যে ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে যেসব রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে বলে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কেন্দ্রের কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন। ক্যাম্প এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৮ কিলোমিটার ও এলজিইডি ৯ কিলোমিটার নতুন রাস্তার নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৪টি গোডাউন নির্মাণের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৫টি গোডাউন নির্মিত হয়েছে। বাকি ৯টির নির্মাণকাজ এ সপ্তাহে শেষ হবে বলে জানা গেছে। খাদ্য সরবরাহ প্রসঙ্গে সভায় জানানো হয় বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ৫ লাখ ২০ হাজার লোকের খাদ্যের সংস্থান করবে। এর বাইরে কেউ বাকি থাকলে দেশী-বিদেশী সংস্থা থেকে প্রাপ্ত ত্রাণ থেকে তাদের খাদ্য সরবরাহ করা হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে জানানো হয়েছে ইতোমধ্যে সরকারীভাবে ক্যাম্পে ৩৬টি কমিউনিটি হাসপাতাল ইউনিট করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রায় ৫ হাজার গর্ভবতী মহিলাকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। ৭০ হাজার লোককে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের টিকা। বর্ধিত ক্যাম্প এলাকা আলোকিত রাখতে ৯ কিলোমিটার নতুন বিদ্যুত লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে এবং প্রত্যেক খুঁটিতে স্ট্রিট ল্যাম্প লাগানোর জন্য বলেন মন্ত্রী। ইতোমধ্যে ৬৩ হাজার রোহিঙ্গার লোকের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে বলে সেনাবাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে বলে জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালই রয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে কোন ধরনের উস্কানিমূলক কাজে অংশ নিতে না পারে সে জন্য গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া বিকেল ৫টার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বাংলাদেশীদের প্রবেশের ওপর স্থানীয় প্রশাসনের প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞাও বলবৎ হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের ১৫টি পয়েন্টে তল্লাশি চেকপোস্ট দিবারাত কাজ করছে। তবুও ছড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা প্রশাসনের আরোপিত নজরদারির পরও মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন যানবাহন থেকে বিভিন্ন সংখ্যার রোহিঙ্গা উদ্ধার হচ্ছে এবং তাদের কুতুপালং ক্যাম্পে প্রেরণ করা হচ্ছে। এরপরেও অন্যান্য পথে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র পথে উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে চলে যাচ্ছে নৌকাযোগে।
×