ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যে যার মতো হত্যা করছে নদী

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৬ অক্টোবর ২০১৭

যে যার মতো হত্যা করছে নদী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দখল দূষণে দেশের নদ-নদীগুলো মরণ দশায় পতিত হলেও তা রক্ষায় আজ পর্যন্ত কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। নদী রক্ষায় দেশে কোন আইন তৈরি করা হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে কোন নীতিমালাও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের দাবির মুখে সরকার একটি নদী কমিশন গঠন করলেও এখন পর্যন্ত এর কার্যক্রম নেই বললেই চলে। আইন এবং নীতিমালা না থাকায় প্রভাবশালীরা নদীর ওপর দখলদারিত্ব কায়েম করছেন। দেখার কেউ নেই। অথচ নদী রক্ষায় আদালতের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেছে, বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষা করা না গেলে ঢাকা শহরের বিপর্যয় নেমে আসবে। দখলে-দূষণে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চার নদীর অবস্থা খুবই করুণ। একই সঙ্গে অন্যান্য নদীরও মরণ দশা হয়েছে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় একশ’ নদী বর্তমানে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে রয়েছে। আগে সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ থাকলেও বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে তা ৪ হাজার কিলোমিটারের নিচে নেমে আসছে। ইতিহাস ঘেটে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার করুণ দশার শিকার হচ্ছে প্রায় ২শ’ বছর ধরে। অথচ ব্রিটিশ সরকারের সময়ই বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণ অনুসন্ধানে ১৮৬৬ সালে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বুড়িগঙ্গাসহ দেশের নদ-নদী রক্ষায় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন প্রায় ২০ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। অথচ সরকার এ বিষয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আদালতের আদেশে নদী রক্ষায় পিলার স্থাপন করে নদীর জায়গা ভূমিদস্যুদের দখলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে নদ-নদীগুলো এমন করুণ অবস্থার শিকার হচ্ছে যে বুড়িগঙ্গাকে এখন আর নদী বলে উল্লেখ করা হয় না। জলজপ্রাণী রক্ষায় বুড়িগঙ্গায় যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকা দরকার তা পাওয়া যায় না। ফলে দূর থেকে এখন বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ নাকে ভেসে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীর পাড় দিয়ে চলাফেরা করাও এখন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ অবস্থায় বেসরকারী সংগঠন এ্যাকশন এইডের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার আয়োজন করা হয় নদীর অধিকার -নদীতে অধিকার বিষয়ে এক সংলাপের। সেখানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, নদী রক্ষায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। নেই নদী রক্ষায় কোন আইন। হাইকোর্টের রায় আছে নদী রক্ষার্থে। কিন্তু সরকার ও প্রভাবশালীরা সেটা মানছে না। স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চাইছে না নদী রক্ষা করতে। সরকারের দুর্বলতার কারণে রাজনৈতিক কর্মীরা নদী রক্ষায় বাধা দিচ্ছেন। নদী বিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞ হাসনাত কাইয়ূম বলেন, বাংলাদেশে কয়েক শ’ নীতি আছে। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো, বাংলাদেশে কোন নদী নীতিমালা নেই। ফলে নদীকে যে যার মতো করে হত্যা করছে। নদী রক্ষায় সরকারী কাঠামো নিয়ে কথা বলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন মুরশিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নদী ও পানির অধিকার রক্ষায় নদী কমিশন করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলো, নদী কমিশন এখন একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। গত তিন মাস ধরে চেয়ারম্যান নেই। এটি একটি অসম্পূর্ণ কাঠামোর মধ্যে রয়েছে। গবেষণা ও কাজের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাজেট। ফলে নদীর জন্য কাজ করতে পারছে না নদী কমিশন। তিনি আরও বলেন, নদী বাঁচাতে গবেষণায় জোর দিতে হবে। বাড়াতে হবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা। নদীর জন্য আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অত্যন্ত দুর্বল। নিজেরা যখন নড়বড়ে কাজ করি তখন আন্তর্জাতিকভাবে আমরা দুর্বল হয়ে যাই। নদী বাঁচাতে তাই আন্তর্জাতিক শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার পক্ষে বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতসহ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা মনস্ততাত্ত্বিক বৈরিতা রয়েছে। এসব আঞ্চলিক রাজনীতির কারণেও নদী নির্যাতিত হচ্ছে। আমি ব্যারাজের বিরুদ্ধে। আমরা যদি নদীকে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে পারি, তাহলে সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হবে। এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পরিচালক আসগর আলী সাবরি বলেন, নদীর নিজস্ব একটা অধিকার আছে। সেটা রক্ষা করতেই হবে। তা না হলে আমাদের ইতিহাস, কৃষি, অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আইন, কাঠামো ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে নদী রক্ষা করতেই হবে। অনুষ্ঠানে পানি ও নদী অধিকার রক্ষায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশ। তার মধ্যে রয়েছে নদীর জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরি; নদীসহ সকল জলাধার নির্মিত পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতিকর সকল ড্যাম ও অন্যান্য কৃত্রিম স্থাপনা অপসারণ; পানি সংক্রান্ত যেকোন দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক আলোচনা বিষয়ে জনগণকে জানার সুযোগ দেয়া; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা প্রভৃতি। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদী রক্ষায় বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোন আইন ও নীতিমালা না থাকায় রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদী হত্যা করছে। নদী ও পানির সঙ্কট সমাধানে কথা বললেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে নদীর অবস্থা দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। এর প্রভাবে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নদীপথ ২৪ হাজার কিলোমিটার থেকে নেমে এসেছে ৪ হাজার কিলোমিটারে। তারা বলেন, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় নদী রক্ষায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারছে না বাংলাদেশ; যার খেসারত দিচ্ছে এদেশের মানুষ। অনুষ্ঠানে এ্যাকশন এইডের ম্যানেজার শমসের আলী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে বলা হয়, জাতিসংঘ ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহে নৌচলাচল বহির্ভূত ব্যবহার সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। যেখানে বলা হয়, কোন দেশ এককভাবে বা যৌথভাবে এমন কোন প্রকল্প প্রণয়ন করতে পারে না, যাতে অন্য কোন দেশ বা জাতি বা নদীপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ রাজনৈতিক কারণে এই আইনে অনুস্বাক্ষর করেনি। ভারতও নিজের দেশের রাজনীতির বিবেচনায় আন্তর্জাতিক এই আইনে স্বাক্ষর না করায় বাংলাদেশ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে আসা প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহে বিঘœ ঘটায় দক্ষিণ এশিয়ার নদীসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া নদীর বুকে বিপুল বাঁধ ও মানুষের অন্তঃসীমান্তের নদী অববাহিকায় বসবাসরতদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও, পানিপ্রবাহ সংক্রান্ত চুক্তিসমূহে দেশের জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় তাদের মধ্যে অধিকারের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে এবং তাদের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
×